ইসলামী সংগঠনে আনুগত্য, পরামর্শ ও ইহতেসাব
মাওলানা দেলোয়ার হোসেন বাংলাদেশী বংশদ্ভোদ একজন মার্কিন নাগরিক তিনি একাধারে ইসলামী চিন্তাবিধ, শিক্ষাবিদ, লেখক ও গবেষক
ইসলামী সংগঠনে আনুগত্য, পরামর্শ, ইহতিসাবের বিষয়গুলো কয়েকটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে।
১. ইসলাম কি?
২. সংগঠন কাকে বলে?
৩. ইসলামী সংগঠনের প্রয়োজনীয়তা।
৪. ইসলামী সংগঠনে আনুগত্য।
৫. ইসলামী সংগঠনে পরামর্শ।
৬. ইসলামী সংগঠনে ইহতিসাব
ইসলাম কি?
ইসলাম শব্দটি ‘সিলমুন’ বা ‘সালমুন’ শব্দ থেকে নির্গত। এর আভিধানিক অর্থ হল, শান্তি চুক্তি, সন্ধি। বস্তুত একজন মুসলমান শান্তিময় জীবন যাপন করতে আল্লাহর পক্ষ হতে আদিষ্ট।
আবার ইসলাম শব্দটি ‘আস্লামা’ শব্দ থেকে নির্গত হলে এর অর্থ হবে – ইসলাম গ্রহণ করা, আত্মসমর্পণ করা, আনুগত্য করা, নির্দেশ পালন করা, সোপর্দ করা, অনুগত হওয়া।
আল কুরআনের ভাষায় ইসলাম কি?
আল্লাহর নিকট মনোনীত একমাত্র জীবন ব্যবস্থাই হল দ্বীন তথা ইসলাম। (ইন্না-দ্দীনা ইনদাললাহীল ইসলাম)
আল হাদীসের ভাষায়, হযরত ওমর ইবনুল খাত্তাব (রা) হতে বর্ণিত হাদীসে আগন্তুক হযরত জিব্রাইল (আ) রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে ইসলাম সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে বিশ্বনবী (সাঃ) জবাবে ইসলামের যে পরিচয় তুলে ধরেছিলেন তা হল:
“তুমি সাক্ষ্য দিবে আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ বা হুকুমকর্তা নেই, মুহাম্মদ (সাঃ) আল্লাহর রাসূল, নামায কায়েম করবে, যাকাত আদায় করবে, রমযানের রোযা পালন করবে এবং হজ্জে যাওয়ার সামর্থ্য থাকলে হজ্জ করবে” (বুখারী, মুসলিম)
ইসলামের সংজ্ঞা অনেকে এভাবে দিয়েছেন:
জীবনের সর্বক্ষেত্রে ও সর্বস্তরে সব রকমের আনুগত্য ও দাসত্ব পরিহার করে বিশ্ব জাহানের প্রতিপালক মহান আল্লাহর নিকট পরিপূর্ণভাবে আত্মসমর্পণ করার নামই ইসলাম।
আর যিনি ইসলামকে মেনে চলেন, তিনিই মুসলিম। যেমন- হযরত ইব্রাহীম (আ)-এর ঘোষণা দিয়েছিলেন, আমি বিশ্ব জগতের রবের নিকট আত্মসমর্পণ করলাম। (বাকারা: ১৩১)
কেউ যদি ইসলাম ছাড়া অন্য কোন জীবন বিধানের অনুসরণ করতে চায় তবে তার কাছ থেকে সেই ব্যবস্থা কখনো গ্রহণ করা হবে না, পরকালের কাঠগড়ায় সে চরমভাবে ব্যর্থ হবে। (আলে ইমরান: ৮৫)
সংগঠন কাকে বলে?
সংগঠন শব্দের আভিধানিক অর্থ: সংগঠন অর্থ- সংঘবদ্ধকরণ, একত্রিতকরণ, ঐক্যবদ্ধ করণ, সংগঠিত করণ।
বিশেষ অর্থে সংগঠন বলতে দলবদ্ধ বা সংঘবদ্ধ জীবনকে বুঝায়।
সংগঠনকে ইংরেজিতে Organization, আরবিতে ‘তানযীম’ এবং হাদীসের ভাষায় ‘জামাআত’ বলে।
সংগঠনের পারিভাষিক অর্থ: “প্রতিষ্ঠিত কোন মতাদর্শকে উৎখাত করে নতুন আদর্শ বাস্তবায়নের জন্য সুসংগঠিত কতিপয় লোকের সামষ্টিক রূপ কাঠামোকে সংগঠন বলে”।
অধ্যাপক গোলাম আযম বলেন, “বিশেষ উদ্দেশ্যে একদল লোকের ঐক্যবদ্ধ হওয়া ও সুশৃঙ্খল উপায়ে ঐ উদ্দেশ্য হাসিলের চেষ্টায় নিয়োজিত থাকার নাম সংগঠন।”
এ, কে, এম, নাজির আহমদের ভাষায় “ইকামাতে দীনের কাজ আঞ্জাম দেয় যে সংগঠন, তাই ইসলামী সংগঠন”।
ইসলামী সংগঠনের প্রয়োজনীয়তা
হযরত ওমর (রা) বলেন, “সংগঠন ছাড়া ইসলাম নেই, নেতৃত্ব ছাড়া সংগঠন নেই, আনুগত্য ছাড়া নেতৃত্ব নেই”।
আল্লাহ রাব্বুল আলামীন ঈমানদারদেরকে সংঘবদ্ধভাবে জীবন যাপনের নির্দেশ দিয়েছেন। “একাকী জীবন যাপনের কোন অধিকার মুমিনদের দেওয়া হয়নি”।
সুতরাং প্রত্যেক মুমিন নর-নারীর উপর জামায়াতবদ্ধভাবে ইকামাতে দীনের সংগ্রামে আত্মনিয়োগ করা ফরযে আইন। আল্লাহর এই জমিনে সকল বাতিল মতবাদের মোকাবিলায় আল্লাহর দীন কায়েমে সংঘবদ্ধ হওয়ার বিকল্প নেই।
আর যারাই এককভাবে জীবন যাপন করতে চাইবে তারাই শয়তানের শিকারে পরিণত হবে। ইসলামী সংগঠন থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া জাহেলিয়াতে প্রত্যাবর্তনের শামিল বলে রাসূল (সাঃ) সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছেন।
ক. সংগঠনে অন্তর্ভুক্ত হওয়া ফরয “তোমরা সংঘবদ্ধভাবে আল্লাহর রজ্জুকে আঁকড়ে ধর এবং পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ো না”। (সূরা আলে ইমরান: ১০৩)
খ. সিরাতুল মুসতাকীম পাওয়ার উপায় “যারা সংঘবদ্ধভাবে আল্লাহর রজ্জুকে ধারণ করবে, মূলত তাদের জন্যই রয়েছে সিরাতুল মুসতাকীম বা সহজ পথের দিশা। (সূরা আলে ইমরান: ১০১)
গ. আল্লাহর ভালবাসা পাওয়ার জন্য “নিশ্চয়ই আল্লাহ তাদেরকে ভালবাসেন যারা তাঁর পথে সীসাঢালা প্রাচীরের ন্যায় অটল হয়ে সংগ্রাম করে”। (সূরা ছফ: ৪)
৪. আল্লাহর রহমত ও অনুগ্রহ পাওয়ার উপায় “যারা আল্লাহর প্রতি ঈমান আনবে এবং তাঁর দীনকে দৃঢ়ভাবে ধারণ করবে, আল্লাহ তাদেরকে স্বীয় রহমত ও অনুগ্রহের মধ্যে প্রবেশ করাবেন এবং তাদেরকে সহজ সরল সঠিক পথের সন্ধান দিবেন”। (সূরা নিসা: ১৭৫)
ঙ. মহাপুরস্কারের ঘোষণা “কিন্তু যারা তাওবা করবে ও নিজেদেরকে সংশোধন করে নেবে এবং আল্লাহর রজ্জুকে শক্তভাবে ধারণ করবে, আর একমাত্র আল্লাহর জন্যই নিজেদের দীনকে নিখুঁত করে নেবে, এমন লোকেরাই মুমিনদের সঙ্গী। বস্তুত আল্লাহ মুমিনদেরকে অতি শীঘ্রই মহাপুরস্কার প্রদান করবেন”। (সূরা নিসা: ১৪৬)
চ. আল্লাহ পাকের হুকুম “অতএব নামায প্রতিষ্ঠা কর, যাকাত প্রদান কর এবং আল্লাহর রজ্জুকে শক্তভাবে ধারণ কর”। (সূরা হাজ্জ: ৭৮)
ছ. সংগঠন কায়েম করা নবীর তরীকা “আল্লাহ তোমাদের জন্য সেই দীনকে নির্ধারিত করেছেন, যা তিনি নূহ (আ) এর প্রতি নির্দিষ্ট করে দিয়েছিলেন। আর আমরা আপনার প্রতি যে ওহী নাযিল করেছি এবং ইব্রাহীম, মূসা ও ঈসা (আ)-এর প্রতিও নির্দেশ দিয়েছিলাম তা এই যে, এ দীনকে প্রতিষ্ঠা কর এবং তাতে মতপার্থক্য সৃষ্টি করো না। (আশ-শূরা-১৩)
জ. সংগঠন করা মহানবী (সাঃ)-এর নির্দেশ “হারিছ আল আশআরী (রা) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, আমি তোমাদেকে পাঁচটি কাজের নির্দেশ দিচ্ছি, যে বিষয়ে আল্লাহ আমাকে নির্দেশ দিয়েছেন। তা হল,
১. জামায়াতবদ্ধ হবে বা ইসলামী সংগঠন করবে,
২. নেতার কথা শুনবে,
৩. (নেতার) আনুগত্য করবে,
৪. (প্রয়োজনে) হিজরত করবে এবং
৫. আল্লাহর পথে জিহাদ করবে।
যে ব্যক্তি ইসলামী সংগঠন ছেড়ে এক বিঘত পরিমাণও দূরে সরে গেল, সে যেন নিজের গর্দান থেকে ইসলামের রজ্জুকে খুলে ফেলল। তবে সে যদি ফিরে আসে তাহলে ভিন্ন কথা। আর যে ব্যক্তি জাহেলিয়াতের দিকে অর্থাৎ মানব রচিত মতবাদের দিকে আহ্বান জানাবে সে হবে জাহান্নামে হামাগুড়ি দেয়া ব্যক্তিদের অন্তর্ভুক্ত”।
ঝ. সংগঠন ছাড়া ইসলাম নেই “হযরত ওমর ফারূক (রা) বলেন, সংগঠন ব্যতীত ইসলাম নেই, আর নেতৃত্ব ব্যতীত সংগঠন নেই এবং আনুগত্য ব্যতীত নেতৃত্ব নেই” (আসার)
ঞ. বিচ্ছিন্ন ব্যক্তি শয়তানের শিকারে পরিণত হয় “আবু দারদা (রা) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলে করীম (সাঃ) ইরশাদ করেছেন, কোন জঙ্গল অথবা জনপদে তিনজন লোকও যদি একত্রে বসবাস করে, আর তারা তখন (জামায়াতবদ্ধভাবে) নামায আদায় করার ব্যবস্থা না করে, তবে তাদের উপর অবশ্যই শয়তান প্রভুত্ব ও আধিপত্য বিস্তার করবে। অতএব তুমি অবশ্যই সংঘবদ্ধ হয়ে থাকবে। কেননা নেকড়ে বাঘ পাল থেকে বিচ্ছিন্ন ছাগল-ভেড়াকেই শিকার করে খায়।
ইসলামী সংগঠনে আনুগত্য
আনুগত্য শব্দের অর্থ: আনুগত্য শব্দটি বাংলা। এর আরবি হচ্ছে ‘এতায়াত’ এর বিপরীত হল ‘ইসইয়ান’ যার অর্থ ‘নাফরমানি’।
আনুগত্য শব্দটি অনুগত হওয়া, মান্য করা, মেনে চলা, আদেশ-নিষেধ পালন করা প্রভৃতি অর্থে ব্যবহৃত হয়। যেমন- কর্তৃপক্ষের ফরমান অনুযায়ী কাজ করা। আনুগত্য শব্দটি ৩টি বিশেষ অর্থে ব্যবহৃত হয়। যথা-
১. সংগঠনের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাওয়া।
২. কুরবানী করা। যেমন, মতের কুরবানী, অর্থের কুরবানী, সময়ের কুরবানী, শ্রমের কুরবানী, বিশ্রামের কুরবানী
৩. উচ্চতর শক্তি বা ব্যক্তির আদেশ মানা।
বাংলা ভাষায় আনুগত্য শব্দটি আরো যে যে অর্থে ব্যবহৃত হয় তা নিম্নরূপ।
আদেশ পালন করা, হুকুম তামিল করা, আজ্ঞানুবর্তিতা, তামিল করা, বাধ্যতা, অনুবর্তিতা, অনুগামিতা, গ্রাহ্য করা, আমল দেওয়া, নির্বাহ করা, প্রতিপালন, সম্পাদন, নিষ্পাদন, হাসিল করা, অনুসরণ করা, অনুসৃতি, অনুবর্তন, মান্যকরণ, মান্য করা, অলঙ্ঘন, মানিয়ে চলা ইত্যাদি।
অক্ষরে অক্ষরে পালন করা, মেনে চলা; মাথা পেতে নেওয়া, মেনে নেওয়া, শিরোধার্য করা, মাথায় তুলে নেওয়া, কথা মত চলা, মুচলেকা দেওয়া
প্রতিজ্ঞা পালন করা, কথা রাখা, বাধ্যবাধকতা, অবশ্য পালন করা, আবশ্যকতা, পালনীয়, বাধ্যতামূলক, আবশ্যিক, ধরা-বাঁধা, অবশ্য কর্তব্য, অলঙ্ঘনীয়।
পারিভাষিক অর্থে আনুগত্য: “ইসলামী শরীআতের পরিভাষায় আল্লাহ ও রাসূল (সাঃ)-কে নিরঙ্কুশভাবে মেনে নিয়ে ইসলামী সংগঠনের যাবতীয় মারূফ কাজে নিজের মতামতকে কুরবানী করে দিয়ে সন্তুষ্টচিত্তে আল্লাহ ও রাসূলের নির্দেশ মেনে চলাকে আনুগত্য বলে”।
আনুগত্যের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা
শরীরে জীবনীশক্তি না থাকলে মানুষ যেমন গতিশীলতা হারিয়ে ফেলে, তেমনিভাবে সংগঠনে আনুগত্য না থাকলে সাংগঠনিক গতিশীলতা নষ্ট হয় এবং কর্মীবাহিনী কাজের উদ্যম হারায়। ফলে সংগঠনের অভ্যন্তরে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়। মনে রাখা প্রয়োজন, সংগঠনের শৃঙ্খলার মূল উপাদান হচ্ছে আনুগত্য। যে সংগঠনে আনুগত্য নেই, সে সংগঠনে শৃঙ্খলা নেই। আর শৃঙ্খলাই যদি না থাকে, তাহলে সংগঠনে বহু লোকের ভিড় জমলেও এর কোন মূল্য হয় না। যেমনি মূল্য নেই প্রাণহীন একটি সুন্দর সুঠাম দেহের। কুরআন ও হাদীসের দৃষ্টিতে আনুগত্যের গুরুত্ব নিম্নে তুলে ধরা হল।
আল-কুরআনের আলোকে আনুগত্য
১. আনুগত্য করা ফরয, ইহা আল্লাহর নির্দেশ “হে বিশ্বাসীরা! তোমরা আল্লাহর আনুগত্য কর, রাসূলের আনুগত্য কর, আর তোমাদের মাঝে উলিল আমর বা দায়ীত্বশীল যারা তাদের আনুগত্য কর। (সূরা নিসা: ৫৯)
২. আল্লাহর ভালবাসা পাওয়ার উপায় “হে নবী! আপনি বলে দিন, তোমরা যদি আল্লাহর প্রতি ভালবাসা পোষণ কর তবে আমার আনুগত্য কর, তাহলে আল্লাহ তোমাদের ভালোবাসবেন এবং তোমাদের গুনাহ মাফ করে দেবেন, আল্লাহ পাক ক্ষমাশীল ও দয়ালু”। (আলে ইমরান: ৩১)
৩. হেদায়াত প্রাপ্তির পূর্বশর্ত “যদি তোমরা রাসূলের আনুগত্য কর তাহলে হেদায়াতে প্রাপ্ত হবে। আর রাসূলের দায়িত্ব হল শুধুমাত্র দীনের দাওয়াত সুস্পষ্টভাবে পৌঁছিয়ে দেয়া”। (সূরা নূর: ৫৪)
৪. আল্লাহর দয়া পাওয়ার উপায “এবং আল্লাহ ও রাসূলের আনগত্য কর, অর্থাৎ হুকুম মান্য কর আশা করা যায়. তোমাদের প্রতি দয়া করা হবে”। (আলে-ইমরান: ১৩২)
৫. আনুগত্য: মুমিনের কাম্য “অতঃপর আল্লাহকে ভয় কর এবং আমার আনুগত্য কর”। (সূরা শুআরা: ১৩১)
৬. আনুগত্যহীনতা আমলকে বরবাদ করে দেয় “হে বিশ্বাসীরা! তোমরা আল্লাহর আনুগত্য কর এবং রাসূলের আনুগত্য কর। মনন্তর তোমাদের আমলসমূহ বরবাদ করো না”। (সূরা মুহাম্মদ: ৩৩)
৭. সফলতার হাতিয়ার “ঐসব লোকেরাই সফলকাম যার আল্লাহ ও রাসূলের আনুগত্য করে এবং আল্লাহকে ভয় করে, এবং তাঁর নাফরমানী থেকে দূরে থাকে”। (সূরা নূর: ৫২)
৮. আল্লাহর নেয়ামত প্রাপ্ত লোকদের সঙ্গী বানায় “যে ব্যক্তি আল্লাহ ও রাসূলের আনুগত্য করবে সে ঐ সব লোকদের সঙ্গী হবে যাদের প্রতি আল্লাহ নেয়ামত দান করেছেন”। (সূরা নিসা: ৬৯)
৯. ঈমানের অপরিহার্য দাবি “ঈমানদার লোকদের বক্তব্য তো এই যে, যখন তাদেরকে আল্লাহ ও রাসূলের দিকে ডাকা হবে এজন্য যে, রাসূল (সা) তাদের মামলা মুকাদ্দামার ফয়সালা করে দিবেন, তখন তারা বলে আমরা শুনলাম ও মেনে নিলাম”। (সূরা নূর: ৫১)
১০. আনুগত্য আন্তরিকতার সাথে সুন্দর মন নিয়ে করতে হবে “হে নবী! আপনি বলে দিন, কসম খেয়ে আনুগত্য প্রমাণের কোন প্রয়োজন নেই। আনুগত্যের ব্যাপারটা তো খুবই পরিচিত ব্যাপার। নিশ্চয়ই আল্লাহ পাক তোমরা যা কিছু কর সে সম্পর্কে খবর রাখেন”। (সূরা নূর: ৫৩)
১১. আনুগত্য স্বেচ্ছায় করতে হবে “যে ব্যক্তি রাসূলের আনুগত্য করল সে আল্লাহরই আনুগত্য করল। আর যে ব্যক্তি তা হতে মুখ ফিরাল, তা যাই হোক না কেন, আমি আপনাকে তাদের উপর পাহারাদার বানিয়ে প্রেরণ করিনি”। (সূরা নিসা: ৮০)
১২. আনুগত্য সৎকাজে, অসৎ কাজে নয় “সৎকর্ম ও তাকওয়ায় তোমরা পরস্পর সহযোগিতা কর। গুনাহ ও সীমালঙ্ঘনমূলক কাজে সহযোগিতা করো না। খোদাকে ভয় কর, কেননা আল্লাহর শাস্তি অত্যন্ত কঠিন”। (মায়েদা: ২)
১৩. ব্যক্তির পরিবর্তনে আনুগত্যের পরিবর্তন করা যাবে না “মুহাম্মদ একজন রাসূল ছাড়া আর কিছুই ছিলেন না তার পূর্বেও অনেক রাসূল গত হয়েছে। এমতাবস্থায় তিনি যদি মৃত্যুবরণ করেন অথবা নিহত হন, তবে কি তোমরা উল্টো দিকে ফিরে যাবে?” (সূরা আলে ইমরান: ১৪৪ )
হাদীসের আলোকে আনুগত্য
ক. পছন্দ হোক আর না হোক আনুগত্য করা ফরয “ইবনে উমার (রা) থেকে বর্ণিত। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন প্রত্যেক মুসলমানের উপর (শাসকের নির্দেশ) শ্রবণ করা ও আনুগত্য করা অবশ্য কর্তব্য, তা তার পছন্দ হোক বা অপছন্দ হোক, যতক্ষণ পর্যন্ত না পাপাচারের আদেশ দেয়া হবে। অতঃপর পাপাচারের আদেশ দেয়া হলে তা শ্রবণ করা ও তার আনুগত্য করার কোনও অবকাশ নেই”। (বুখারী ও মুসলিম)
খ. যথাসাধ্য আনুগত্য করা ফরয “রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট আদেশ শ্রবণ করা ও আনুগত্য করার উপর বাইআত (শপথ) করতাম, তখন তিনি আমাদের বলতেন, যথাসাধ্য আনুগত্য ফরয”।
গ. আনুগত্যহীনতার পরিণাম “ইবনে উমার (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি, যে ব্যক্তি আনুগত্যের হাত সরিয়ে নেয়, কিয়ামতের দিন সে আল্লাহর সাথে এরূপ অবস্থায় মিলিত হবে যে, তার পক্ষে কোন যুক্তি থাকবে না। যে লোক এরূপ অবস্থায় মারা যাবে যে, তার ঘাড়ে আনুগত্যের বন্ধন নেই, তার মৃত্যু হবে জাহিলিয়াতের মৃত্যু”। ইমাম মুসলিম এটি বর্ণনা করেছেন। তাঁর অপর বর্ণনায় রয়েছে, যে ব্যক্তি জামাআত থেকে বিচ্ছিন্ন অবস্থায় মারা যাবে তার মৃত্যু হবে জাহিলিয়াতের মৃত্যু।
ঘ. হাবশী গোলামও যদি আমীর হয় তার আনুগত্য করে যেতে হবে “আনাস (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন তোমরা শ্রবণ কর ও আনুগত্য কর, যদিও আঙ্গুরের মত (ক্ষুদ্র) মাথাবিশিষ্ট কোন হাবশী গোলামকে তোমাদের শাসক নিয়োগ করা হয়”। (বুখারী)।
“আবু হুরায়রা (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, সুদিনে ও দুর্দিনে, সন্তুষ্টি ও অসন্তুষ্টিতে এবং তোমার অধিকার খর্ব হওয়ার ক্ষেত্রেও (বা তোমার উপর অন্যকে অগ্রাধিকার দেয়া হলেও) (শাসকের নির্দেশ শ্রবণ করা ও আনুগত্য করা তোমার জন্য অপরিহার্য”। (মুসলিম)
ঙ. বাইআতের আলোকে আনুগত্য অত্যাবশ্যক
অর্থ: আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমরা এক সফরে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে ছিলাম। আমরা এক জায়গায় যাত্রাবিরতি করলাম। আমাদের কেউ তার তাঁবু ঠিকঠাক করছিলাম, কেউ বা তীর নিক্ষেপ প্রতিযোগিতা করছিল, কেউ তার চতুষ্পাদ জন্তুর দেখাশুনায় ব্যস্ত ছিল। এমন সময় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ঘোষক ডেকে বলেন, নামাযের জন্য জমায়েত হোন। আমরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট এসে সমবেত হলাম। তিনি বলেন, আমার পূর্বে যে কোন নবীই অতিক্রান্ত হয়েছেন তাঁর জ্ঞান অনুযায়ী নিজের উম্মাতকে কল্যাণের পথ প্রদর্শন করা এবং যা তাঁর দৃষ্টিতে মন্দ বা অন্যায় তা থেকে তাদের সতর্ক করা ছিল তার অপরিহার্য কর্তব্য।
আর তোমাদের এ উম্মাতের অবস্থা এই যে, এ উম্মাতের প্রথম দিকে রয়েছে শান্তি ও সুস্থিরতা এবং শেষ দিকে ঘটবে অনেক বিপদ-মুসিবত এবং তোমরা এমন সব বিষয় ও ঘটনাবলির সম্মুখীন হবে যা হবে তোমাদের অপছন্দনীয়। আর এমন সব ফিতনার উদ্ভব হবে যার একাংশ অপর অংশকে করবে দুর্বল (আগেরটির তুলনায় পরেরটি হবে আরো ভয়াবহ)। একেকটি মুসিবত আসবে আর মুমিন বলবে, এটাই বুঝি আমাকে ধ্বংস করে ছাড়বে।
তারপর সে বিপদ কেটে যাবে। পুনরায় বিপদ-মুসিবত আসবে। তখন মুমিন বলবে, এটাই হয়তো আমার ধ্বংসের কারণ হবে। এহেন কঠিন মুহূর্তে যে ব্যক্তি জাহান্নামের আগুন থেকে দূরে থাকতে এবং জান্নাতে প্রবেশ করতে ইচ্ছুক তার জন্য অপরিহার্য হল আল্লাহ ও পরকালের উপর ঈমানাদার হিসেবে মৃত্যুবরণ করা। আর যেরূপ ব্যবহার সে পেতে আগ্রহী সেরূপ ব্যবহারই যেন লোকদের সাথে করে। কেউ যদি ইমামের নিকট বাইআত করে, তার হাতে হাত রাখে এবং তার নিকট অন্তরের আনুগত্য নিবেদন করে তাহলে যেন যথাসাধ্য তার আনুগত্য করে। যদি অপর কোন লোক ইমামের মোকাবিলায় আত্মপ্রকাশ করে, তাহলে তোমরা তার ঘাড় মটকে দিও। (মুসলিম)
চ. প্রাপ্য অধিকার না পেলেও আনুগত্য করতে হবে
“আবু হুনাইদা ওয়ায়েল ইবনে হুজর (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, সালামা ইবনে ইয়াযীদ আল-জুফী (রা) রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহ্র নবী! আমাদের উপর যদি এরূপ শাসকগোষ্ঠী ক্ষমতাসীন হয় যারা তাদের অধিকার আমাদের নিকট থেকে পুরোপুরি দাবি করবে, কিন্তু আমাদের প্রাপ্য অধিকারে বাধা দেবে, তখন আমাদের জন্য আপনার নির্দেশ কি ? এটা শুনে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলেন। সালামা পুনরায় জিজ্ঞেস করলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, তোমরা শ্রবণ করবে ও আনুগত্য করে যাবে। কারণ তাদের (পাপের) বোঝা তাদের উপর, আর তোমাদের বোঝা তোমাদের উপর”। (মুসলিম)
ছ. অন্যের হক যথারীতি আদায় করা, নিজের প্রাপ্যের আল্লাহর নিকট বলা
“আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, আমার পরে তোমরা অধিকার হরণ ও বহু অপছন্দনীয় জিনিসের সম্মুখীন হবে। সাহাবীগণ বললেন, হে আল্লাহ্র রাসূল! আমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি এরূপ পরিস্থিতির সম্মুখীন হবে তার জন্য আপনার নির্দেশ কি ? তিনি বলেন, এরূপ অবস্থায় তোমরা তোমাদের নিকট প্রাপ্য দাবি যথারীতি পরিশোধ করবে এবং তোমাদের প্রাপ্য আল্লাহ্র নিকট প্রার্থনা করবে”। (বুখারী ও মুসলিম)
জ. আমীরের আনুগত্যের মাধ্যমে আল্লাহ ও রাসূলের আনুগত্য পরিপূর্ণ হয় “আবু হুরায়রা (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যে ব্যক্তি আমার আনুগত্য করল, সে আল্লাহ্র আনুগত্য করল। যে আমার অবাধ্যতা করল, সে আল্লাহর অবাধ্যতা করল। অনুরূপ যে আমীরের আনুগত্য করল, সে আমারই আনুগত্য করল এবং যে আমীরের অবাধ্যতা করল, সে আমারই অবাধ্যতা করল”। (বুখারী ও মুসলিম)
ঝ. নেতার মধ্যে অপ্রীতিকর কিছু দেখলে ধৈর্য ধারণ করা উচিত “ইবনে আব্বাস (রা) থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, তোমাদের কেউ যদি তার নেতার মধ্যে কোন অপ্রীতিকর কিছু লক্ষ্য করে, তাহলে সে যেন ধৈর্য ধারণ করে। কারণ যে ইসলামী রাষ্ট্রশক্তি থেকে এক বিঘত পরিমাণ দূরে সরে গিয়ে মারা যায়, সে জাহিলিয়াতের মৃত্যুবরণ করে”। (বুখারী ও মুসলিম)।
ঞ. দায়ীত্বশীলকে সম্মান করা উচিত “আবু বাকরা (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি, যে ইসলামী রাষ্ট্রের প্রধানকে লাঞ্ছিত করবে, আল্লাহও তাকে লাঞ্ছিত করবেন। তিরমিযী এটি বর্ণনা করেছেন। তিনি আরো বলেছেন, এটি হাসান হাদীস।
আনুগত্যের ভিত্তি
আনুগত্যের ভিত্তি হল ঈমান ৷ এ সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা বলেন, “হে বিশ্বাসীরা! তোমরা আল্লাহর আনুগত্য কর”৷
সুতরাং আলোচ্য বাণীর মাধ্যমে একথা সুস্পষ্ট হল যে, আনুগত্যের ভিত্তি হল ঈমান। অতএব যার ঈমান যত পরিচ্ছন্ন ও নির্ভেজাল তার আনুগত্য তত পরিচ্ছন্ন ও নির্ভেজাল। যার ঈমান যত মজবুত তার আনুগত্যও তত মজবুত। অন্য কথায়, যার আনুগত্য যত পরিচ্ছন্ন ও মজবুত বুঝতে হবে তার ঈমান ততটা সুন্দর ও মজবুত।
কতিপয় অনুসরণীয় আনুগত্যের উদাহরণ
হযরত খালিদ ইবনে ওয়ালিদ (রা) হযরত ওমর ফারূক (রা)-এর নির্দেশ পেয়ে যুদ্ধ চলাকালীন অবস্থায় সেনাপতির শিরস্ত্রাণ খুলে নতুন সেনাপতির মাথায় পরিয়ে দিয়ে বীর বিক্রমে যুদ্ধ করেছিলেন, সেই দিন আমীরের নির্দেশ মেনে নিতে মুসলিম জাহানের প্রধান সেনানায়ক খালিদ (রা) কোন রিয়্যালিটি (Reality) বা বাস্তবতার কথা বলেননি বা প্রশ্নের অবতারণাও করেননি; বরং দ্বিধাহীন চিত্তে নেতার আনুগত্য করেন ৷
হযরত আবু জান্দাল (রা) মক্কার মুশরিকদের দ্বারা নির্যাতিত অবস্থায় শিকল নিয়ে হুদায়বিয়ার সন্ধিস্থলে উপস্থিত হয়ে আল্লাহর নবী ও তাঁর সাহাবীদের নিকট আশ্রয় চেয়েছিলেন। কিন্তু রাসূলে করীম (সাঃ) সন্ধি রক্ষার খাতিরে হযরত আবু জান্দাল (রা)-কে আবারও মক্কায় ফিরে যেতে নির্দেশ দিলেন। হযরত আবু জান্দাল (রা) ও উপস্থিত সাহাবায়ে কেরাম চোখের পানি ছেড়ে দিয়ে মনের কষ্ট চাপা দিয়ে সে দিন রাসূলে করীম (সাঃ)-এর নির্দেশ মেনে নিয়েছিলেন।
কাদের বা কিসের আনুগত্য করতে হবে
০ আল্লাহ, রাসূল, নেতা ৷
০ সংবিধান, ঐতিহ্য, কর্মনীতি ৷
০ প্রতিনিধি, চিঠি, সাকুর্লার, ঘোষণা।
০ সাংগঠনিক সিষ্টেম, নিয়ম শৃঙ্খলা ও সাংগঠনিক সিদ্ধান্তের।
আল্লাহ, রাসূল ও নেতার আনুগত্য
সূরা নিসার ৫৯ নং আয়াতে আল্লাহর রাসূল ও নেতার আনুগত্য করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সংবিধান ও কর্মনীতি কুরআন ও হাদীসের আলোকে ইসলামী সংগঠন পরিচালনার জন্য তৈরি করা হয়ে থাকে। আল্লাহর দীন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ইসলামী সংগঠনে যোগদানকারী প্রত্যেক ব্যক্তির তা মেনে চলা অপরিহার্য।
ইসলামী ঐতিহ্য ও কর্মনীতি:
ইসলামী আন্দোলন ও সংগঠনের ভাল কাজগুলো ঐতিহ্যে পরিণত হয়। এই ঐতিহ্য সংবিধানের মর্যাদা রাখে। যেমন- আল্লাহ তা’আলা কুরআন মজীদে বলেছেন, “তোমরা পরস্পরে কল্যাণকর ও তাকওয়ার কাজে সহযোগিতা কর”। (সূরা আলে ইমরান)
প্রতিনিধি:
দায়িত্বশীলের পক্ষ থেকে প্রেরিত প্রতিনিধি নিঃসন্দেহে দায়িত্বশীলের মত আনুগত্যের দাবি রাখে। যে ব্যক্তি সঠিকভাবে দায়িত্বশীলের আনুগত্য করে তাকে অবশ্যই তার প্রেরিত প্রতিনিধিরও আনুগত্য করতে হবে। অন্যথায় সে যে দায়িত্বশীলের আনুগত্য করল তা প্রমাণিত হবে না। এটা কুরআন হাদীস থেকে প্রমাণিত।
চিঠি, সার্কুলার, ঘোষণা, সংগঠনের সিস্টেম, সিদ্ধান্ত ও নিয়ম-শৃঙ্খলা: সংগঠনের পক্ষ থেকে প্রেরিত চিঠি, সার্কুলার এবং যে কোন ঘোষণা ততটুক আনুগত্যের দাবি রাখে যতটুকু দাবি রাখে দায়িত্বশীলের আনুগত্য করার। সংগঠন পরিচালনার System (পদ্ধতি) অনুসারে সংগঠনের যে কোন সিদ্ধান্ত ও নিয়ম শৃঙ্খলার আনুগত্য করা অবশ্যই কর্তব্য।
ক. বিভিন্ন দায়িত্বশীল ব্যক্তির পক্ষ থেকে যে সমস্ত সার্কুলার ও নির্দেশনামা জারি করা হয় সাধারণত এই সার্কুলার ও নির্দেশগুলোকে সম্ভবত অফিস-আদালতের মামুলি সার্কুলার মনে করা হয়। অথচ যখনই কোন সার্কুলার জারি করা হয় তার অবস্থা হয় ঠিক ‘আমর বিল মারূফ’ (সৎকর্মের আদেশ দান) এর সমতুল্য।
খ. সভায় উপস্থিতির জন্য যে সময় নির্ধারণ করা হয়, কোন ডিউটিতে পৌঁছার জন্য যে সময়-কাল স্থিরীকৃত হয়, অনুরূপভাবে কোন সংবাদ বা রিপোর্ট পৌঁছাবার বা কোন হুকুম তামিল করার জন্য যে পদ্ধতি বা সময় নির্ধারিত হয়, তা যথাযথ মেনে চলার যোগ্যতা এখনো আমাদের মধ্যে সৃষ্টি হয়নি।
গ. কর্তৃত্ব ও শৃঙ্খলা ব্যবস্থার আনুগত্যে ত্রুটি-বিচ্যুতি যে একটি গোনাহর শামিল। মনে রাখতে হবে, আমাদের কে সর্বশক্তিমান আল্লাহর কাছে আমাদেরকে জবাবদিহি করতে হবে। এ ধরনের ত্রুটি সম্পর্কে কৈফিয়ত তলব করলে সহযোগীরা কিছুটা লজ্জিত হয় ঠিকই, তবে এজন্য তাদের মধ্যে সাধারণভাবে যে ধরনের গোনাহর অনুভূতি সৃষ্টি হওয়া দরকার তা হয় না। দলীয় শৃঙ্খলার আনুগত্যে ত্রুটি করা- মিথ্যা বলা, কাউকে গালি দেওয়া, ওয়াদা ভঙ্গ করা, কারো অধিকার আত্মসাৎ করা, চুরি করা, গীবত করা, মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়া এবং এ ধরনের অন্যান্য বড় বড় অপরাধের চাইতে কম পর্যায়ের নয়। এই বিষয়টি অন্তরে জাগরুক করা।
আনুগত্য করার পূর্বশর্ত
১. কুরআন হাদীসে আনুগত্য করার পূর্বে মনোযোগ দিয়ে শ্রবণ করাকে অপরিহার্য করে দিয়েছে। মহান আল্লাহ তাআলা বলেন,
“ঈমানদার লোকদেরকে যখন তাদেরকে পারস্পরে দ্বান্দ্বিক বিষয়ে বিচার-ফয়সালার জন্যে আল্লাহ তাআলা ও তাঁর রাসূলের দিকে আহ্বান জানানো হয়, তখন (খুশি মনেই) তারা বলে, হাঁ আমরা (আল্লাহ তাআলা ও তাঁর রাসূলের আদেশ) শুনলাম”। (সূরা নূর: ৫১)
২. দায়িত্বশীলদের প্রতি আস্থা রাখা, সম্মান ও শ্রদ্ধাবোধের সাথে আনুগত্য করা।
৩. ভালবাসা, দরদ ও আন্তরিকতা পোষণ করা৷
৪. কল্যাণ কামনা করা। রাসূলে করীম (সাঃ) বলেন, দীন হল কল্যাণ কামনা করা
৫. আনুগত্যে ভারসাম্য রক্ষা করা।
৬. স্বতঃস্ফূর্তভাবে আনুগত্য করার মন তৈরি করা
৭. কৃত্রিমতা ও আনুষ্ঠনিকতা পরিহার করা
আনুগত্যের ক্ষেত্রে মানুষের অবস্থা
ক. সুযোগ পেলে আনুগত্য করে অন্যথায় ফাঁকি দেওয়ার চেষ্টা করে, যা সচরাচর আমরা দেখতে পাই।
খ. বিপদে পড়ে বা দায়ে পড়ে আনুগত্য করা। অনেক কে দেখা যায় যে, ব্যক্তির আদেশের আনুগত্য করার কোন ইচ্ছা তার নেই। পরিস্থিতির কারণে বিপদে পড়ে মনের বিরুদ্ধে আনুগত্য করে যাচ্ছে।
গ. আবেগ তাড়িত আনুগত্য। অনেকে আবার আবেগের বশবর্তী হয়ে হঠাৎ করে নেতার নির্দেশে জীবন দিয়ে দেওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়ে যায়; কিন্তু আবেগ বিদায় নিলে আনুগত্যও বিদায় নেয়।
আনুগত্যের ক্ষেত্রে মুমিনের অবস্থা
একজন মুমিন নিরেট আল্লাহ পাকের সন্তুষ্টি অর্জনের জন্যই নেতার নির্দেশ মেনে চলবেন; বিপদে পড়ে বা আবেগ তাড়িত হয়ে নয়, বরং বুঝে শুনে পূর্ণ নিষ্ঠা ও আন্তরিকতা সহকারে আনুগত্য করবেন। আনুগত্য করার ক্ষেত্রে মুমিনের কি অবস্থা হওয়া দরকার তা নিম্নে উল্লেখ করা হল।
ক. নির্ভেজাল আনুগত্য করবে।
খ. আগ্রহ ও আন্তরিকতার সাথে আনুগত্য করতে হবে।
গ. আমাদেরকে সন্তুষ্টচিত্তে আনুগত্য করার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে।
ঘ. দুঃসময় ও সুসময় উভয় অবস্থাতেই আনুগত্য করতে হবে। এই মর্মে হাদীসে এসেছে যে,
“সহজ অবস্থায় ও কঠিন অবস্থায় এবং সন্তুষ্টচিত্তে ও অসন্তুষ্টচিত্তে সর্বাবস্থায় আনুগত্য করতে হবে”। (সহীহ মুসলিম)
ঙ. ওযর আপত্তি পেশ করে দায়িত্বশীলকে বেকায়দায় ফেলা যাবে না। তবে এক্ষেত্রে,
১. কর্মীর দায়িত্ব হল নিজের সমস্যার চাইতে সংগঠনকে গুরুত্ব দেওয়া।
২. আর নেতার দায়িত্ব হচ্ছে কর্মীর সমস্যাকে প্রাধান্য দেওয়া।
নিম্নে বর্ণিত মহাগ্রন্থ আল কুরআনের আয়াতসমূহের দিকে তাকালে তা আমাদের নিকট সুস্পষ্ট হয়ে উঠে।
“যারা আল্লাহর প্রতি এবং আখেরাতের প্রতি বিশ্বাস রাখে তারা জান ও মাল দিয়ে জিহাদ করা থেকে বিরত থাকতে তোমার অনুমতি চায়। আল্লাহ খোদাভীরু লোকদের সম্পর্কে অবগত আছেন। (সূরা তাওবা- ৪৪)
আনুগত্যের সীমা
আনুগত্যের মূল হকদার হচ্ছেন আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা। দ্বিতীয় হকদার হচ্ছেন আল্লাহর রাসূল (সাঃ)। আর তৃতীয় অধিকারী হচ্ছেন সংগঠনের আমীর। আল্লাহ ও রাসূলের আনুগত্য হবে নিঃশর্ত। অর্থাৎ কোন বিষয়ে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের নির্দেশ কি তা জানার পর বিনা দ্বিধায় তা পালন করাই মুমিনের কর্তব্য। আমীরের নির্দেশ যদি আল্লাহ ও রাসূলের নিদশের সাথে সাংঘর্ষিক না হয়, তাহলে তা পূর্ণ আন্তরিকতা সহকারে পালন করতে হবে। আনুগত্য করা না করাটা কোন সখের বিষয় নয়। ইচ্ছা হলে মানলাম অন্যথায় পরিহার করলাম।
আমীরের আনুগত্যের ব্যাপারে আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (সাঃ) যে সীমা নির্ধারণ করে দিয়েছেন তা নিম্নরূপ,
১. সৎ কাজে আনুগত্য, অসৎ কাজে নয়: আল্লাহ বলেন, “খোদাভীতি ও নেকীর কাজে পরস্পর পরস্পরকে সহযোগিতা কর। গুনাহ ও সীমালঙ্ঘনমূলক কাজে সহযোগিতা করো না”। (মায়েদা: ২)
২. সীমালঙ্ঘনমূলক কাজে আনুগত্য না করা: রাসূল (সাঃ) বলেন, “স্রষ্টার অবাধ্য হয়ে সৃষ্টির আনুগত্য করা যাবে না”। (বুখারী)
হযরত আলী (রা) বলেন, নবী করীম (সাঃ) বলেছেন, গোনাহের কাজে কোন আনুগত্য নেই। আনুগত্য শুধু নেক কাজের ব্যাপারে। (বুখারী, মুসলিম)
আনুগত্যের ক্ষেত্রে বর্জনীয়
যে সব কাজ আনুগত্যের পরিবেশকে বিঘ্নিত করে এবং ব্যক্তিকে সঠিকভাবে আনুগত্য করা থেকে বিরত (মাহরূম) রাখে, একজন সচেতন মুমিনকে অবশ্যই সেসব কাজ থেকে বিরত থাকতে হবে। এ কাজগুলো প্রথমে আনুগত্য করা থেকে কাউকে বিরত রাখে না বটে, কিন্তু সুন্দর আন্তরিক আনুগত্য করার পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়।
ক. খিটখিটে মেজাজ পরিত্যাগ করতে হবে: আমীর বা দায়িত্বশীলদের পক্ষ থেকে কোন নির্দেশ এসে গেলে তা মনঃপূত না হলে বা কষ্টদায়ক অনুভূত হলে অথবা নিজের জন্য ক্ষতিকর মনে হলে তখন কারো কারো মেজাজ এতটা অস্বাভাবিক হয়ে যায়, যেমনটি পরিলক্ষিত হয় ফুটন্ত তেলে পানির ফোঁটা পড়লে। আল্লাহর জান্নাত প্রত্যাশী একজন মুমিনকে অবশ্যই ঐ অবস্থায় পড়া থেকে নিজেকে মুক্ত রাখতে হবে।
খ. তর্ক-বিতর্ক পরিহার করতে হবে: তর্ক-বিতর্ক, ঝগড়া-ঝাটি কোন সমস্যার সুষ্ঠ সমাধান দিতে পারে না। তর্ক-বিতর্ক অনেক সময় মানুষের মেজাজের ভারসাম্য নষ্ট করে এবং বিবেক অনুযায়ী চলতে বাধাগ্রস্ত করে। অত্যন্ত দুঃখজনক হলেও বলতে হয় যে, অনেকেই আমীরের সাথে বা দায়িত্বশীলদের সাথে তর্ক-বিতর্ক করা বা তর্কে জড়িয়ে পড়াকে সাহসিকতার কাজ মনে করে।
রাসূল (সাঃ) বলেছেন, “যারা নির্দেশ দেওয়ার অধিকার রাখে (সাহেবে আমর) তাদের সাথে বিতর্কে জড়াবে না”। (বুখারী ও মুসলিম) মনে রাখতে হবে দায়িত্বশীলদের সাথে তর্ক করা জায়েয নয়।
গ. সংবাদদাতার কাছে রাগ প্রকাশ করা যাবে না: অনেক সময় দেখা যায়, সাংগঠনিক কোন কারণে দায়িত্বশীল কোন ভাইয়ের নিকট এই মর্মে খবর দেওয়া হল যে, অমুক কাজটি তাড়াতাড়ি করতে হবে বা অমুক জায়গায় যেতে হবে। বাহকের সংবাদটি পাওয়ার পর কেউ কেউ তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন, আবার কেউ রাগ প্রকাশ করে বলেন, উনার (দায়িত্বশীলের) তো অভ্যাস হল যখন তখন কাউকে ডেকে বসা, কাজের নির্দেশ দেওয়া ইত্যাদি। আমরা ব্যস্ত মানুষ, যখন তখন যে কোন কাজ করা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়, দায়িত্বশীলদেরকে এগুলো বুঝা উচিত। এটা করা অনুচিত এবং এটা ইসলাম না বুঝার নামান্তর। পক্ষান্তরে, অনেকে আবার রাগ ঠাণ্ডা হলে দায়িত্বশীলের সেই নির্দেশ পালন করতে যান এই চিন্তা করে যে, যা হোক দায়িত্বশীল যখন বলেছে, তখন কষ্ট হলেও করি।
কিসে আনুগত্য নষ্ট করে?
আনুগত্যের মত একটি গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশ মানা থেকে যে সমস্ত বিষয় বাধা দেয় এখন আমরা সে বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করব।
১. আখেরাতের তুলনায় দুনিয়াকে অগ্রাধিকার দেওয়া: যারা দুনিয়াকে আখেরাতের তুলনায় অগ্রাধিকার দিয়েছে তাদের দ্বারা নিরঙ্কুশ, নির্ভেজাল, আন্তরিকতাপূর্ণ আনুগত্য করা কিছুতেই সম্ভব নয়। আসলে যারা মুমিন তারা তাদের সকল চাওয়া-পাওয়া, মতামত, চিন্তা-চেতনাকে ও আল্লাহর সন্তুষ্টি ও তার জান্নাতের বিনিময়ে কুরবানী করে দিয়েছে।
আল্লাহ বলেন, “নিশ্চয়ই আল্লাহ পাক মুমিনদের জান ও মাল জান্নাতের বিনিময়ে ক্রয় করে নিয়েছেন”। (তওবা: ১১১)
“সে সব ব্যক্তিদের আল্লাহ্র রাস্তায় সংগ্রাম করতে হবে যারা আখেরাতের বিনিময়ে দুনিয়ার জীবনকে বিক্রয় করে দিতে সক্ষম হয়েছে”। (সূরা নিসা: ৭৪)
২. আনুগত্যের গুরুত্ব সম্পর্কে অজ্ঞ থাকা: অনেক সময় দেখা যায়, কর্মীদের আনুগত্যের গুরুত্ব, সীমা ও পরিধি সম্পর্কে পবিত্র কুরআন ও হাদীসের আলোকে পর্যাপ্ত জ্ঞান না থাকায় কর্মীবাহিনী যথাযথ আনুগত্য করতে পারে না। এজন্যে আনুগত্য সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা থাকা প্রত্যেক কর্মী ও দায়িত্বশীলের একান্ত কর্তব্য।
৩. গর্ব-অহঙ্কার মুক্ত থাকা: অহঙ্কারী ব্যক্তি কখনো কারো আনুগত্য করতে পারে না ৷ বিনয়-নম্রতা নবীগণের চরিত্র। বিনয় ও নম্রতা সফলতা এনে দেয়। শয়তান অহঙ্কার করেই আল্লাহর নির্দেশ অমান্য করেছিল।
কুরআনের ভাষায়, “সে অস্বীকার করল এবং অহঙ্কার করল”। (সূরা বাকারা: ৩৪)
“নিশ্চয়ই আল্লাহ পাক স্বঘোষিত অহঙ্কারীকে ভালবাসেন না”। (সূরা লুকমান: ১৮)
৪. হিংসা-বিদ্বেষ: হিংসা-বিদ্বেষ বা পরশ্রীকাতরতা এক জঘন্য ব্যাধি। এ ব্যাধিটা যদি মানুষের মনে একবার ঠাঁই পায় তাহলে আন্তরিক সম্পর্কই শুধু ছিন্ন হয় না, লোকদের ঈমানও বিপন্ন হয়ে পড়ে। হিংসার মূলে থাকে কখনো বিদ্বেষ ও শত্রুতা, কখনো ব্যক্তিগত অহমিকা, আবার কখনো অপরের সম্পর্কে হীনম্মন্যতা বোধ ৷ কখনো অন্যকে অনুগত বানানোর প্রেরণা, কখনো কোন সম্মিলিত কাজে নিজের ব্যর্থতা ও অপরের সাফল্য লাভ, আবার কখনো শুধু মান-ইজ্জত লাভের আকাঙ্ক্ষাই এর কারণ হয়ে দাঁড়ায়। কোন ব্যক্তি হিংসা নামক এই মারাত্মক রোগে আক্রান্ত হলে সে আনুগত্য থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়।
নবী করীম (সাঃ) বলেছেন, “তোমরা হিংসা থেকে বেঁচে থাক। কেননা আগুন যেমনিভাবে লাকড়িকে খেয়ে ফেলে, হিংসা তেমনিভাবে নেকী ও পুণ্য খেয়ে ফেলে”। (আবু দাউদ)
৫. সিনিয়রিটি জুনিয়রিটি মনোভাব: এ মনোভাবটি শয়তানের আরেক চক্রান্তের নাম। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কেউ কারো সিনিয়র হলে, ইসলামী আন্দোলন বা সংগঠনে যোগদানের দিক থেকে সিনিয়র হলে, ডিগ্রি নেওয়ার দিক থেকে সিনিয়র হলে, বয়সের দিক থেকে সিনিয়র হলে, দায়িত্ব পালনের দিক থেকে এককালে সিনিয়র থাকলে, কোন জায়গায়, প্রতিষ্ঠানে বা দেশে অবস্থানের দিক থেকে সিনিয়র হলে, অপেক্ষাকৃত জুনিয়র ব্যক্তিটি দায়িত্বশীল হলে সিনিয়র ব্যক্তিদের আনুগত্য করার ক্ষেত্রে সমস্যার সৃষ্টি হয়। আর এ সমস্যা সৃষ্টির খলনায়ক হল শয়তান। আমরা কি শয়তানের প্ররোচনায় আনুগত্য থেকে মুখ ফিরিয়ে নেব?
রাসূলে করীম (সাঃ) ১৭/১৮ বছরের যুবক উসামা (রা)-কে এক যুদ্ধের সেনাপতি বানিয়ে হযরত আবু বকর (রা), হযরত ওমর (রা)সহ বড় বড় সাহাবীকে তাঁর অধীনে যুদ্ধ করার জন্য পাঠিয়েছিলেন। কই সেদিন তো সিনিয়র সাহাবীগণ কোন প্রশ্ন তুলেননি; বরং আনুগত্যের পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করে গেছেন।
৬. মেজাজের ভারসাম্যহীনতা: যাদের মধ্যে মেজাজের ভারসাম্য নেই তারাও সঠিকভাবে আনুগত্য করতে পারে না। এ ব্যাপারে মাওলানা মওদূদী (র) বলেন, “মেজাজের ভারসাম্যহীনতার প্রধানতম প্রকাশ হচ্ছে মানুষের একগুঁয়েমি। এ রোগে আক্রান্ত হবার পর মানুষ সাধারণত প্রত্যেক বস্তুর এক দিক দেখে, অপর দিক দেখে না। প্রত্যেক বিষয়ের এক দিককে গুরুত্ব দেয়, অন্য দিককে গুরুত্ব দেয় না। যেই দিকে তার মন একবার পাড়ি জমায় সে দিকেই অগ্রসর হতে থাকে। অন্যদিকে নজর দিতে প্রস্তুত হয় না।
৭. পদের প্রতি লোভ: পদের প্রতি লোভী ব্যক্তি আনুগত্য করার ক্ষেত্রে ছল চাতুরীর আশ্রয় গ্রহণ করে। এ রোগে আক্রান্ত ব্যক্তি পরোক্ষভাবে নেতৃত্বের পদে আসীন হবার সর্বাত্মক চেষ্টা করে, যা তার কথাবার্তায়, আচার-আচরণে ও সমালোচনায় বুঝা যায়। রাসূলে করীম (সাঃ) বলেন,
“আল্লাহর শপথ! আমরা এমন কোন লোকের উপর এই কাজের দায়িত্ব অর্পণ করবো না, যে এর প্রার্থী হয়, অথবা এর আকাঙ্ক্ষা পোষণ করে”। (বুখারী ও মুসলিম)
৮. দায়িত্বশীল পছন্দ না হলে: অনেকে পছন্দ অপছন্দের মাপকাঠিতে আনুগত্য করতে চায়, যা ইসলামী শরীআতে নাজায়েয। কে দায়িত্বশীল, দেখতে কেমন, কতটুকু লেখাপড়া জানে, যোগ্যতা কতটুকু, বক্তা হিসেবে কেমন, কোন পরিবারের, প্রভাব প্রতিপত্তি আছে কিনা, চেহারা-সুরত কেমন, মানানসই কিনা, রাজনৈতিক প্রজ্ঞা আছে কিনা, কোন এলাকার এই জাতীয় বিষয়গুলো সামনে রেখে যারা দায়িত্বশীলের আনুগত্য করতে চায়। তাদের এই আনুগত্যের দুই পয়সা মূল্য আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের নিকট নেই। রাসূল (সাঃ) বলেছেন,
“তোমরা আদেশ নিষেধ শোন এবং আনুগত্য কর যদিও তোমাদের উপর কোন হাবশী গোলামকেও শাসক নিয়োগ করা হয়”। (সহীহ মুসলিম)
৯. মান উন্নয়নে বিলম্ব হওয়া: সকলেই চায় সাংগঠনিকভাবে তার মান উন্নয়ন হোক। দায়িত্বশীলেরাও এ ব্যাপারে তাগিদ দিতে থাকেন। কিন্তু কোন ভাই যদি বারবার চেষ্টা করেও নিজের মান উন্নয়ন করতে না পারেন বা ঐ ভাইয়ের মান উন্নয়ন করা না হয়, তখন তিনি নিষ্ক্রিয়তার পরিচয় দেন। আবার কেউ কেউ যোগ্যতাসম্পন্ন, অন্যদেশে বা অন্য জায়গায় ইসলামী সংগঠনের উঁচু মানের জনশক্তি ছিলেন। আবার অনেকে বড় দায়িত্বশীল ছিলেন, নতুন জায়গায় বা দেশে এসেও সক্রিয় আছেন; কিন্তু মান উন্নয়নে বিলম্ব ঘটলে পরে নানা অভিযোগ ও কথাবার্তা শুরু করে দেন। এবং এক সময় তা নিষ্ক্রিয়তার ও আনুগত্যহীনতার পর্যায়ে চলে আসে। এক্ষেত্রে আপনি ধৈর্যহারা হবেন না, সংগঠনের সিষ্টেমের সিদ্ধান্তের প্রতি পূর্ণ আনুগত্যশীল থাকুন। মান উন্নয়নে বিলম্ব হলেও আপনি যে রবের উদ্দেশ্যে কাজ করছেন, তাঁর নিকট পরিপূর্ণ প্রতিদান পাবেন।
১০. দায়িত্বশীলদের সাথে সম্পর্কের তিক্ততা: কোন দায়িত্বশীলের সাথে সম্পর্কের অবনতি ঘটলে তখন আনুগত্য করতে নারাজ হয়ে যান অনেকে। দায়িত্বশীল নিজের অধিকার পুরোপুরি আদায় করে; কিন্তু অন্যদের অধিকারের ব্যাপারে নজর দেয় না। এ অবস্থায় আমাদের কী করণীয়- আসুন নিম্নোক্ত হাদীস শরীফ থেকে সে শিক্ষা গ্রহণ করি।
অর্থাৎ হযরত সালামাহ ইবনে ইয়াযীদ জু’ফী (রা) রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে জিজ্ঞেস করেছিলেন, হে আল্লাহর রাসূল (সাঃ)! আমাদের উপর যখন এমন সব আমীর ক্ষমতায় আসীন হবে যারা তাদের অধিকার আমাদের নিকট থেকে পুরোপুরি আদায় করে নিতে চাইবে এবং আমাদের অধিকার থেকে আমাদেরকে প্রতিহত করে, তখন আমরা কী করবো? রাসূল (সাঃ) তার প্রতি নজর দিলেন না। সালামাহ আবার জিজ্ঞেস করলেন রাসূল (সাঃ) বললেন, তোমরা শ্রবণ করবে ও আনুগত্য করে যাবে। কারণ তাদের বোঝা তাদের উপর, তোমাদের বোঝা তোমাদের উপর। (সহীহ মুসলিম)
১১. সন্দেহ প্রবণতা: “সাবধান! সন্দেহ প্রবণতা থেকে বেঁচে থাক। নিশ্চয়ই সন্দেহ প্রবণতা বা ধারণা হচ্ছে নিকৃষ্টতম মিথ্যা কথা”। (বুখারী ও মুসলিম)
১২. মতামতের কুরবানী করতে না পারা: “আবু হোরায়রা (রা) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন রাসূল (সাঃ) বলেছেন, তিনটি জিনিস হচ্ছে ধ্বংসকারী”
ক. এমন কামনা বাসনা নিমজ্জিত হওয়া মানুষ যার আনুগত্য দাস হয়ে যায়।
খ. এমন লোভ লালসা, যার বশ্যতা স্বীকার করে নেওয়া হয় এবং
গ. নিজেকে নিয়ে মানুষের আত্মপ্রসাদ লাভ করা। এটিই হচ্ছে সর্বাধিক ভয়াবহ। (ইনতিখাবে হাদীস: ১২৩ )
১৩. হৃদয়ের বক্রতা: বক্র হৃদয়ের অধিকারী ব্যক্তি সহজে আনুগত্য স্বীকার করতে পারে না। হৃদয়ের বক্রতা যা সাধারণত সৃষ্টি হয়ে থাকে দায়িত্ব এড়ানোর কৌশল স্বরূপ নানারূপ জটিল প্রশ্ন তোলার বা সমস্যার সৃষ্টির মাধ্যমে। হৃদয়ের বক্রতা থেকে মুক্ত থাকতে আল্লাহ দোয়া করতে বলেছেন,
“হে আমাদের রব! একবার হেদায়েত দানের পর তুমি আমাদের হৃদয়কে বাঁকা করে দিও না। তোমার পক্ষ থেকে আমাদের জন্য খাস রহমত দান কর, তুমি তো অতিশয় দাতা ও দয়ালু”। (আলে ইমরান: ৮)
১৪. মাত্রাতিরিক্ত প্রশ্ন: একবার রাসূলে করীম (সাঃ) সাহাবীগণের মধ্যে এই প্রবণতা লক্ষ্য করে সতর্কবাণী উচ্চারণ করে বললেন, “বেশি বেশি প্রশ্ন করো না। তোমাদের পূর্ববর্তী অনেক জাতি অতিরিক্ত প্রশ্ন করার কারণে ধ্বংস হয়ে গেছে”।
১৫. বন্ধু-বান্ধবদের দাবি পূরণ করতে গেলে আনুগত্যের পথে অন্তরায় সৃষ্টি হয়।
১৬. পরিবার পরিজনের চাপ।
১৭. নিজেকে অতীব যোগ্য মনে করা: এটা একটি শয়তানী রোগ, যমনি খোদ শয়তান আল্লাহর সাথে করেছিল
“আমি আদমের চাইতে উত্তম, কারণ আমাকে তুমি জ্বলন্ত অগ্নি থেকে তৈরি করেছ, আর তাকে কাদা মাটি থেকে সৃষ্টি করেছ”। (সূরা আ’রাফ: ১২)
১৮. সুযোগ সন্ধানী ও সুবিধাবাদী মন-মানসিকতা: সুযোগ সন্ধানী ও সুবিধাবাদী, মানসিকতার লোকেরা বস্তুবাদী চিন্তা লালন করে এবং সকল ক্ষেত্রে জাগতিক লাভ ক্ষতির হিসাব-নিকাশ করে থাকে। যা পরিণামে আনুগত্যহীনতার জন্ম দেয়।
আনুগত্য পেতে হলে দায়িত্বশীলদের করণীয়
১. কর্মীদের সাথে ইনসাফপূর্ণ আচরণ করা: এ বিষয়ে অত্যন্ত যুক্তিপূর্ণ আলোচনা করা হয়েছে ‘ইসলামী সংগঠন’ নামক বইতে। যেমন, একটি দলে নানা রকমের মানুষ থাকে। কর্ম-ক্ষমতা, বুদ্ধিমত্তা এবং দৈহিক সৌন্দর্যের দিক থেকে এদের মাঝে অনেক পার্থক্য। এ সব পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও যারা আল্লাহর সন্তোষ অর্জনের জন্য তাদের শক্তি-সামর্থ্য নিয়োজিত করার জন্য এগিয়ে আসে তাদের সবার অধিকার সমান। কালো, কুৎসিত, কম বুদ্ধিমান, প্রতিভাহীন বা বলহীন হওয়ার কারণে নেতা যদি কর্মীকে হেয় জ্ঞান করেন, তাহলে তো তিনি বড় রকমের অপরাধই করে বসেন। আবার সুদর্শন, বলবান, বেশি প্রতিভাবান হওয়ার কারণে তিনি যদি কারো প্রতি অতিশয় অনুরাগী হন, তাহলে তিনি দলের মৃত্যুঘণ্টা বাজাতে শুরু করেন।
২. জনশক্তিকে কুরআন সুন্নাহ হতে সংগঠন বুঝতে প্রেরণা দেওয়া; বুঝের ঘাটতি থাকলে তাদের দ্বারা সংগঠনের ক্ষতি হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তাই এ ধরনের লোকদেরকে কুরআন হাদীস থেকে সংগঠন বুঝার জন্য অনুপ্রাণিত করা উচিত। সেজন্যে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা জরুরি।
আল্লাহ পাক বলেন, “তারা কি সমান হতে পারে? যারা জানে, আর যারা জানে না”। (সূরা যুমার: ৯)
৩. কর্মীদের প্রতি নম্র, কোমল ও রহমদিল হওয়া: কোমল ব্যবহার নেতা ও কর্মীদের মাঝে সম্পর্ক গভীর করে, জনশক্তিকে চুম্বকের মত দায়িত্বশীলের কাছে আনে এবং তারা হৃদয় মন থেকে আনুগত্য করে। রাসূলে করিম (সাঃ) বলেন, যে ব্যক্তি রহমত থেকে শূন্য, তার প্রতি রহম করা হয় না।। দায়ীত্বশীলদেরকে রূঢ়তা, কঠোরতা তাচ্ছিল্য ও নির্লিপ্ততা ইত্যাদি পীড়াদায়ক ও হৃদয়বিদারক আচরণের পরিবর্তে কর্মীদের সাথে নম্রতা শিষ্টতা, সৌজন্য ও প্রিয়ভাষীর পরিচয় দিতে হবে। নম্র ব্যক্তি সম্পর্কে রাসূলে করিম (সাঃ) বলেন,
“আমি তোমাদেরকে এমন এক ব্যক্তির কথা বলে দিচ্ছি যার ওপর জাহান্নামের আগুন হারাম এবং সেও জাহান্নামের ওপর হারাম। এ লোকটি নম্র মেজাজ, নম্র প্রকৃতির ও নম্রভাষী”। (আহমদ তিরমিযী, ইবনে মাসউদ রা.)
৪. অধস্তন ভাইদের দোষত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখা: কুরআনের মাধ্যমে কর্তৃত্বশীলদের শিক্ষা দেওয়া হয়েছে যে, তোমরা নিজের সহযোগীদের দুর্বলতাগুলো দেখো এবং সেগুলো মাফ করে দাও। আল্লাহ পাক ক্ষমা করে দেওয়াকে বড় সাহসের কাজ বলে উল্লেখ করেছেন,
“যে ব্যক্তি সবর করলো এবং ক্ষমা করে দিলো এতো এক বিরাট সাহসের কাজ (করলো)”। (সূরা আশ-শূরা:৪৩)
৫. সহযোগীদের সাথে পরামর্শ করে কাজ করা: আল্লাহ তাআলা পরামর্শ করে কাজ করার নির্দেশ দিয়েছেন (সূরা শূরা: ৩৮)। তবে অবশ্যই সকলকেই পরামর্শ দেওয়া-নেওয়ার নিয়মনীতির প্রতি কঠোরভাবে নজর রাখতে হবে। অন্যথায় এর সকল ফায়দাই নষ্ট হয়ে যাবে। এ সংক্রান্ত আলোচনা ‘পরামর্শ’ বিষয়ে উল্লেখ করা হবে ইনশাল্লাহ।
৬. সাংগঠনিকভাবে কোন সিদ্ধান্ত গৃহীত হলে তার উপর অটল থাকা: কোন সিদ্ধান্ত গৃহীত হওয়ার পরও মতবিরোধের সম্মুখীন হতে হয়। অনবরত নতুন নতুন পরামর্শ ও মতামত আসতে থাকে। কিন্তু স্থিরকৃত সিদ্ধান্ত বারবার রদবদল করলে সাফল্য অর্জন করা যায় না; বরং উল্টো দায়িত্বশীলের মনে চিন্তার নৈরাজ্য সৃষ্টি হয়, কর্মীদের আস্থার ঘাটতি আসে।
৭. কর্মী ভাইদের জন্য দোয়া করা এবং পরস্পর দোয়ার পরিবেশ তৈরি করা: বিশ্বনবী দোয়ার এক অনুপম পরিবেশন তৈরি করতে উৎসাহ দিতে গিয়ে বলেন, তোমাদের নেতাদের মধ্যে তারাই উত্তম নেতা, যাদের তোমরা ভালবাসো এবং তারাও তোমাদেরকে ভালবাসে; যাদের জন্য তোমরা দোয়া কর আর তোমাদের জন্যও তারা দোয়া করে। (মুসলিম)
দায়িত্বশীলদের মাঝে অনাকাঙ্ক্ষিত কিছু দেখলে করণীয়:
কারো উপর কোন দায়িত্ব অর্পণ করা মানে হল ছুরি বিহীন জবাই করার শামিল। যাদের উপর দায়িত্ব অর্পিত হয় অর্থাৎ যারা দায়িত্বশীল তারা মযলুম। তাদের উপর দায়িত্ব দিয়ে এক অর্থে যুলুম করা হয়েছে। যার কারণে কুরআন-হাদীসে দায়িত্বশীলদেরকে সাহায্য-সহযোগিতা করা, তাদের জন্য দোয়া করা, তাদের সাথে ‘লেগে থাকা ও আনুগত্য করাকে অপরিহার্য করে দেওয়া হয়েছে প্রত্যেক মুমিনের জন্য।
আমরা সকলেই আশা করি, আমাদের দায়িত্বশীলগণ সকল দিক থেকে আমাদের প্রেরণার উৎস হোক, পূত-পবিত্র থাকুক, আমল-আখলাক, আচার-আচরণে, কথা-বার্তায়, লেন-দেনে, উঠা-বসায়, মেলামেশাতে, আমানতদারিতে, ওয়াদা রক্ষায়, ইবাদত বন্দেগীতে সকলের উচ্চে থাকুক, সকলের শীর্ষে অবস্থান করুক, সকলের নিকট দৃষ্টান্ত হয়ে থাকুক। হ্যাঁ এটা সবাই কামনা করে এবং এটা হওয়াও উচিত। দায়িত্বশীলদেরকেও সেই মানে উন্নীত হওয়ার চেষ্টা করা প্রয়োজন। আমরা বিশ্বাস করি যে, আমাদের দায়িত্বশীলগণ এজন্য চেষ্টা করে থাকেন।
তবে কথা হল, দায়িত্বশীলগণ যে আমাদের মতই মানুষ, আমাদেরকে এ কথা ভুলে গেলে চলবে না। আমাদের যেমন ভুল হয়, তাদেরও ভুল হতে পারে। এই ভুল হওয়াকে কেউ কেউ মেনে নিতে পারেন না, বরদাশত করতে পারেন না। যার কারণে অনেককেই ইসলামী আন্দোলন থেকে নিষ্ক্রিয় হতে দেখা যায় যা মোটেই গ্রহণযোগ্য নয়। তাহলে আমাদের করণীয় কি হবে? আসুন না দেখি প্রিয় নবীজী আমাদেরকে এ ব্যাপারে কি হেদায়াত দিয়েছেন। রাসূলে করীম (সাঃ) ইরশাদ করেছেন,
“তোমাদের কেউ যদি তার আমীর বা দায়িত্বশীলের মধ্যে কোনরূপ অপ্রীতিকর বা অপছন্দনীয় বিষয় লক্ষ্য করে, তবে সে যেন সবর করে”। (বুখারী ও মুসলিম)
অন্য হাদীসে প্রিয় নবীজী বলেন। “আবদুল্লাহ ইবনে উমার (রা) হতে বর্ণিত, রাসূল (সাঃ) ইরশাদ করেছেন, কোন মুসলিম ক্ষমতাশীন ব্যক্তি যে পর্যন্ত না কোন পাপকার্যের আদেশ করবে, সে পর্যন্ত তার আদেশ শোনা ও মেনে নেওয়া প্রত্যেক মুসলমানের অবশ্য কর্তব্য, তা তার পছন্দ হোক বা নাই হোক”। (বুখারী, মুসলিম)
তাহলে দায়িত্বশীলদের মাঝে অপ্রীতিকর বা অপছন্দনীয় কিছু দেখলে হাদীসের আলোকে আমাদের করণীয় দাঁড়াল:
১. সবর করতে হবে।
২. আল্লাহর নিকট দোয়া করতে হবে।
৩. আনুগত্য করে যেতে হবে, পছন্দ হোক বা নাই হোক।
৪. সংগঠন ছাড়া যাবে না, নিষ্ক্রিয় হওয়া যাবে না।
৫. নেতৃত্বের সাথে লেগে থাকতে হবে।
এ ব্যাপারে প্রিয় নবীজীর উপদেশ সম্বলিত হাদীসটি আমাদের জন্যে অনুসরণযোগ্য: হযরত মু’আয (রা) বর্ণনা করেন, নবী করীম (সাঃ) আমার হাত ধরলেন, অতঃপর কিছুদূর চললেন, তারপর ইরশাদ করলেন, হে মু’আয! আমি তোমাকে উপদেশ দিচ্ছি।
* আল্লাহকে ভয় করা এবং অবাধ্য হওয়া থেকে বিরত থাকা
* সত্য কথা বলার
* অঙ্গীকারপূর্ণ করার
* আমানত যথাযথভাবে আদায় করার।
* খিয়ানত না করার
* ইয়াতীমের প্রতি রহম করার।
* প্রতিবেশীদের মান-সম্ভ্রম রক্ষা করার।
* ক্রোধ ও রাগ দমন করার।
* মানুষের সাথে নরমভাবে কথা বলার।
* মানুষের সাথে সালাম বিনিময় করার।
* রাষ্ট্র প্রধানের নেতৃত্বের সাথে লেগে থাকার।
(বায়হাকী থেকে যাদেরাহ হাদীস নং ১৫৫)
আনুগত্যের পরিবেশ তৈরিতে এগিয়ে আসুন সাংগঠনিক জান্নাতী পরিবেশ লাভ করুন
আপনি আমীর বা সভাপতি, আনুগত্যের মডেল উপস্থাপন করুন।
আল্লাহ, রাসূল (সাঃ), সংগঠনের সংবিধান, নিয়মনীতি ও সিদ্ধান্তের প্রতি আনুগত্যের সর্বোচ্চ পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করুন।
আপনি প্রাক্তন দায়িত্বশীল, সিনিয়র সদস্য, সদস্য, অভিজ্ঞ, জ্ঞানী, আমলদার, দীর্ঘদিন সংগঠন করেছেন, ছাত্র অঙ্গনে অন্য দেশে আপনি সংগঠন করেছেন, অনেক অবদান রেখেছেন। এখন সংগঠনে আপনি সবচাইতে বেশি আনুগত্য করুন।
এতদিন যা আপনি বলেছেন, এখন তা আমল করার সময়। আমল করার মাধ্যমে নমুনা উপস্থাপন করুন, অন্যদের জন্য নমুনা হোন।
জড়তা, আমিত্ব পরিহার করুন, কথায় কাজে মিল রাখুন।
আপনার কণ্ঠে কর্মীরা আনুগত্যের বক্তৃতা শুনেছেন, আপনার নির্দেশ পালনে জান বাজি রেখেছেন। এখন আপনার পালা- আনুগত্য করে দেখিয়ে দিন, আনুগত্য কাকে বলে।
আপনি প্রধান দায়িত্বশীল, অভিজ্ঞ দায়িত্বশীল, শূরা সদস্য, কর্মপরিষদ সদস্য, Unit দায়িত্বশীল, Sub-unit দায়িত্বশীল, তাহলে আপনাকে সবচেয়ে সুন্দর আনুগত্য করতে হবে।
যে যত বড় দায়িত্বশীল, সে তত বেশি সুন্দর, অনুসরণযোগ্য অনুপম আনুগত্য করুন, আনুগত্য করতে শিখুন, আনুগত্যের পরিবেশ তৈরিতে এগিয়ে আসুন তাহলে আল্লাহ পাক আমাদের সকলের প্রতি রহম করবেন।
আমরাও একটি সুন্দর জান্নাতী সাংগঠনিক পরিবেশ লাভ করতে পারব, যা আমাদেরকে আনন্দ দেবে, কল্যাণ দেবে, মানসিক প্রশান্তি দেবে।
আনুগত্যহীনতার পরিণাম
১. হেদায়াত লাভের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হবে। (নূর: ৫৪ )
২. নেক আমল নষ্ট হয়ে যাবে। (সূরা মুহাম্মদ:৩৩)
৩. জাহিলিয়াতের মৃত্যুসম হবে। রাসূলে করীম (সাঃ) বলেছেন, “যে ব্যক্তি আনুগত্যের লাগাম খুলে ফেলল এবং জামায়াত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল, এ অবস্থায় মৃত্যু হলে তার সে মৃত্যু জাহিলিয়াতের মৃত্যুসম হবে”। (মুসলিম)
৪. কিয়ামতের ময়দানে আত্মপক্ষ সমর্থনের কোন দলীল থাকবে না। রাসূলে করীম (সাঃ) ইরশাদ করেছেন, “যে ব্যক্তি আনুগত্যের বন্ধন থেকে হাত খুলে নেয়, সে কিয়ামতের দিন আল্লহর সম্মুখে এমন অবস্থায় হাজির হবে যে, আত্মপক্ষ সমর্থনে তাদের বলার কিছুই থাকবে না। আর যে ব্যক্তি বাইআত ছাড়া মারা যাবে তার মৃত্যু জাহিলিয়াতের মৃত্যুসম হবে। (মুসলিম)
৫. সাংগঠনিক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হবে; সংগঠনের মজবুতি নষ্ট হবে। আল্লাহ পাক বলেন “ফিতনা তথা বিশৃঙ্খলা হত্যাকান্ড থেকেও জঘন্য” “নিশ্চয়ই আল্লাহ পাক ফাসাদ ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি কারীদেরকে ভালোবাসেন না”
আনুগত্যের পরিবেশ তৈরির রূহানী সম্বল
আনুগত্যের পরিবেশ সৃষ্টির ক্ষেত্রে আমার জানামতে তিনটি উপকরণকে রূহানী উপকরণ বলা যায়। অথবা এই তিনটিকে কেন্দ্র করে আনুগত্যের ক্ষেত্রে রূহানী পরিবেশ সৃষ্টি হয়ে থাকে।
এক. সর্ব পর্যায়ের দায়িত্বশীল ব্যক্তিগতভাবে এবং সংগঠন পরিচালনার ক্ষেত্রে নিষ্ঠার সাথে আল্লাহ ও রাসূলের আনুগত্য করবে। এ পথে উন্নতির জন্য প্রতিনিয়ত আত্মসমালোচনার সাথে এ আনুগত্যের মান বাড়াবার চেষ্টা করবে।
দুই. কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব কেন্দ্রীয় বডির সিদ্ধান্তের প্রতি নিষ্ঠার সাথে শ্রদ্ধা পোষণ করবে। অত্যন্ত যত্নসহকারে তা বাস্তবায়নের প্রয়াস চালাবে। আর অধস্তন সংগঠনের নেতৃত্বের দায়িত্বে যারা থাকবে তাদের ঊর্ধ্বতন সংগঠনের, ঊর্ধ্বতন নেতার আনুগত্যের ব্যাপারে আদর্শ স্থাপনের প্রয়াস পেতে হবে।
তিন. যাদের সাথে নিয়ে সংগঠন পরিচালনা করা হচ্ছে, যাদের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত ও পরিকল্পনা বাস্তবায়নের কামনা করা হয়, তাদের জন্য আল্লাহর দরবারে হাত তুলে দোয়া করা অভ্যাসে পরিণত হতে হবে।
তাছাড়া নেতৃত্ব যারা দেবেন বা সংগঠন যারা পরিচালনা করবেন, তাদেরকে নিজ নিজ কর্মক্ষেত্রে নিম্নলিখিত কয়েকটি ব্যাপারে অগ্রগামী হতে হবে।
১. ঈমানী শক্তি ও ঈমানের দাবি পূরণের ক্ষেত্রে
২. ঈমানী শক্তি অর্জন ও প্রয়োগের ক্ষেত্রে।
৩. আমল, আখলাক ও তাওয়ার ক্ষেত্রে ৷
৪. সাংগঠনিক যোগ্যতা ও দক্ষতার ক্ষেত্রে।
৫. মাঠে ময়দানের কর্মতৎপরতা ও ত্যাগ এবং কুরবানী ও ঝুঁকি নেবার ক্ষেত্রে
শেষকথা
রাসূলে করীম (সাঃ) ইরশাদ করেছেন, মুমিন ও ঈমানের উদাহরণ হল খুঁটিতে বেঁধে রাখা ঘোড়ার মত। চারদিকে যতই ঘোরাফেরা করুক না কেন অতঃপর আবার সেই খুঁটির নিকট ফিরে আসে। (আল-হাদীস)
আসুন, আনুগত্যের লাগাম লাগিয়ে সংগঠনের মাঝে শৃঙ্খলার সীসাঢালা প্রাচীর তৈরি করি এবং সংগঠনের অভ্যন্তরে জান্নাতী পরিবেশ তৈরি করতে সকলেই এগিয়ে যাই। হে আল্লাহ! আমাদের সকলকে তার দীনের পথে, ঈমানের পথে মৃত্যু পর্যন্ত চলার তাওফীক দিন। আনুগত্যের সঠিক Spirit আমাদেরকে দান করুন। আমীন।
ইসলামী সংগঠনে পরামর্শ
“হে নবী! কাজ-কর্মে তাদের সাথে পরামর্শ করুন। কোন বিষয়ে আপনার পরিকল্পনা সুদৃঢ় হয়ে গেলে আল্লাহর উপর ভরসা করুন”।
ইসলামী আন্দোলন ও সংগঠনের প্রাণশক্তি
ইসলামী আন্দোলন ও সংগঠনের প্রাণশক্তি হল দুটি। যথা-
১. পারস্পরিক পরামর্শের ভিত্তিতে কার্যক্রম পরিচালনা করা,
২. সংশোধনের উদ্দেশ্যে গঠনমূলক সমালোচনা করা
পরামর্শ কি?
পরামর্শ শব্দের শাব্দিক অর্থ হল মতামত দেওয়া, মত বিনিময় করা। একে আরবীতে বলে ‘শূরা’ এবং ইংরেজিতে বলে Counsel, Advice.
বাংলা ভাষায় পরামর্শ শব্দটি আরো যে অর্থে ব্যবহৃত হয়,
শাব্দিক অর্থ: উপদেশ দেওয়া, মন্ত্রণা দেওয়া, মন্ত্রণ, সলাপরামর্শ, বুদ্ধি দেওয়া, হিতোপদেশ, হিতোক্তি, নীতিকথা, নীতিবাক্য, অনুশাসন, সদুপদেশ, সুমন্ত্রণা, সুপরামর্শ, সুবুদ্ধি, সুযুক্তি, ভালোর জন্য বলা, প্রত্যুপদেশ, অনুপ্রেরণা দেওয়া, অনুপ্রাণনা দেওয়া, প্রেরণা দেওয়া, প্রণোদন, উৎসাহ দান ইত্যাদি।
পারিভাষিক অর্থ: ইসলামী শরীআতের পরিভাষায়, কোন কাজ সুষ্ঠু ও সুন্দরভাবে করার জন্য সিদ্ধান্ত গ্রহণের পূর্বে সহযোগীদের সাথে যোগাযোগ ও উদার মন নিয়ে যে মতবিনিময় করা হয় বা যে মতামত পেশ করা হয়, একে পরামর্শ বলে।
পরামর্শের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা
১. পরামর্শ দেওয়া নেওয়া আল্লাহর নির্দেশ: আল্লাহ পাক বলেন, “নবী হে! গুরুত্বপূর্ণ কাজ-কর্মে তাদের সাথে পরামর্শ করুন, তাদের সাথে মতামত বিনিময় করুন। কোন বিষয়ে আপনার পরিকল্পনা চূড়ান্ত হয়ে গেলে আল্লাহর উপর ভরসা করুন। নিঃসন্দেহে আল্লাহ পাক ভরসাকারী লোকদেরকে ভালোবাসেন”। (আলে ইমরান: ১৫৯)
২. পরামর্শ বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর সুন্নাত: রাসূল (সাঃ) নিজে আল্লাহর নির্দেশের আলোকে সাহাবায়ে কেরামের সাথে বিভিন্ন বিষয়ে পরামর্শ করে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন ৷ এর অসংখ্য নজির রাসূল (সাঃ)-এর জিন্দেগীতে বিদ্যমান
উমার ইবনুল খাত্তাব (রাঃ) বলেন, “রাসূলুল্লাহ (সাঃ) রাতে মুসলিমদের সামাষ্টিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আবু বকরের সাথে পরামর্শ করতেন। আমিও তাদের সাথে থাকাতাম”। (জামে আত-তিরমীজি)
“আয়শা (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি রাসূল (সাঃ) অপেক্ষা লোকজনের সাথে অধিক পরামর্শকারী কোন ব্যক্তিকে দেখিনি”। (আখলাকুন্নবী, হাদীস নং ৭২৭)
৩. পরামর্শ করা সাহাবায়ে কেরামের বৈশিষ্ট্য: গোটা জামায়াতে সাহাবীগণ পারস্পরিক পরামর্শের ভিত্তিতে নিজেদের কার্যক্রম পরিচালনা করতেন।
৪. পরামর্শ হচ্ছে আন্দোলনের নিরাপত্তা প্রহরী: নিরাপত্তায় নিয়োজিত কর্মী বাহিনী যেমনিভাবে ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান ও রাষ্ট্রের হেফাযতের দায়িত্ব পালন করেন তেমনিভাবে ইসলামী আন্দোলন ও সংগঠনের অভ্যন্তরে যাবতীয় সমস্যা থেকে সংগঠনের নেতা-কর্মীদেরকে হেফাযত করে কাঙ্ক্ষিত মঞ্জিলে পৌঁছাতে নিরাপত্তা প্রহরীর দায়িত্ব পালন করে এই পরামর্শ। ‘পরামর্শ করা’ নিজের উপর বাধ্যতামূলক করে নিতে হবে। অন্যথায় অবমাননাকর পরিস্থিতির শিকার হওয়া অস্বাভাবিক নয়। হাদীস শরীফের ভাষায়,
“আনাস (রা) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল (সাঃ) ইরশাদ করেছেন, যে ইস্তেখারা করবে, সে কোন কাজে ব্যর্থ হবে না। যে পরামর্শ করবে, সে লজ্জিত হবে না। যে মধ্যম পন্থা অবলম্বন করবে, সে দারিদ্র্যে নিপতিত হবে না”। (আল-মু’জামুস সগীর)
৫. পরামর্শে গৃহীত সিদ্ধান্তে আল্লাহর রহমত থাকে: সকলে মিলে পরামর্শ করে কোন কাজ করার সিদ্ধান্ত নিলে আল্লাহ পাক সেখানে মেহেরবানী করেন। খন্দকের যুদ্ধে রাসূল (সাঃ) হযরত সালমান ফারসী (রা)-এর পরামর্শ মোতাবেক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে যুদ্ধ পরিচালনা করলেন। আল্লাহ পাক এতে তার সাহায্য ও রহমতের হস্ত প্রসারিত করে দিলেন এবং কাফেরদের সকল চক্রান্ত নস্যাৎ করে দিলেন।
৬. পরামর্শ স্বেচ্ছাচারী হবার পথ রুদ্ধ করে দেয়: যে দলের প্রত্যেক ব্যক্তি নিজের ইচ্ছে মতো চলে এমন স্বেচ্ছাচারী দল কোন ইসলামী সংগঠন হতে পারে না; বরং নিছক একটি জনমণ্ডলী। এমন জনশক্তি দ্বারা কোন কাজ সম্পন্ন করা সম্ভব নয়। কোন মানুষ সামষ্টিক ব্যাপারে স্বেচ্ছাচারিতা চালানোর চেষ্টা এ জন্যে করে যে, হয়তো সে নিজের স্বার্থ হাসিলের জন্য অপরের অধিকার হরণ করে। অথবা সে নিজেকে বড় এবং অন্যকে ছোট মনে করে। এ জাতীয় মনোভাবই খারাপ। মুমিন চরিত্রে এ ধরনের মনোভাব যেন প্রবেশ করতে না পারে, তারই জন্য ইসলাম পারস্পরিক পরামর্শকে সামষ্টিক জীবনের অপরিহার্য শর্ত বানিয়ে দিয়েছে।
৭. ওহী ও নবীর অবর্তমানে জ্ঞানের স্বল্পতার জন্য পরামর্শ করা জরুরি: আল্লাহর পক্ষ থেকে আর কোন নবী ও ওহি আসবে না। কোন বিষয় সঠিক কি বেঠিক তা জানানোর জন্যও আর জিব্রাঈল (আ) এই পৃথিবীতে অবতরণ করবেন না। আমরা মানুষ, আমাদের রয়েছে জ্ঞানের স্বল্পতা। এ অবস্থায় একটি ভাল সিদ্ধান্তে পৌঁছার জন্য পারস্পরিক আলোচনা পর্যালোচনা, পরামর্শ দেওয়া-নেওয়া ও মত বিনিময় করা একান্ত জরুরি। কথায় বলে “এক মাথার চেয়ে ২টি মাথা উত্তম।” সকলে মিলে পরামর্শ করে কাজ করলে অনেক জটিল ও কঠিন কাজ অত্যন্ত সহজে আঞ্জাম দেওয়া সম্ভব।
৮. সংগঠনের মধ্যে চিন্তার ঐক্য সাধনের জন্য: সংগঠনের সমগ্র জনশক্তির বিভিন্ন পর্যায়ের দায়িত্বশীলদের মাঝে বেশি পরিমাণে পরামর্শ নেওয়া-দেওয়া জরুরি। দায়িত্বশীলদের মাঝে মনখোলা পরামর্শের পরিবেশ না থাকলে এটা সংগঠনের অভ্যন্তরে সংহতি বিনষ্ট করে দেয়। কারণ মানুষ মাত্রই চিন্তাশীল। নিঃসন্দেহে দায়িত্বশীলগণ আরো বেশি চিন্তা করে থাকেন। চিন্তা তাদের মগজে এনে দেয় মাঠে ময়দানের অভিজ্ঞতা এবং চাহিদা। এভাবে দায়িত্বশীলগণের চিন্তার বিনিময় না হলে, ভাবের আদান-প্ৰদান না হলে চিন্তার ঐক্য গড়ে উঠা সম্ভব নয়।
৯. পারস্পরিক পরামর্শ দুনিয়ার জিন্দেগীর কল্যাণ ও সৌভাগ্যের উৎস: রাসূলে করীম (সাঃ) বলেছেন, ইহকালীন জিন্দেগীর সুখ-সমৃদ্ধি ও কল্যাণ তিন জিনিসের সমন্বয়ে পাওয়া সম্ভব, তন্মধ্যে পারস্পরিক পরামর্শ হল অন্যতম। এ প্রসঙ্গে হাদীসের
ভাষ্য, “আবু হুরায়রা (রা) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলে করীম (সাঃ) ইরশাদ করেছেন, যখন তোমাদের নেতারা হবেন সর্বোপরি ভাল মানুষ, ধনীরা হবেন সর্বোদ্ধ দানশীল এবং তোমাদের সামগ্রিক কার্যক্রম চলবে পারস্পরিক পরামর্শের ভিত্তিতে, তখন তোমাদের জন্য মাটির উপরিভাগ নিচের ভাগ থেকে উত্তম হবে। অর্থাৎ দুনিয়ার জীবন তোমাদের জন্য কল্যাণময় ও সুখময় হবে”। (তিরমিযী)
পরামর্শ গ্রহণের উপকারিতা
পরামর্শ ভিত্তিক কাজ করলে যে সমস্ত ফায়দা পাওয়া যায় তা আলোকপাত করা হল।
১. সাথী ও সহকর্মীদেরকে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে পরামর্শ দেবার সুযোগ দিলে বা তাদের সাথে পরামর্শ করলে আনুগত্যের সুন্দর স্বতঃস্ফূর্ত পরিবেশ তৈরি হয়।
২. জনশক্তির মাঝে দায়িত্বানুভূতি বৃদ্ধি পায় ৷
৩. পরামর্শ সকল প্রকার সন্দেহ সংশয় দূর করে সংগঠনের অভ্যন্তরে জান্নাতী পরিবেশ তৈরি করে।
৪. সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে সমস্যা সৃষ্টি হলে অযাচিত সমালোচনা ও অবাঞ্ছিত ক্ষতিকর পরিবেশ তৈরির সুযোগ থাকে না।
৫. পরামর্শে অংশ গ্রহণের ফলে সকলের মাঝে কাজের গুরুত্ব স্বাভাবিকভাবেই বেড়ে যায়।
৬. সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের জন্য আন্তরিকভাবে প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকে।
৭. পরামর্শকেন্দ্রিক কাজে আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে রহমত-বরকত যোগ হতে, থাকে।
পরামর্শ যারা দেবেন বা পরামর্শ যাদের সাথে করবেন
সবার সাথে নয় বরং যে বিষয়ে, যাদের স্বার্থ জড়িত তাদের সাথে পরামর্শ করতে হবে। সংশ্লিষ্ট লোকের সংখ্যা যদি খুব বেশি হয় তাহলে তাদের প্রতিনিধিদের সাথে পরামর্শ করতে হবে। পরামর্শের ক্ষেত্রকে আমরা তিনটি পর্যায়ে ভাগ করতে পারি
১. সর্বসাধারণের পরামর্শ।
২. দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের পরামর্শ।
৩. আহলে রায় বা বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ।
১. সর্বসাধারণের পরামর্শ: অর্থাৎ সাংগঠনিকভাবে সংগঠনের সকল জনশক্তির পরামর্শ নেওয়া। যেমন- সংগঠনের আমীর নির্বাচন কালে সকল জনশক্তির পরামর্শ নেওয়া প্রয়োজন। রাষ্ট্রীয়ভাবে রাষ্ট্রপ্রধান ও রাষ্ট্রের পার্লামেন্ট গঠনের ব্যাপারে সকল জনসাধারণের মতামত নেওয়া প্রয়োজন। কারণ এতে সকল জনগণের স্বার্থ জড়িত রয়েছে।
২. দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের পরামর্শ: যেখানে সকল জনসাধারণের স্বার্থ জড়িত নেই বা সংগঠনের ক্যাডারভুক্ত জনশক্তিদের স্বার্থ জড়িত নেই এমন সকল বিষয়ে দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের সাথে পরামর্শ করলেই চলবে।
৩. আহলে রায় বা বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ: রাষ্ট্রীয়ভাবে কোন বিশেষ প্রকল্প প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে বিশেষ বিশেষ বিভাগের লোকদের সাথে পরামর্শ করাই যুক্তিযুক্ত, তেমনিভাবে সাংগঠনিক গুরুত্বপূর্ণ ও জটিল ইস্যুতে সংগঠনের বিশেষজ্ঞদের রায়ের প্রতি আস্থা রাখা আমাদের সকলের কর্তব্য। যেমন- হযরত ওমর (রা) কুরআনের তাফসীরের ব্যাপারে হযরত ইবনে আব্বাস (রা) এবং মদীনার বাজার সংক্রান্ত বিষয়ে মহিলা সাহাবী শিফা বিনতে আবদুল্লাহ (রা)-এর মতামত নিয়ে সিদ্ধান্ত ঘোষণা করতেন।
পরামর্শ দেওয়ার নিয়ম-নীতি ও শর্তাবলি
পরামর্শ দেওয়ার ক্ষেত্রে যথাযথ নিয়ম পদ্ধতির অনুসরণ না করলে পরামর্শের কল্যাণকারিতার চাইতে ক্ষতির দিকটাই মারাত্মক হতে পারে। তাই আমাদের সকলকে পরামর্শ দেওয়ার ব্যাপারে যতটা সচেতন হতে হবে ততটা সচেতন হতে হবে পরামর্শ দেওয়ার নিয়মনীতি মেনে চলার ব্যাপারেও। পরামর্শের নিয়মনীতি বা শর্তাবলি নিম্নরূপ,
১. কল্যাণ কামনার উদ্দেশ্যে পরামর্শ দেওয়া: দায়িত্বশীল যাতে নিজের উপর অর্পিত দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করতে পারেন, সে জন্য অন্য ভাইয়েরা সংগঠন ও দায়িত্বশীলের কল্যাণ কামনার উদ্দেশ্যে নিজের দায়িত্ব মনে করে পরামর্শ দিবেন।
২. দায়িত্ব পালনের উদ্দেশ্যে পরামর্শ চাওয়া: দায়িত্ব পালন একার পক্ষে সম্ভব নয় বলে সকলের পরামর্শ, সহযোগিতা প্রয়োজন। তাই দায়িত্বশীলের নিজের উপর অর্পিত জিম্মাদারি সঠিকভাবে পালনের জন্য মন খুলে অন্যান্য ভাইদের কাছে পরামর্শ চাওয়া একটি জরুরি বিষয়।
৩. মার্জিত ভাষায় পরামর্শ দেওয়া: আমার পরামর্শ যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ মনে করেই আমি পরামর্শ দেব। তবে অত্যন্ত মার্জিত ভাষায়, সুন্দর শব্দ চয়নের মাধ্যমে ও ঠাণ্ডা মাথায় পরামর্শ দিতে হবে। সংগঠনে বর্তমানে এই কাজ করতে হবে, আমার এই পরামর্শ অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নিতে হবে এ জাতীয় বক্তব্য পরামর্শের ভাষা হতে পারে না।
৪. সিদ্ধান্ত গ্রহণের পূর্বে পরামর্শ দেওয়া: সংগঠন বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন বিষয়ে পরামর্শ চেয়ে থাকে। সে ক্ষেত্রে আমাদেরকে যথাসময়ে পরামর্শ পাঠিয়ে দিতে হবে। মনে রাখতে হবে, আমার পরামর্শ সিদ্ধান্ত গ্রহণের পূর্বে সংগঠনের হাতে পৌঁছা দরকার।
৫. পরামর্শ গৃহীত হল কিনা তা বিবেচনা করে পরামর্শ দেওয়া যাবে না: আমার আপনার মত অন্যান্য ভাইদেরকেও আল্লাহ পাক চিন্তা-ভাবনা করার মত বিবেক বুদ্ধি দিয়েছেন। সুতরাং আমারটাই গ্রহণ করতে হবে এ জাতীয় মন-মানসিকতা নিয়ে
৬. পরামর্শ দিয়ে আবার দেখবে না যে তার পরামর্শ গৃহীত হল কিনা: এ জাতীয় মন-মানসিকতা থেকে আমাদেরকে দূরে থাকতে হবে। আমার দায়িত্ব ঈমানদারীর সাথে পরামর্শ দেওয়া। আর সংগঠন বা দায়িত্বশীলদের দায়িত্ব হল পরামর্শ গ্রহণ করা। পরামর্শ দিয়েই আমাকে সন্তুষ্ট থাকতে হবে অন্য কোন চিন্তা করা যথার্থ হবে না।
৭. পরামর্শ দেওয়ার ব্যাপারে গ্রুপিং না করা: নিজের পরামর্শ আন্তরিকতা সহকারে সংগঠনের কল্যাণার্থে দায়িত্বশীলদের কাছে বলতে হবে অথবা যথাযথ ফোরামে। সেই পরামর্শ পেশ করতে হবে। এর বাইরে ব্যক্তি তার পরামর্শকে মূল্যবান মনে করে অন্য ভাইকে নিজের পরামর্শের কথা বলে, এর প্রয়োজনীয়তা বুঝিয়ে ঐ ভাইয়ের মাধ্যমেও দায়িত্বশীলের ‘কাছে একই পরামর্শ পাঠানোর ব্যবস্থা করা ঠিক নয়।
৮. ক্ষতিকর পরামর্শ দেওয়া যাবে না: এমন কোন পরামর্শ দেওয়া যাবে না যাতে অকল্যাণকর বা খারাপ দিক রয়েছে। এমনটি করা বিশ্বাসঘাতকতার শামিল। হাদীস শরীফের ভাষায়, “যে ব্যক্তি তার মুসলিম ভাইকে এমন কাজের পরামর্শ দিল, যে সম্পর্কে সে জানে যে, এর বিপরীত কাজে কল্যাণ রয়েছে, তাহলে সে নিঃসন্দেহে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে”। (আবু দাউদ)
৯. সামষ্টিক মতের নিকট নিজের মতের কুরবানী দেওয়া: জামায়াতী জিন্দেগীতে মতামতের কুরবানী একটা জরুরি বিষয়। মনে রাখতে হবে, মানুষের পক্ষে মতামত কুরবানী দেওয়াটাই বড় কুরবানী। কারণ মানুষ নিজের জীবনে অনেক নজির উপস্থাপন করতে পারলেও কুরবানীর ক্ষেত্রে ব্যর্থতার পরিচয় দেয়। যে ব্যক্তি সামষ্টিক রায়ের নিকট ব্যক্তিগত রায়কে কুরবানী করতে ব্যর্থ হয়, সে প্রকৃতপক্ষে জামায়াতী জীবন যাপনেই ব্যর্থ হয়।
রাসূল (সাঃ) একটি হাদীসে তিনটি মুক্তিদানকারী ও তিনটি ধ্বংসকারী জিনিসের উল্লেখ করেছেন। সে ৩টি জিনিস হল:
১. এমন কামনা বাসনা, মানুষ যার অনুগত দাস হয়ে যায়।.
২. এমন লোভ-লালসা, যাকে পরিচালক মেনে নেওয়া হয়।
৩. নিজের মতকে অগ্রাধিকার দেওয়া। রাসূল (সাঃ) বলেন, আর এটিই হচ্ছে সর্বাধিক ভয়াবহ। (বায়হাকী)
১০. নিজের মতের বিপরীত সিদ্ধান্ত হয়ে গেলে তা বাইরে প্রকাশ না করা: নিজের মতামত অনুযায়ী সিদ্ধান্ত হল না বলে তা বাইরে প্রকাশ করে সংগঠনের শৃঙ্খলার বিপরীত কাজ করা কিছুতেই কাম্য হতে পারে না। আমার মতামতটাই সঠিক ছিল, এ জাতীয় মনোভাব পোষণ করা কিছুতেই ঠিক নয়। ওহীর জ্ঞান ছাড়া আর কোন জ্ঞান নির্ভুল হতে পারে না।
পরামর্শের নিয়মনীতি সম্পর্কে সাইয়েদ আবুল আলা মওদূদী (র) বলেন,
১. প্রত্যেক ব্যক্তি ঈমানদারীর সাথে নিজের মত প্রকাশ করবে এবং মনের মধ্যে কোন কথা লুকিয়ে রাখবে না।
২. আলোচনায় কোন প্রকার জিদ, হঠকারিতা ও বিদ্বেষের আশ্রয় নেবে না।
৩. সংখ্যাধিক্যের মাধ্যমে একটি সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়ে যাওয়ার পর ভিন্ন মত পোষণকারী নিজের মত পরিবর্তন না করলেও দলীয় সিদ্ধান্তকে কার্যকর করার জন্য সানন্দে অগ্রসর হবে।
মাওলানা মওদূদী (র) আরো বলেন, এই তিনটি বিষয়ের প্রতি লক্ষ্য না রাখলে পরামর্শের সমস্ত ফায়দাই নষ্ট হয়ে যায়।
১. প্রত্যেকে ঈমানদারীর সাথে দীনের স্বার্থে নিজের মত প্রকাশ করবে, মনের মধ্যে কোন কথা লুকিয়ে রাখবে না।
২. আলোচনার সময় নিজের মতের পক্ষে সিদ্ধান্ত নেবার জন্য জিদ ধরবে না বা অপর মতের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ পোষণ করবে না।
৩. খোলামেলা আলোচনার পর অধিকাংশ লোক যে মতের পক্ষে রায় দেয়, তাই সংগঠনের সিদ্ধান্ত হিসেবে সবাইকে মেনে নিতে হবে।
৪. এ সিদ্ধান্ত যারা সঠিক মনে করেন না, তারা পরবর্তীকালে ঐ ফোরামে সে সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের চেষ্টা করতে পারেন। কিন্তু অন্য কোথাও এ সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে মত প্রকাশ করবেন না।
৫. সিদ্ধান্তের সাথে একমত না হলেও সংগঠনের স্বার্থে এ সিদ্ধান্ত অনুযায়ী কাজ করবে।
এ নিয়ম-নীতি না মানার পরিণাম সম্পর্কে তিনি আরো বলেন, “যে এসব নিয়ম মেনে চলতে রাজি নয়, তার সংগঠন ছেড়ে চলে যাওয়া ছাড়া উপায় নেই। সংগঠনে থাকতে হলে অধিকাংশের মত মেনে নিতেই হবে। কারণ এ নিয়ম ছাড়া একদল লোক কখনো একসাথে চলতে পারে না”।
পরামর্শ দেওয়ার ব্যাপারে সর্বশেষ কথা হল, যদি আপনার পরামর্শ গৃহীত হয়ে যায় বা আপনার পরামর্শ অনুযায়ী যদি সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়, তাহলে আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের নিকট কান্নাকাটি করুন। কারণ এই পরামর্শের মধ্যে যদি কোন ক্ষতিকর কিছু থেকে থাকে, তাহলে আল্লাহ পাক যেন সংগঠনকে এই ক্ষতিকর প্রভাব থেকে হেফাযত করেন।
আর যদি আপনার পরামর্শ অনুযায়ী সিদ্ধান্ত গৃহীত না হয়, তাহলে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করুন। কেননা আপনার আমার পরামর্শ অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নেওয়ার ফলে সংগঠন যদি ক্ষতিগ্রস্ত হত, তাহলে আল্লাহর কাছে আমরা কি জবাব দিতাম। সুতরাং জবাবদিহিতার কাঠগড়া থেকে আপনাকে আমাকে আল্লাহ পাক বাঁচিয়ে দিয়েছেন। আল্লাহ পাক যে মেহেরবানী করেছেন সেজন্য তাঁর দরবারে অবনত চিত্তে শুকরিয়া আদায় করুন।
ইসলামী সংগঠনে ইহতিসাব
আল্লাহ পাক বলেন, “রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর জীবনে রয়েছে তোমাদের জন্য সর্বোত্তম আদর্শ” (সূরা আহযাব:২১ )
নবী করীম (সাঃ) বলেন, তোমরা প্রত্যেকেই আপন ভাইয়ের আয়না স্বরূপ। সুতরাং কেউ যদি তার ভাইয়ের মধ্যে কোন ক্ষতিকর কিছু দেখে, তাহলে সে যেন তা দূর করে দেয়। (তিরমিযী)
ইসলামী আন্দোলন ও সংগঠনের প্রাণশক্তি হলো দুটো:
এক: পারস্পরিক পরামর্শের ভিত্তিতে কার্যক্রম পরিচালনা কর।
দুই. সংশোধনের উদ্দেশ্যে গঠনমূলক সমালোচনা করা
এহতেসাব করার জন্যে নিম্নোক্ত হাদীসটি সামনে রাখা প্রয়োজন।
“হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রা) হতে বর্ণিত। রাসূলে করীম (সাঃ) বলেছেন, তোমাদের কোন ব্যক্তিই ততক্ষণ পর্যন্ত ঈমানদার হতে পারবে না, যতক্ষণ তার ইচ্ছা, কামনা-বাসনা আমার আনীত বিধানের অনুবর্তী না হবে”। (শারহুস সুন্নাহ, মিশকাত থেকে ইন্তিখাবে হাদীস)
ইতিসাবের গুরুত্ব
১. সংগঠনকে গতিশীল করার জন্য: সাংগঠনিক সুস্থতা, সংশোধন ও গতিশীলতার জন্য গঠনমূলক সমালোচনার দ্বার উন্মুক্ত থাকা অপরিহার্য। কারণ মানবিক কাজে দুর্বলতার প্রকাশ স্বাভাবিক ব্যাপার; কিন্তু যেখানে দুর্বলতার প্রতি নজর রাখার কেউ থাকে না, সেখানে সকল প্রকার দুর্বলতার আশ্রয়স্থল হিসেবে পরিণত হতে থাকে এবং তা ধীরে ধীরে মারাত্মক আকার ধারণ করে সংগঠনের চলার গতিকে শিথিল করে দেয়। এ ব্যাপারে সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী (রঃ) বলেন, “সমালোচনামূলক চিন্তাকে দাবিয়ে দেওয়ার চাইতে দলের বড় অকল্যাণ আর কিছুই হতে পারে না।”
২. গীবতের পথ বন্ধ করার জন্য: গীবত হল এক মারাত্মক রোগের নাম ৷ এই রোগের প্রতিষেধকের জন্য সমালোচনা চালু থাকা একান্ত জরুরি। এটি একটি ফেতনা বিশেষ। কারণ মানুষ তার ভাইয়ের সামনে নয়; বরং পিছনে বসে নিন্দাবাদ করে ৷ তাই কুরআন গীবত করাকে আপন মৃত ভাইয়ের গোশত খাবার সঙ্গে তুলনা করেছে। যেমন- আল্লাহ বলেন,
“তোমাদের কেউ যেন অপর কারো গীবত না করে। তোমরা কি কেউ আপন মৃত ভাইয়ের গোশত খাওয়া পছন্দ করবে? এটাকে তো তোমরা অবশ্যই ঘৃণা করবে”। (সূরা হুজুরাত: ১২)
৩. সন্দেহ প্রবণতা দূর করার জন্য: সন্দেহ প্রবণতা, নিকৃষ্ট অনুমান, কুধারণা এক গুরুতর ব্যাধি। এ ব্যাধি পারস্পরিক সম্পর্কে ঘুণ ধরিয়ে দেয় এবং তাকে অন্তঃসারশূন্য করে ফেলে। এ ব্যাপারে মাওলানা মওদূদী (র) বলেন- “কুধারণা সৃষ্টি হবার পর মানুষ গোয়েন্দাগিরির মনোবৃত্তি নিয়ে অন্যের দোষ খুঁজে বেড়াতে থাকে। কুধারণার তাৎপর্য হচ্ছে, মানুষ নিজের ছাড়া অন্য সবার সম্পর্কে এ প্রাথমিক ধারণা রাখে যে, তারা সবাই খারাপ।
আল কুরআন এ দুটি বস্তুকেই গোনাহ বলে জানিয়ে দিয়েছে। আল্লাহ বলেন, “হে ঈমানদারগণ! অনেক বেশি ধারণা করা থেকে দূরে থাকো ৷ কারণ কোন কোন ধারণা বা অনুমান হচ্ছে গোনাহ, আর গোয়েন্দাগিরি করো না”। (হুজরাত: ১২)
ইহতিসাবের উদ্দেশ্য
১. অপরের দোষ-ত্রুটি সংশোধন করার জন্য: এই যুগে যেমনি আল্লাহ প্রেরিত নবী-রাসূল’ নেই, তেমনি নবীর হাতে গড়া মানুষও নেই। আমাদের মত সাধারণ মানুষদেরকেই আজ ইসলাম প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম চালাতে হচ্ছে ঈমানের দাবি পূরণের জন্য। কিন্তু আমাদের জীবন দোষ-ত্রুটি দিয়ে ভরা। আর আল্লাহ চান না যে, কোন মুমিন সারা জীবন ভুল-ভ্রান্তির আবর্জনায় গড়াগড়ি দিতে থাকুক। সে কারণে মুমিনগণ যাতে একে অপরের দোষ-ত্রুটি ও দুর্বলতা দেখিয়ে দিয়ে সংশোধন করতে পারে সে দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করে আল্লাহর নবী বলেন, “মুমিন মুমিনের আয়না স্বরূপ”। (আবু দাউদ)
আয়না যেভাবে একজন ব্যক্তিকে তার সাজগোছে কোথায় ত্রুটি আছে তা দেখিয়ে দেয়, একজন মুমিনও সেভাবে আরেকজন মুমিনের জীবনের ত্রুটিগুলো দেখিয়ে দেওয়ার মাধ্যমে অপর ভাইকে সুন্দর করে সাজিয়ে গুছিয়ে নিবে। আল্লাহ আমাদের সবাইকে আয়নার মতো ভূমিকা পালন করার তাওফীক দিন। আমীন।
২. অপর ভাইয়ের কল্যাণ কামনায়: রাসূলে করীম (সাঃ) ইরশাদ করেছেন, “দীন হল কল্যাণ কামনা করা।” সুতরাং আমরা সকলের কল্যাণ কামনা করি- এ কথা আমাদের সার্বিক কাজের মাধ্যমে প্রমাণ করতে হবে। গীবত ও পরনিন্দার দরজা চিরতরে বন্ধ করে দিয়ে অপরের কল্যাণ কামনায় এগিয়ে আসতে হবে। আর তা কেবল কারো সম্মুখে নয়, বরং কোন ভাইয়ের উপস্থিতিতে ও অনুপস্থিতিতে সর্বাবস্থায় তার কল্যাণ কামনা করতে হবে। এটা ঈমানের দাবি। আল্লাহর নবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এ ব্যাপারে বলেন, “উপস্থিত ও অনুপস্থিত উভয় অবস্থায় অপর ভাইয়ের জন্য কল্যাণ কামনা করা”। (নাসায়ী শরীফ)
৩. সম্পর্ক উন্নয়ন ও গভীর করার জন্য: আল্লাহ তাআলা বলেন, “নিশ্চয়ই মুমিনরা পরস্পর ভাই ভাই। অতএব ভ্রাতৃত্ব সম্পর্কের সকলের মধ্যে পারস্পরিক কল্যাণকর ব্যবস্থা প্রদান কর।’ (সূরা হুজুরাত: ১০)
এই ভ্রাতৃত্বের সম্পর্ককে সুন্দর ও গভীর করার জন্য প্রয়োজন একের প্রতি অপরের স্বচ্ছ সুন্দর ধারণা থাকা। সকল প্রকার কুধারণা থেকে মুক্ত থেকে সুধারণা পোষণ করা আর এটা করতে হলে প্রয়োজন ইতিসাবের যথার্থ মর্যাদা ও কদর করা।
ইহতিসাবের পদ্ধতি
১. ব্যক্তিগতভাবে একে অপরকে সংশোধনের চেষ্টা করা।
২. সংশোধন না হলে দায়িত্বশীলকে জানানো।
৩. তাতেও যদি সংশ্লিষ্ট ভাই সংশোধিত না হন, তাহলে দায়িত্বশীলের অনুমতি সাপেক্ষে সামষ্টিক প্রোগ্রামে ইহতিসাব করা।
এর বাইরে কোন ভাই যদি অপর কোন ভাইয়ের দোষ-ত্রুটি আলোচনা করেন, তাহলে অবশ্যই তা গীবত ও পরনিন্দার পর্যায়ভুক্ত হবে। রাসূলে করীম (সাঃ) গীবতের সংজ্ঞা দান প্রসঙ্গে একবার সাহাবায়ে কেরামকে জিজ্ঞেস করেন, গীবত কি তা তোমরা জানো?
সাহাবীগণ জবাব দিলেন, আল্লাহ ও তার রাসূলই ভাল জানেন। তখন রাসূলে করীম (সাঃ) বললেন, গীবত হচ্ছে এই যে, তোমার ভাইয়ের পছন্দনীয় নয়, এমন বিষয়ে তার চর্চা করা। বলা হলো, আমার ভাইয়ের মধ্যে যদি উল্লিখিত খারাবি বর্তমান থাকে? হযরত (সাঃ) বললেন, তোমরা যদি এমন খারাবির কথা উল্লেখ করো, যা তার মধ্যে আছে, তবে তো গীবত করলে। আর তার মধ্যে যদি বর্তমান না থাকে, তবে তো তার ওপর অপবাদ চাপিয়ে দিলে। (মুসলিম)
কুরআন হাদীসে এতসব সতর্কবাণী থাকার পরেও যদি কেউ কারো দোষ অন্যায়ভাবে চর্চা করতে আনন্দ পায়, তাহলে জেনে রাখতে হবে, নিজের জন্যেও অপমানজনক পরিস্থিতি অপেক্ষা করছে। রাসূলে করীম (সাঃ)-এর ভাষায়, “যে ব্যক্তি তার ভাইকে কোন গোনাহের জন্য লজ্জা দিবেন তার দ্বারা সেই গোনাহের কাজ না হওয়া পর্যন্ত সে মৃত্যুবরণ করবে না”। (তিরমিযী)
ইহতিসাব করার নিয়মনীতি
ইতিসাবের মত একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে যদি কেউ নিয়মনীতির ধার না ধারে, তাহলে ইত্তিসাবের উপকারের চেয়ে অপকারটাই বেশি হবে। রাসূলে করীম (সাঃ) বলেছেন,
“তোমরা প্রত্যেকেই অপর ভাইয়ের আয়না স্বরূপ, সুতরাং কেউ যদি তার ভাইয়ের মধ্যে কোন ক্ষতিকর কিছু দেখে, তাহলে যেন তা দূর করে দেয়”। (তিরমিযী)
“একজন মুমিন অপর মুমিনের দর্পণ স্বরূপ এবং এক মুমিন হচ্ছে অপর মুমিনের ভাই, সে তার অধিকারকে তার অনুপস্থিতিতেও সংরক্ষিত রাখবে”। (আবু দাউদ)
উপরিউক্ত হাদীস দুটো থেকে মুহাদ্দিসীনে কেরাম ও ইসলামী চিন্তাবিদগণ ইহূর্তিসাবের যে সব নিয়মনীতি নির্ধারণ করেছেন, তা নিম্নে প্রদত্ত হল।
১. কারো ছিদ্রান্বেষণ বা দোষ-ত্রুটি খুঁজে বেড়ানো উচিত নয়। কেননা আয়না কখনো ছিদ্রান্বেষণ করে না। মানুষ যখন তার সামনে দাঁড়ায়, কেবল তখনই আয়না তার চেহারা প্রকাশ করে।
২. পেছনে বসে সমালোচনা করা যাবে না। কারণ সামনা-সামনি না হওয়া পর্যন্ত আয়না কারো আকৃতি প্রকাশ করে না।
৩. সমালোচনায় কোন বাড়াবাড়ি হওয়া উচিত নয়। কেননা আয়না কোনরূপ কমবেশি না করেই আসল চেহারাটা ফুটিয়ে তোলে।
৪. সমালোচনা সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ এবং কোনরূপ স্বার্থসিদ্ধি ও দুরভিসন্ধি থেকে মুক্ত হওয়া উচিত। কারণ আয়না যার চেহারা প্রতিবিম্বিত করে, তার প্রতি কোন বিদ্বেষ পোষণ করে না।
৫. বক্তব্য টুকু বলে দেওয়ার পর তাকে আর মনের মধ্যে লালন করা উচিত নয়। কেননা সামনে থেকে চলে যাবার পর আয়না কারো আকৃতি সংরক্ষিত রাখে না। অন্য কথায় অপরের দোষ গেয়ে বেড়ানো উচিত নয়।
৬. সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথা হল, সকলের ভেতর পরনিষ্ঠা, আন্তরিকতা, সহানুভূতি ও ভালবাসা ক্রিয়াশীল থাকতে হবে, যাতে করে নিজের সমালোচনা শুনে প্রতিটি লোকের মনে স্বভাবতই যে অসন্তোষ মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে, সমালোচকের এ মনোভাব উপলব্ধি করা মাত্রই তা বিলীন হয়ে যায়।
যিনি ইহুতিসাব করবেন তার করণীয়
১. মন-মানসিকতা সময় ও পরিবেশ বুঝে ইত্তিসাব করা।
২. ইহতিসাবের ভাষা হবে মোলায়েম, ভাষায় কোন তেজ থাকবে না এবং ক্ষোভের অভিব্যক্তিও ঘটবে না।
৩. আল্লাহকে হাজির নাজির জেনে ইত্তিসাব করা।
৪. দরদি মন নিয়ে আন্তরিকতার সাথে ইত্তিসাব করা ৷
৫. কাউকে হেয় করার উদ্দেশ্যে ইহতিসাব না করা।
৬. কারণ দর্শানোর পর ঐকান্তিকতার সাথে মেনে নেওয়া এবং সবকিছু অন্তর থেকে মুছে ফেলা। অথচ কখনো কখনো দেখা যায়, একজন ভাই কারণ দর্শানোর পরও ইতিসাবকারী মেনে নিতে চান না৷ সামনে না বললেও মনের ভিতর লালন করে থাকেন। এ ব্যাপারে রাসূল (সাঃ)-এর নিম্নোক্ত হাদীসটি প্রণিধানযোগ্য।
“মহানবী (সাঃ) বলেন, যে ব্যক্তি তার কোনো মুসলমান ভাইয়ের কাছে নিজের ত্রুটির জন্য অক্ষমতা বা ওজর পেশ করলো, অথচ সে তাকে অক্ষম মনে করলো না এবং তার অক্ষমতাও কবুল করল না, তার এতটা গোনাহ হলো, যতটা অবৈধভাবে গ্রহণজনিত যুলুমের ফলে একজন শুল্ক গ্রহণকারীর হয়ে থাকে”। (বায়হাকী )
যার ইহতিসাব করা হবে তার করণীয়
১. ছল চাতুরীর আশ্রয় না নিয়ে ত্রুটির স্বীকৃতি দেওয়া। কেউ কেউ ইতিসাবের জবাব দেওয়ার ক্ষেত্রে ঘুরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে বুঝাতে চায় যে, আপনি যা মনে করছেন তা আসলে ঠিক নয়। এ ক্ষেত্রে রাসূল (সাঃ)-এর অমিয় বাণী আমাদেরকে সঠিক ভূমিকা পালন করতে সাহস জোগাবে। হাদীসের ভাষ্য:
“সবচাইতে বড় খেয়ানত হচ্ছে এই যে, তুমি তোমার ভাইকে কোন কথা বললে সে তোমাকে সত্যবাদী মনে করলো; অথচ তুমি তার কাছে মিছে কথা বললে। এটা তোমার জঘন্য বিশ্বাসঘাতকতা”। (তিরমিযী)
২. সংশোধনের জন্য দোয়া কামনা করা ও প্রচেষ্টা চালানো।
৩. সুন্দর ভাষায় কারণ বর্ণনা করা। ভাষাগত দিক থেকে আমাদের আরো সচেতন হওয়া দরকার। নিজের কথাগুলো বলার সময় মার্জিত, মোলায়েম, ভদ্র-নম্র ও অমায়িকভাবে বলা উচিত।
৪. ভুল ধারণা অন্তর থেকে মুছে ফেলা। ইহতিসাবকারী যদি যথাযথ বিষয়ে ইতিসাব নাও করেন, তাহলেও মনে কোন ধারণা রাখা উচিত নয়; বরং ইহতিসাব বৈঠকের মাধ্যমে সবগুলো অন্তর থেকে মুছে সুন্দর, পরিচ্ছন্ন মন নিয়ে ভালবাসা মিশ্রিত সম্ভাষণের মাধ্যমে বিদায় নিতে হবে।
৫. আপস্-রফা এবং অভিযোগ খণ্ডন
প্রথমত, এক মুসলমান অন্য মুসলমানকে কোনো অভিযোগের সুযোগই দেবেন না। তার দ্বারা অন্য ভাইয়ের মনে যাতে কোনো কষ্ট না লাগে, এ জন্যে তার সর্বদা চেষ্টা করা উচিত।
দ্বিতীয়ত, আপন ভাইয়ের ব্যাপারে প্রত্যেক মুসলমানেরই দরাজদিল হওয়া উচিত। রাসূলে কারীম (সাঃ)-এর উন্নত নৈতিক শিক্ষার প্রতি তার লক্ষ্য রাখা উচিত এবং কারো বিরুদ্ধে যাতে অভিযোগ সৃষ্টি না হয় আর হলেও তা অবিলম্বে অন্তর থেকে দূর করার জন্যে তার যথাসাধ্য চেষ্টা করা উচিত।
তৃতীয়ত, উক্ত প্রচেষ্টার পরও যদি অভিযোগ সৃষ্টি হয় এবং তাকে বিস্মৃত হওয়া সম্ভবপর না হয়, তবে তাকে মনের ভেতর লালন করা উচিত নয়। বিষয়টি ছোটো হোক বা বড়ো, অবিলম্বে তা আপন ভাইয়ের কাছে অন্তরের এ মলিনতা দূর করার জন্যে অনতিবিলম্বে চেষ্টা করা উচিত।
চতুর্থত, যার বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হবে, তিনি অসন্তুষ্ট হবে না এবং এজন্যে নাসিকাও কুঞ্চিত করবেন না। বরং যে দরদি ভাইটি পেছনে বলাবলি না করে, সামনে এসে বলার জন্যে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা উচিত।
পঞ্চমত, আপন ভাইয়ের মনে কোনো অভিযোগ রয়েছে, একথা জানবার সঙ্গে সঙ্গেই আত্মসংশোধনের চেষ্টা করবে। কারণ, সময় যতো অতিক্রান্ত হয় বিকৃতি ও ততোই দৃঢ়মূল হয়। তাছাড়া যতো তাড়াতাড়ি ফেতনার মূলোৎপাটন করা যায়, ততোই মঙ্গল।
ষষ্ঠত, এক মুসলমান ভাই ত্রুটি স্বীকার করলে তাকে ক্ষমা করে দেয়াই কৰ্তব্য, এ ব্যাপারে কোনোরূপ কার্পন্য করা উচিত নয়। সে কোনো অক্ষমতা পেশ করলে তাকে অক্ষম বলে বিবেচনা করা এবং তার অক্ষমতাটি কুবল করাও কর্তব্য। নীচের হাদিসটি দেখা উচিত।
“যে ব্যক্তি তার কোনো মুসলমান ভাইয়ের কাছে নিজের ত্রুটির জন্যে অক্ষমতা (ওজর)- পেশ করলো, অথচ সে তাকে অক্ষম মনে করলো না এবং তার অক্ষমতাও কবুল করলো না, তার এতোটা গোনাহ হলো, যতোটা অবৈধ শুল্ক গ্রহণজনিত যুলুমের ফলে একজন শুল্ক গ্রহণকারীর হয়ে থাকে।’
অর্থাৎ আপন ভাইকে তিন দিনের বেশি পরিত্যাগ করা কোনো মুসলমানের জন্য জায়েয নয়। যে ব্যক্তি তিন দিনের বেশি বিচ্ছিন্ন থাকলো এবং এই সময়ের মধ্যে মারা গেলো, সে জাহান্নামী হবে।’ (আহমদ, আবু দাউদ; আবু হুরায়রা রা)
দু’জনের মধ্যে যে ব্যক্তি সালামের সূচনা করবে (অর্থাৎ অন্তোষ বর্জন করে আপসের সূত্রপাত করবে) সেই হচ্ছে শ্রেষ্ঠ।’ (বুখারী, মুসলিম; আবু আইউব আনসারী রা)
এ নির্দেশগুলো যথাযথ অনুসরণ করতে হলে লোকদের পারস্পরিক সম্পর্কের মূল্যটা খুব ভালোমতো উপলব্ধি করতে হবে, নিজের অন্তরে ভাই এবং ভাইয়ের প্রেমের আবেগের প্রতি পূর্ণ শ্রদ্ধা থাকতে হবে এবং সেই সঙ্গে সম্পর্কের বিকৃতি কত বড় গোনাহর ব্যাপার সে সম্পর্কেও পুরোপুরি উপলব্ধি থাকতে হবে।
অর্থাৎ ‘যে ব্যক্তি বিরোধ প্রত্যাহার করলো, অথচ সে সত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত, তার জন্যে জান্নাতের মাঝখানে একটি ভবন নির্মাণ করা হয়। আর যে ব্যক্তি তার চরিত্র উন্নত করে নিলো, তার জন্যে জান্নাতের উচ্চতর স্থানে একটি প্রাসাদ নির্মাণ করা হয়।’ (তিরমিযী; আনাস রা.)
অর্থাৎ ‘যে ব্যক্তি বিরোধ প্রত্যাহার করলো, অথচ সে সত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত, তার জন্যে জান্নাতের মাঝখানে একটি ভবন নির্মাণ করা হয়। আর যে ব্যক্তি তার চরিত্র উন্নত করে নিলো, তার জন্যে জান্নাতের উচ্চতর স্থানে একটি প্রাসাদ নির্মাণ করা হয়।’ (তিরমিযী; আনাস রা.)
সংগঠনে ইহতিসাব না থাকার পরিণাম
১. এর ফলে আন্দোলনের গতিশীলতা থাকে না। কেউ যদি আন্দোলনকে পঙ্গু করতে চায়, সেই পারে ইহতিসাবের মত সুন্দর পদ্ধতি ছেড়ে শয়তানের আবিষ্কৃত পন্থা অবলম্বন করতে।
২. পারস্পরিক সম্পর্কে কৃত্রিমতা আসে। কারো ব্যাপারে খারাপ ধারণা রেখে তার সাথে ভ্রাতৃত্বের সম্পর্ক রাখা যায় না। সুতরাং তখন যে সম্পর্কটি গড়ে ওঠে তাতে মেক-আপ লাগানো থাকে। এ জাতীয় মেক-আপ লাগানো সম্পর্কের মাধ্যমে ঈমানের দাবি পূরণ হতে পারে না।
৩. পারস্পরিক আস্থা ও বিশ্বাস কমে আসে। আমাদের সংগঠনের সামগ্রিক কার্যক্রম পরিচালিত হয় আস্থা ও বিশ্বাসের মাধ্যমে। আর তাই যদি আমরা হারিয়ে ফেলি, তাহলে শয়তান সন্দেহের এমন এক পাহাড় তৈরি করে দিবে, যা অতিক্রম করে আস্থা ও বিশ্বাসের সেই সুন্দর রাজ্যে প্রবেশ করতে ব্যর্থ হব।
৪. গীবতের মত মারাত্মক রোগ ছড়িয়ে পড়বে। যে সংগঠনে গীবত চালু হয়ে যায়, সেখানে সুস্থ, সুন্দর ও আন্তরিক পরিবেশ থাকতে পারে না। সেই পরিবেশ আল্লাহর রহমত দ্বারা বেষ্টিত না হয়ে শয়তানের কালো জালে পরিবেষ্টিত হয়ে যায়।
পরিশেষে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের শিখানো ভাষায় আমাদের পারস্পরিক কাঙ্ক্ষিত সম্পর্কের জন্য দোয়া করে ইতি টানতে চাই। সেই কাঙ্ক্ষিত দোয়া দুটো নিম্নরূপ। …
অর্থাৎ হে আমাদের রব! আমাদেরকে এবং আমাদের সে সব ভাইকে ক্ষমা করে দাও, যারা আমাদের পূর্বে ঈমান এনেছেন। আর আমাদের দিলে ঈমানদার লোকদের জন্য কোন হিংসা ও শত্রুতা ভাব রেখো না। হে আমাদের রব! তুমি বড়ই অনুগ্রহশীল ও করুণাময়। (সূরা হাশর: ১০)
সমাপ্ত
Discussion about this post