বাবা, আমি মুন্সী আবদুল বারেক; এ অঞ্চলের সেরা ধনীদের একজন। আমার ঘর-বাড়ী, জায়গা-সম্পত্তির অভাব নেই। আমার বাড়ী ভরা গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগীতে। গুটিকয়েক পুকুর আছে, দিগন্ত-জোড়া জমি আছে, চাকর-চাকরানী আছে, আমার তো কিছুরই অভাব নাই।
আমার এত কিছু থাকার পরও আপনি মাঘ মাসের হাড় কাঁপানো শীতের রাত্রে, একাকী খালি গায়ে এই জায়গায় এভাবে পড়ে থাকবেন! এটা আমার কোনক্রমেই সহ্য হচ্ছেনা!
আপনি দয়া করে আমার বাড়ীতে আসন গ্রহণ করুন। আমাদের সেরা কাছারি ঘর (বাড়ির বাহিরের ঘর) খানা আপনি ও আপনার মুরিদ দের জন্য দিয়ে দিব।
আপনি স্বীয় মুরীদান নিয়ে সেখানে তশরিফ রাখতে পারবেন। বিরাট পুকুরে আছে শান বাঁধানো ঘাট! কয়েক হাজার মুরীদান সেখানে হাজির থাকলেও আমার বাড়ীর উঠান ভরবে না।
তাই আপনাকে আমি নিতে এসেছি, আজ আপনাকে আমার সাথে যেতেই হবে। আপনার কষ্ট আমার মোটেও সহ্য হচ্ছেনা। আপনার একটা ব্যবস্থা না করে, আমি যদি মরে যাই, তাহলে আমার কলিজা পঁচবেনা!
বারেক মুন্সী জীবিত থাকতে আপনি এভাবে শীতের রাত্রিতে ঠাণ্ডায় কষ্ট পাবেন, এ দুঃখ আমি কোথায় রাখি! আপনি দয়া করে এই বৃদ্ধের মিনতি রাখুন, দয়া করে আমাকে শরম দেবেন না, খালি রিক্সায় আমাকে বাড়ী পাঠাবেন না, আপনাকে আমার সাথে আজ যেতেই হবে, নতুবা আজ আমার মরা লাশ বাড়ীতে পৌঁছবে!
বয়সের ভাবে ন্যুজ সফেদ চুল-দাড়ির অধিকারী ধনাঢ্য মুন্সী আবদুল বারেক এভাবেই দরবেশকে অনুরোধ করে যাচ্ছেন! তাঁর চোখের জলে গাল, সদা দাড়ি, পরনের সাদা পাঞ্জাবী, সবই ভিজে একাকার হচ্ছে! তারপরও তিনি দরবেশের মন গলাতে পারছেন না।
গ্রামের নাম উকিল পুর। দুই বর্গমাইলের একটি বিলের মাঝখানে রয়েছে টিলা আকৃতির উঁচু স্থান। জায়গাটির নাম ‘সেবা খোলা’! সেবা খোলাকে ঘিরে আড়াআড়ি উত্তর-দক্ষিণ, পূর্ব পশ্চিম দিকে দুটি রাস্তা চলে গিয়েছে। সে রাস্তাগুলোর সংযোগ স্থলে একটি ত্রি-মোড় তথা ত্রি-মোহনী সৃষ্টি হয়েছে যেটার অবস্থান ঠিক সেবা খোলার পাশেই।
গ্রামাঞ্চলে তিন রাস্তার মোড়কে ভাল-মন্দের বাহক মনে করা হয় এটাকে ত্রি-মোহনী বলা হয়। ক্লান্ত-ঘর্মাক্ত পথিক সেবা খোলার বিশাল বটগাছের নিচে একটু জিরিয়ে নেয়।
গরমের ভর দুপুরে সেবা খোলার বটের নীচে পাওয়া যায় শির শির করা বায়ু, চিত্তে আনন্দ দানকারী শান্তিময় নীরবতা। সেবা খোলায় বটের নিচে হিন্দুরা প্রতি শনি ও মঙ্গল বারে তাদের সামর্থ্যানুযায়ী পূজা-অর্ঘ্য দান করে। এর আরেক নাম ভোগ! মনের আশা পুরণ্যার্থে কদাচিৎ তা অন্যান্য দিনেও চলে।
ফলে সেখানে ডিম, কলা, আম, জাম সহ নানাবিধ খাদ্য-দ্রব্য সর্বদা পড়ে থাকে। গ্রামের মানুষের কাছে এ সমস্ত খাদ্য নিয়ে, কখনও কোন কৌতূহল দেখা যায় না। বলা হয় এসব খাদ্যে অকল্যাণ থাকে। তাছাড়া উকিলপুরে এমন গরীব মানুষ নেই যাকে পূজোর ভোগের খাদ্য খাওয়া লাগে।
সেবা খোলার একপাশে রয়েছে পুরানো কবরস্থান। অন্য পাশে আছে একটি ‘ভাগার’। এলাকার মৃত গরু-ছাগলের লাশ এখানে ফেলে দেওয়া হয়। রাতের আঁধারে এসব প্রাণী দেহ, শৃগালের উপাদেয় নৈশ ভোজে পরিণত হয়।
এভাবে একটি মৃত প্রাণী দিয়ে শৃগাল দলের কয়েক দিন নৈশ ভোজ চলে। সেবা খোলার দূরত্ব গ্রাম থেকে দূরে হবার কারণে, মৃত প্রাণীর গলিত পচা দুর্গন্ধ এলাকা অবধি পৌছায়না। তাই এলাকার মানুষ এই ভাগার দীর্ঘদিন ধরে ব্যবহার করে আসছিল।
একদা এক শুভ সকালে, সেবা খোলায়, আচানক এক দরবেশের আবির্ভাব ঘটল! আসা যাওয়ার পথে মানুষ দেখতে পেল, সেই বটগাছের নিচে, যেখানে হিন্দুরা ভোগ রাখেন; সেখানেই চটের বস্তার পোশাক পরিহিত এক দরবেশ বসে আছেন!
তিনি সর্বদা চোখ বন্ধ করে ধ্যানে মগ্ন থাকেন! কখনও কিঞ্চিত চোখ মেলে, রহস্য প্রাপ্তির মত স্মিত হেঁসে পুনরায় ধ্যানে চলে যান! মুসলিম স্টাইলে মুখ ভরা লম্বা দাঁড়ি, হিন্দু স্টাইলে ঝুটা বাঁধা চুল, সাদা দাঁত, সুন্দর চোখের রং, মজবুত শারীরিক গঠনের অধিকারী দরবেশকে দেখতে খুব মানান সই দেখাচ্ছিল!
হিন্দু রমণীরা ‘ভোগ’ দিতে এসে সেবা খোলার ধ্যানমগ্ন দরবেশকে আবিষ্কার করেন! তাঁরা পূজা না দিয়ে, আনিত সমূদয় ফল-মূল; দরবেশের পদতলে উপহার হিসেবে রেখে দেন।
চারিদিক থেকে বিলের কামলারা দুপুরের খাদ্য খাওয়ার জন্য বটের নীচে আসে। তারাও ধ্যানমগ্ন দরবেশকে, তাদের আনিত খাদ্য উপহার দেয়! কামলারা বলতে রইল, পূত-পবিত্র দরবেশের জন্য এক বেলা খানাই যদি উৎসর্গই করতে না পারি, তাহলে মানুষ হিসেবে পরিচয় দিয়ে কি লাভ?
ওদিকে ধ্যানমগ্ন দরবেশের এসব উপঠৌকনের প্রতি কোনই নজর নেই! ইতিমধ্যে পথিকের সংখ্যা বাড়তে থাকে, খাদ্য-দ্রব্যের মন মাতানো গন্ধে মাছির পরিমাণও পাল্লা দিয়ে বাড়ে!
লোভী মাছি খানায় বসে, বেয়াড়া মাছি দরবেশের গায়েও বসে! খালি গায়ের দরবেশ এতে অস্বস্থি বোধ করে। ভক্তিতে আসক্ত এক পথিক, দরবেশের গায়ে যাতে মাছি বসতে না পারে সেজন্য, নিজের গামছা দিয়ে বাতাস করতে থাকে!
অন্যান্য দরবেশ ভক্তরা, যার মত করে দরবেশের উপকারার্থে নানাবিধ কাজে স্বেচ্ছাশ্রমে লেগে যায়। যাতে করে দরবেশের ধ্যানমগ্নে কোন অসুবিধা না হয়!
কানে কানে একথা দশ গ্রামে পৌঁছে, দুদিনের মধ্যেই সেবা খোলা একটি ঐতিহাসিক তীর্থস্থানে পরিণত হয়। হিন্দু-মুসলিম দুই সম্প্রদায়ের মানুষের কাছে দরবেশের গ্রহণযোগ্যতা দ্বিগুণ-ত্রিগুণ করে বাড়তে থাকে।
মানুষের মুখে মুখে দু-একদিনের মধ্যে দরবেশ সম্পর্কিত একটা খোলা-মেলা ধারনা পাওয়া গেল।
‘তিনি সংসার বিরাগী মানুষ, দুনিয়ার প্রতি অনাসক্তি তাঁকে রূহানী জগতে অনেকদূর পর্যন্ত নিয়ে এসেছে! কারো সাথে কথা বলেন না, ছালা বস্তার পোশাক পড়তে তিনি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন, কারো বাড়ীতে মেহমান হতে রাজি নন, কারো দেওয়া খানা সরাসরি গ্রহণ করেন না, নিজের ইচ্ছে মত সামান্য ফল-মূল খেয়ে জীবন ধারণ করেন। প্রকাশ্য খানা-দানা পরিহার করেন, রাত্রে কোন গাছের নিচে বসে কিংবা গাছের সাথে হেলান দিয়ে, একটু তন্দ্রার সুযোগ নেন! এ অঞ্চল থেকে বিভিন্ন বালা-মুসিবত দূর কল্পে তিনি এখানে এসেছেন। তাই অনর্থক কেউ যেন বিরক্ত না করে, নতুবা তিনি আমাদের ছেড়ে চলে যেতে পারেন।’
একদল স্বেচ্ছা সেসব খুবই আন্তরিকতার সাথে ঘোষণা করছিল,
‘কারো দোয়া লাগলে, অভিযোগ থাকলে, দরবেশের সামনে বলে যেতে পারেন। দরবেশের চোখ খোলা আছে কি ধ্যানে আছে, তিনি হাঁসি মুখে আছেন নাকি বেজায় চেহারায় আছেন! এসব দেখার দরকার নেই।
তিনি সর্বদা চেতন থাকেন। তাই সবার কথা তিনি সর্বক্ষণ শুনেন ও দেখেন! সূর্য ডোবার পর যাতে কেউ আশে-পাশে না থাকে, তাঁকে বিরক্ত না করে। কারণ তখন তিনি পরিপূর্ণ রূহানী জগতে থাকেন।
দরবেশের সামান্য অসন্তুষ্টিই কারো চরম সর্বনাশ হতে পারে, কারণ বদ দোয়া বড়ই মারাত্মক জিনিষ। তাই সবাইকে নিজের বিবেক বুদ্ধি দিয়ে কাজ করতে অনুরোধ জানাচ্ছি’।
দিনে দিনে মানুষ বাড়ে! নারী-পুরুষ, শিশু-বৃদ্ধ হরেক রকমের অভিযোগ নিয়ে দরবেশের কাছে ভিড় বাড়াতে থাকে। দরবেশ মাঝে মধ্যে একবার চোখ মেলে, উপস্থিত সবার জন্য শূন্যের মধ্যে দোয়া ছুঁড়ে দেন। বিশৃঙ্ক্ষলার মাঝেও ছোট দলে বিভক্ত হয়ে মানুষ আসতে থাকে।
মানুষ দরবেশের সান্নিধ্য ছাড়তে চায় না, ফলে জটলা এবং ভিড় আরো বাড়ে। উপহার হিসেবে আনিত খাদ্যের উপর দরবেশের একবার নজর পড়ল তো কথাই নেই। এক মুহূর্তে সে উপহারের প্রতি ভক্তরা হায়েনার মত ঝাঁপিয়ে পড়ে। বরকতের আশায় এলাকার স্বচ্ছল-সুঠাম দেহের অধিকারীরাও সে খাদ্য কাড়াকাড়িতে অংশ গ্রহণ করে!
দরবেশের নজর পড়া আনিত এক ডাবের করুন দশা হয়েছিল সেবার! ভক্তকুলের আক্রমণে এক মুহূর্তেই ডাবের শক্ত খোসা শতধা বিভক্ত হয়ে গিয়েছিল। কিছু মানুষ ডাবের বিচ্ছিন্ন ছাল মুখে পুরে বিজয়ীর বেশে পানের মত চিবাতে থাকল!
দরবেশের জন্য প্রচুর খাদ্য-সামগ্রী আসতে থাকে। এলাকার অনেক গৃহস্থ তাদের খেতে-খামারে উৎপাদিত প্রথম ফলটিকে দরবেশের চরণে উৎসর্গ করে। দরবেশের নিরাপত্তা ও শৃঙ্খলার জন্য একটি পরিচালনা কমিটি গঠন করা হল।
কমিটি দরবেশের জন্য আনিত, তাঁর নজর পরা বরকতপূর্ণ খাদ্যগুলোর উপর নিলাম হাঁকাল। পয়সা ওয়ালারা ফল নিলামে কিনতে পারলেও গরীবেরা ফলের উচ্ছিষ্ট নিয়েই পরিতৃপ্ত হল।
“এই ফাঁকে ভ্রাম্যমান হকার আসল। ভাসমান দোকান চালু হল। চনাচূর, পিঁয়াজি, খিরা, জিলাপি, বাতসা, আইসক্রিম দেদার বিক্রি হচ্ছিল। বাচ্চাদের জন্য বেলুন এলো, এসে গেল বাঁশি ওয়ালা। বাচ্চাদের ভেঁ-পুঁ, আইসক্রিমের পেটির আওয়াজ, নিলামিদের হাঁক-ডাক, মানুষদের ব্যাপক কোলাহলে, সেবা খোলা এক দৈব মেলায় পরিণত হল”
এই পরিস্থিতিতেই অশীতিপর বৃদ্ধ, অবস্থা সম্পর্ন্ন, মুন্সী আবদুল বারিক কান্না কাটি করে, দাঁড়ি ভিজিয়ে দরবেশকে তাঁর বাড়ীতে চলে যাওয়ার জন্য আবদার জানাচ্ছিলেন।
কেননা তার বাড়ীতে বিরাট পুকুর আছে, ময়দান আছে, বহু মানুষ জিরিয়ে নেবার সুযোগ পাবে। ফলে ভক্তকুল আরামের সহিত বাবার মুখ দেখতে পাবে।
মহান দরবেশ মাঘ মাসেই উকিলপুরে এসেছিলেন। মাঘের শীতে নাকি বাঘেও কাঁদে। এই ভয়ঙ্কর শীতে মহান দরবেশ কোথায় কিভাবে থাকেন? দুঃখে না সুখে রাত কাটে? এই চিন্তাটা সবার মর্মবেদনার কারণ ছিল।
বিলের পাশের গাঁও। এলাকার আরেক বিত্তশালী আলীম ভূঁইয়াদের বিরাটকায় পাঁচটি খড়ের গাদা। ভূঁইয়া একদা বুঝতে পারেন কেউ না কেউ এই খড়ের গাদায় রাত্রি যাপন করে।
তিনি ধারনা করলেন, রাত্রি যাপনকারী এই ব্যক্তি আর কেউ নন, স্বয়ং দরবেশ বাবা! এতে আলীম ভূঁইয়া নিজেকে খুবই ভাগ্যবান মনে করতে থাকেন এবং খড়ের গাদার সে স্থানে গোপনে কয়েকটি কাঁথা-কম্বল রেখে দেন।
যাতে করে প্রবল শীতেও মেহমান উষ্ণতা পেতে পারেন। দেখা গেল, দরবেশ বাবা ঠিকই প্রতি রাত্রে সেগুলো ব্যবহার করে আলীম ভুঁইয়াকে সম্মানিত ও উপকৃত করছেন! আলীম ভূঁইয়া নিজ দায়িত্বে খড়ের গাদার দেখ-ভাল করতে থাকলেন।
ভূঁইয়া, পরিবারের সবাইকে কঠোর নিষেধাজ্ঞা দিলেন, তাঁর নির্দেশ ছাড়া কেউ যেন খড়ের গাদা এলাকায় না যায়।
‘মরার উপর খড়ার ঘায়ের মত সেবা খোলায় হঠাৎ এক কান্ড ঘটে গেল! কে বা কাহারা রাতের আঁধারে সেবাখোলাস্থ ভাগাড়ে একটি মরা গরু ফেলে যায়!’
চারিদিকে হৈ হৈ রব উঠে। সবার মাঝে ক্ষোভ বিরাজ করতে লাগল! কাল থেকে গরু পচা দুগর্ন্ধে আকাশ-বাতাস ভারী হয়ে যাবে। তখন মানুষ দাঁড়াবে কিভাবে!
অনেকেই বলাবলি করছিল, মরা গরুর মালিকের কাছে কি ইহকাল-পরকালের ভয় নেই? দরবেশের বদ দোয়ার কথা কি একবারও চিন্তা করেনি? সে কি একবারও ভাবেনি যে, বাবার বদদোয়ার ফলে তার গোয়ালের বাকী গরুও মরে যেতে পারে!
এ ঘটনায় দরবেশ বাবাকেও কিছুটা চিন্তিত মনে হল। পরিচালনা কমিটি সিদ্ধান্ত নিলেন, তদন্ত করে দেখবেন এটা কার গরু? এটার পচা-গলা দুর্গন্ধ বের হলে দরবেশ বাবার হবেটা কি?
তিনি কিভাবে এখানে ধ্যান করবেন? এই জায়গায় কিভাবে শত শত মানুষ অপেক্ষা করবেন?
শীতের আবহাওয়ায় ফলে মৃত গরুর লাশ থেকে দুর্গন্ধ তখনও বের হওয়া শুরু হয়নি। কয়েকজন পরামর্শ দিল আজকের রাত অবধি অপেক্ষা করা হউক। রাত্রে শৃগাল এসে ডিনার সেরে নিক। শৃগালের উচ্ছিষ্ট বাকি অংশ কুকুর দিয়ে সেরে ফেলা হবে।
সিদ্ধান্ত হল, গ্রাম থেকে কুকুর আনা হবে। যাদের কুকুর আছে তারা নিজ দায়িত্বে নিজেদের কুকুর নিয়ে আসবে। কেউ ইচ্ছে করলে গ্রামের মল খাওয়া বেওয়ারিশ কুকুরও নিয়ে আসতে পারে। ফলে পচা গরুর বাকি অংশ নিশ্চিহ্ন করা তেমন বড় কোন সমস্যা হবে না।
পরবর্তী সকালটি শুভ হলনা! কবরস্থানের জঙ্গলের গর্তে যে গুটিকয়ের শৃগাল বাস করত, দরবেশের অনুসারীদের পদচারণায় শৃগালের গোষ্ঠী পুত-নাতি সহ দিন কয়েক আগেই এলাকা ছেড়ে পালিয়েছিল। ফলে শৃগাল কর্তৃক মরা গরু আর খাওয়া হয়নি বরং বাগডাসা অথবা খেঁকশিয়াল এসে, গরুর পেট দিয়েছে ফুটো করে! পেটের কিছু ময়লা, নাড়ি-ভুরির কিয়দংশ ও কিছু পচা রস বের হয়ে পরিবেশকে বেকায়দা পূর্ণ করেছে।
রোদ বাড়ার সাথে সাথে গন্ধের তীব্রতাও বাড়তে রইল। বহু কসরত করে, লোভ লাগিয়ে যারা কুকুর নিয়ে এসেছিল, তাদের নিয়ে নতুন সমস্যা দেখা দিল।
বেওয়ারিশ কুকুর সর্বদা স্বাধীনচেতা মনোভাব নিয়ে চলে। তারা স্বাধীনভাবে মানুষের তাজা মল খাবে কিন্তু গরুর পচা গোশত খেতে রাজি নয়! সেদিকে তাদের কোন আগ্রহই নেই!
বরঞ্চ কয়েকটি বদমেজাজি কুকুর নিজেদের মাঝে তুমুল মারামারি বাধিয়ে বসে! এতে মানুষের মধ্যে হুলুস্থুল কান্ড পড়ে গেল। খোদ দরবেশ বাবাকেই বার কয়েক তাঁর আসন ছেড়ে উঠতে হল।
অবশেষে পরিচালনা কমিটির সদস্যদের মৃদু লাটি চার্জের মাধ্যমে, সেবা খোলা কুকুর মুক্ত হল।
শীতের সকালের একমুখী বাতাস বইতে শুরু করে! সেখানে অবস্থান করাটা প্রায় দায় হয়ে পড়ল। পচা দুর্গন্ধে দরবেশ বাবার চেহারায় বিদঘুটে ভাব দেখা দিল!
তাঁর নূরানি চেহারায় দুশ্চিন্তা ও পেরেশানির ভাব পরিলক্ষিত হল! অভিব্যক্তি দেখে বুঝা গেল, পচা গরুর যদি কোন একটা বিহিত না হয়, তাহলে আজই তাঁর শেষ দিন হবে!
ভক্ত মুরিদেরা নিজেদের নাক চেপে, প্রয়োজনীয় কথা বার্তা সেরে নিল। অতঃপর সিদ্ধান্ত হল, যেভাবেই হোক পচা গরু সরাতেই হবে; কিন্তু কিভাবে!
সেবা খোলার পশ্চিম দিকের ছোট্ট গাঁয়ের দূরত্ব একটু কম। গাঁয়ের মাঝ বরাবর একটি মেঠো পথ আছে, তার পরেই একটি খাল; কোন জনবসতি নেই। সিদ্ধান্ত হল পচা গরু বিশেষ পদ্ধতিতে কাঁধে বহন করে সেখানেই ফেলা হবে। এখন শুধু বাস্তবায়নের পালা।
মোটা দড়ি আনা হল! গাছের হালকা অথচ মজবুত লম্বা গদাও জোগাড় হল! স্বেচ্চাসেবীরা এক হাতে নিজের নাক ধরে, আরেক হাত খোলা রেখে পচা লাশের দিকে দৌড়ে গেল।
কিছুক্ষণ নিঃশ্বাস বন্ধ রেখে, যতটুকু সম্ভব পারা যায় কাজ কিছুটা করে আসে। এবার আরেক দলের পালা। এভাবে বহুবারের অনুশীলনের মাধ্যমে মৃত গরুর পা গুলো গদার সাথে বাঁধা হল।
দরবেশ বাবার দুঃখ লাঘবে, পচা গরুর পা বাঁধায় যেমন মানুষের অভাব হয়নি তেমনি পচা লাশ কাঁধে বহন করে দূরে ফেলে আসার মত উৎসাহী ও সাহসী মানুষেরও অভাব হলনা!
ভক্তকুলের মধ্য থেকে শক্ত-সামর্থ্য, দীর্ঘক্ষণ দম ধরে রেখে, ভার বহনে সক্ষম, এমন কিছু স্বেচ্ছাসেবক বাছাই করা হল। তারা নাকে গামছা বেঁধে, আগে দুজন, পিছনে দুজন মিলে, গরুর পচা লাশ কাঁধে তুলে নিল!
ভাগ্য ভালই বলতে হয়! গরুটি ছিল একটি বাছুর, ওজনে অপেক্ষাকৃত হালকা, অতি সহজেই চারজনে আস্ত পচা গরু কাঁধে তুলে ছুটতে পারলেন।
বুকে দম নিয়ে যতটুকু পারা যায় চারজন বীরের গতিতে সামনে চলে। সুপারভাইজার ইঙ্গিত দিলে পালা বদল চলে।
এবার পরবর্তী চারজনের কাঁধ বদলের পালা। শীত কালে মাঘ মাসের মৌসুমে বিল ছিল খালি। খুব সহসাই বহনকারী দল, বিলের প্রায় শেষ প্রান্তে পৌঁছাকে পারল।
সামনেই গাঁয়ের মেঠো পথ, ডানে হিন্দু বাড়ী, বাঁয়ে মুসলিম বসতি, উভয় সম্প্রদায়ের মানুষ একটু গরীব। ছোট গাঁয়ের মধ্যখানে মেঠো পথ ধরে পচা গরুর লাশ যাচ্ছে। পেছনে চলছে ভক্তকুলের বিরাট মিছিল!
খোলা বিল দিয়ে আসার সময় পচা বহনকারীরা খুব দ্রুতই আসতে পেরেছিল। গাঁয়ের এই মেঠো পথে সেভাবে দ্রুত চলাটা সম্ভব ছিলনা।
গাঁয়ের পৌঢ় গৃহবধূরা নাকে শাড়ীর আঁচল পেঁচিয়ে প্রতিবাদ করল। এই সংক্ষিপ্ত রাস্তা দিয়ে পচা গরুর লাশ নেওয়া যাবে না।
পুরুষেরা কেউ বাড়ীতে নেই, অনেকেই দিন কামলা মানুষ। ওদিকে দরবেশে অনুসারীর পাল্লা ভারী। মহিলাদের কথায় কর্ণপাত করার সময় এখন নয়।
সুতরাং মেঠো পথ দিয়েই লাশের মিছিল চলবে। পিছনের দুজনের দম ফুরিয়ে যাচ্ছিল, তখনই পালা পরিবর্তন করা দরকার।
পরবর্তী বহনকারী দল দায়িত্ব নেবার ফাঁকে পিছনের দুজন মেঠো পথের নরম আল ভেঙ্গে খানিকটা নিচে ধ্বসে পড়ে। এতে করে সামনের বহনকারী দুজন টাল নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারল না।
গদায় ঝুলন্ত পচা লাশে আচমকা হ্যাঁচকা টান পড়ে। লাশ টালমাটাল গতিতে দোলতে থাকে। মুহূর্তেই মৃত গরুর পিছনের একটি পা, শরীরের বিরাট অংশ সমেত দেহ থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।
ফলে চার জনের অসাধারণ দল ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে! অমনি আছাড় খেয়ে সবাই হুমড়ি খেয়ে রাস্তার পাশে পড়ে যায়।
টানা হ্যাঁচড়াতে লাশের নাড়ি-ভূরি ইতিমধ্যেই এক প্রকার ডাল হয়ে গিয়েছিল।
পথিমধ্যে লাশের এধরনের পতনে, পচার ফুটো দিয়ে, গল গল করে পচন রস বের হতে লাগল।
মুহূর্তে ছোট্ট গাঁয়ের ঠিক মাঝখানে ভয়ানক দুর্গন্ধ, দৃশ্যত বীভৎস ও কদাকার পরিস্থিতির সৃষ্টি হল।
অবস্থা এমন বেগতিক হল যে, গরুর ছিন্নভিন্ন পচা লাশকে, একমাত্র বালতিতে ভরে নেওয়া ছাড়া আর কোন গত্যন্তর রইল না!
ভক্ত কূলের বিরাট মিছিল, পুলিশের পিটুনি ছাড়াই ছত্রভঙ্গ হয়ে গেল! মানুষ নাক ধরে জ্ঞানশূন্য হয়ে দিক্বিদিক ছুটল।
ছোট্ট গাঁয়ের অসহায় মানুষ, প্রতিবাদের ভাষা হারিয়ে উল্টো গাঁ ছেড়ে পালাল!
সন্ধ্যা অবধি তিন মাইল দূরের ইউনিয়ন পরিষদে চেয়ারম্যানের কাছে নালিশ গেল।
এলাকার রাস্তা-ঘাট কাঁচা। থানার দূরত্ব ১২ মাইলের মত! এলাকায় বিজলী বাতি তখনও পৌঁছেনি। দেশ স্বাধীন হয়েছে কিছুদিন আগে, কয়েকদিন আগেই সিপাহী বিপ্লব হল।
মফস্বলে উন্নয়নের জোয়ার তখনো শুরু হয়নি। শিক্ষিত মানুষের সংখ্যাই ছিল হাতে গোনা। ধর্মীয় শিক্ষায় মানুষ অনেক পিছিয়ে ছিল, শুধু মুখের দাঁড়িকেই ধর্মের মানদণ্ড ভাবা হত।
এমতাবস্থায় মানুষের করার কিছু ছিলনা। পরদিন থেকে দরবেশ বাবার আর হদিস পাওয়া গেলনা, কিছু মানুষ হন্য হয়ে সর্বত্র খুঁজেছে তাকে।
কোনভাবে পাওয়া গেলে, প্রয়োজনে মাফ চেয়ে, হাতে-পায়ে ধরে হলেও আবার এলাকায় নিয়ে আসত।
কিন্তু সব চেষ্টাই ব্যর্থ হল, তিনি আর উকিলপুরে ফিরে আসে নি। গ্রামের মানুষ দরবেশের কথা ভুলে যায়।
সপ্তাহ খানেক পর একদিন পুলিশ এসে হাজির। পুলিশ দরবেশের খবর জানতে চায়। দরবেশ কে না পেয়ে, পুলিশি আলামতের আশায় পরিচালনা কমিটির কয়েকজনের বাড়ীতে তল্লাশি চালায়।
নতুন করে গ্রামে আতঙ্ক ছড়িয়ে পরে, সবাই বলাবলি করছিল, এটা দরবেশের বদদোয়ার ফল।
পুলিশের তথ্য থেকে জানা যায় সম্মানীত দরবেশ কুমিল্লা থেকে পলাতক হয়ে ফেরারী দিন পার করছেন। সে একটি খুনের আসামী।
পুলিশ দরবেশের পিছনে লেগেই ছিল কিন্তু এখানে পৌঁছতে যথেষ্ট দেরী করে ফেলেছিল। ফলে দরবেশ কে পাকড়াও করা সম্ভব হয়নি।
এ সমস্ত কথাকে দরবেশ অনুসারীরা পাত্তাই দিলনা, তারা বলল এটা এক প্রকার বিদ্বেষ, পুলিশ মিথ্যা বলছে।
দরবেশ উকিলপুরে এলেন, অবস্থান করলেন, থাকলেন একটি কথাও কখনও কারো সাথে বলেননি; সর্বদা বোবার মত ধ্যান করলেন!
ধর্মপ্রাণ মানুষ তাকে ইজ্জত দিয়ে ভাল-বাসলেন, বলাবলি করলেন, এ ধরনের নীরব বোবা প্রকৃতির মানুষের শত্রু হয় কিভাবে?
এলাকাতে এখনও তাঁর যথেষ্ট সুনাম-সুখ্যাতি ছড়িয়ে আছে। তাঁর কোন শত্রু হয়নি, কেনানা ‘বোবার কখনও শত্রু হয়না’।
Discussion about this post