সক্ষমতা অনুসারে সবাই কুরবানি করছে। হয়ত ভাবনা আসতে পারে, এর মধ্যে আবুধাবিতে ঈদ কোরবানির মধ্যে আলাদা কি আছে? দৃশ্যত এখানে তেমন কোন ব্যতিক্রম নেই, তবে নাগরিক জীবন, সরকারের ভূমিকা ও প্রস্তুতি নিয়ে কথা বলতে গেলে অনেক কিছুই বলা যাবে। তারই আলোকে আজকের এই লেখা আবুধাবির ঈদ।
আজ ২০২০ সালের আগস্টের ১ তারিখ। আরব দেশে গতকাল ৩১শে জুলাই শুক্রবার আবুধাবিতে ঈদ উল আযহা অনুষ্ঠিত হয়ে গেল। করোনা বিপদের শুরু থেকেই আবুধাবি সরকার নড়েচড়ে বসে। করোনা আক্রান্ত কোন রোগীর চিকিৎসা না পাওয়ার কোন খবর আজো চোখে পড়েনি। রোগীকে আলাদা করে নির্দ্দিষ্ঠ ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে থাকা, খাওয়া, ইন্টারনেট সবই ফ্রি। যাতে রোগী মানসিক সুস্থতা ও নিরাপত্তা পায়। বর্তমানের ঠিক আজকের এই সময়েও আবুধাবিতে রোগীকে হাসপাতালে দৌড়াতে হচ্ছেনা, উল্টো পুলিশ মেডিক্যাল টিম নিয়ে ভবন ঘেরাও করে এক এক জন করে রোগী তল্লাশি করে ফিরছে। রাতদিন ২৪ ঘণ্টাতেই স্বাস্থ্য কর্মীরা ব্যস্ত বরং রাত্রি বেলায় কাজ বেড়ে যায়, বাসা-বাড়ী, ভবন ও মহল্লায় হানা দিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে করোনা রোগীর সন্ধানে!
- আরো পড়ুন…
- কালোজিরা : নিয়ত করে খেলে যে বিচি রোগ সাড়ায়
- কঠোর চিত্তের সন্তান! পিতা-মাতা সদা ভাগ্য বিড়ম্বিত হয়
- ‘মল’ কাণ্ডে চেয়ার ও হাল জমানার WC
সরকারের এত আন্তরিকতা প্রকাশের ভিন্ন দিকে আরেক চিত্র দেখা যায়। পুলিশ প্রশাসন সরকার ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের নির্দেশ পালনে খুবই সতর্ক ও কঠোর। করোনা সংক্রান্ত সতর্কতা না মানলে চড়া মাত্রার জরিমানা চলছে সর্বত্র। একটি উদাহরণ দেই, মুখে মাস্ক না পড়ে জনসম্মুখে প্রকাশ্যে চলাফেরার অপরাধ হিসেবে জরিমানার পরিমাণ হল বাংলাদেশী প্রায় ৭০ হাজার টাকা। এই বৃহৎ অঙ্কের ভয়ে সবাই মাস্ক পড়তে বাধ্য হয়। টাকাটা নগদ না পরিশোধ না করলেও চলবে। এর বিপক্ষে আপত্তি জানানোর জন্য আদালতও আছে, সেখানে মাফ করলে ভিন্ন কথা কিন্তু এই জরিমানা না দিয়ে দেশ ত্যাগ করার চিন্তা কল্পনাও করা যাবে না। তার উপরে কোরবানি উপলক্ষে জারী করা হয়েছে নাগরিক সীমাবদ্ধতা। বন্ধু বান্ধব আত্মীয় স্বজনকে ঘরে দাওয়াত দিয়ে খাওয়ালে যিনি খাওয়াবেন তার জরিমানা বাংলাদেশী টাকায় দুই লাখ ত্রিশ হাজার আর যারা খেতে যাবেন তাদের গুনতে হবে তার অর্ধেক। এই পরিস্থিতিতে কার মনে কোরবানি করার স্বাদ থাকবে! কিন্তু না, যাদের কোরবানি করার ইচ্ছে আছে, তাদের জন্যও সরকার সুন্দর ব্যবস্থা করে রেখেছে। এদেশে ধর্মীয় ও নাগরিক ইচ্ছাকে মূল্য-দেয়। এটাই ছিল আজকের মূল বক্তব্যের বিষয়।
আবুধাবিতে ঈদ
আরব দেশের মানুষ ছাগল, ভেড়া, দুব্বা কোরবানি দিতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। গরু কোরবানি এরা তেমন একটা করেনা। আবার আবুধাবিতে যত্র তত্র প্রাণী জবাই করতে পারে না। এটাতে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। নাগরিক এই সুবিধার জন্য রয়েছে সরকারী আধুনিক কসাই খানা। সেখানে নিয়োগ দেওয়া আছে সিদ্ধহস্ত দক্ষ কসাই, পরিচ্ছন্নতা কর্মী ও ডাক্তার। জবাই যারা করে তারা সবাই মুসলিম এবং নাম মাত্র চার্জেই, সহসা তারা গোশত প্যাকেট করে বাহিরে অপেক্ষমাণ মালীকের কাছে ধরিয়ে দেয়। তবে ডাক্তারি পরীক্ষায় যদি প্রমাণিত হয় প্রাণীটি অসুস্থ, যা মানুষ খেতে পারবে না। তাহলে তাকে প্রাণীর গোশতের মায়া ত্যাগ করে ফরে যেতে হয়। এটাই শুধু একটু রিস্ক। তবে এই রিস্ক শুধু ক্রেতার নয় যারা প্রাণী বিক্রেতা তাদেরও ধকল সইতে হবে। তাই রুগ্ন প্রাণী তেমন একটা বিক্রি হয়না।
করোনার কারণে এ বছর কোরবানি পদ্ধতিতে কিছুটা ভিন্নতা এনেছে। সরকারী কসাই খানাতে প্রাণী জবাই করতে গেলে, গাড়ী নিয়েই যেতে হবে, গাড়ীতেই থাকবে প্রাণী। নিজের গাড়ী থেকেই নিয়োজিত কর্মীরা প্রাণী নিয়ে জবাই করে গাড়ীতে ফিরিয়ে দিবে। নিরাপদ দূরত্বের হিসেব বজায় থাকবে না বলে, হেটে যাওয়া মানুষের জন্য সুযোগটি এবছর ছিলনা। করোনা মোকাবেলা আবুধাবির ঈদ ও নাগরিক সুবিধা
উল্লেখ্য কসাই খানাটি আমার বর্তমান স্থান থেকে প্রায় এক কিলোমিটারের মত দূরত্ব। প্রত্যূষে আমি নিজেও একবার হেটে গিয়েছিলাম সুযোগ নিতে কিন্তু পারিনি মূলত তখনই জানি নতুন নিয়মের খবর। ফলে সস্ত্রীক গাড়ী নিয়ে বের হলাম কোরবানি করতে! নতুন অভিজ্ঞতা! কিন্তু ততক্ষণে গাড়ির লাইন এক কিলোমিটার পেরিয়ে আমাদের এলাকা অবধি লম্বা হয়ে গেছে।
এদেশে প্রাণী বাজারের সাথেই বানানো হয় কসাই খানা। তাই প্রাণী কিনেই সোজা কসাই খানায় যাওয়া যায়। এ ধরনের সুব্যবস্থা থাকে। কিন্তু আমরা যারা কোরবানি করার জন্য গাড়ী নিয়ে বের হয়েছি তারা আগা গোরাই নিজের গাড়ীর মধ্যেই অবস্থান করতে হবে। করোনা সতর্কতার নির্দেশিত পথ অনুসরণ করতে হবে। সর্বত্র নিরাপদ দূরত্ব ও ব্যক্তিগত সতর্কতা পালন করতে হবে। নয়তে উল্টো কোরবানির সাথে জরিমানাও জটতে পারে।
আমার প্রতিদিনকার দেখা সেই এক কিলোমিটার দূরত্বের রাস্তাকে পুলিশ টিম কৌশলে ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে, এক রাতের ভিতরেই প্রায় ছয় কিলোমিটারের মত লম্বা রাস্তা বানিয়ে নিয়েছে! যাত্রী সমেত এসব গাড়ী ছাগলের জন্য বানানো প্রতিটি দোকানের সামনে দিয়েই যাবে। পছন্দনীয় ছাগল, ভেড়া, দুব্বা কিনে নিয়ে টুপ করে গাড়ীর ভিতরে ঢুকিয়ে নিয়ে সামনে চলতে জবে। বেশীর ভাগ মানুষ প্রাণীদের পাত-বা বেঁধে গাড়িতে ঢুকিয়ে রাখছে। তারা কষ্টে চটপট করছে। গাড়ীতে বসা ম্যাডাম ছিলেন একটু দয়ালু প্রকৃতির! তিনি এভাবে প্রাণী বহন করতে ইচ্ছুক নন। সুশ্রী সুন্দর প্রাণীটিকেও যাত্রীর মত করেই কসাই খানায় নিতে চায়! আমিই বাধ সাধলাম! পায়খানা-প্রস্রাব করতে পারে। উপস্থিত বুদ্ধিতে তিনি পলিথিন দিয়ে একটি নিরাপদ প্যাম্পাস বানিয়ে ছাগলের পিটে যুতসই জায়গা বরাবর আটকে দিলেন।
পাঁচ মিনিটের হাটা পথের দূরত্বকে গাড়ীর জন্য অনেক লম্বা বানানো হয়েছে। প্রায় তিন ঘণ্টা লেগেছে কসাই খানায় ঢুকতে। গাড়ীতে ঢুকেই ছাগলটি দুই একবার ডাক দিয়েছে। বুঝার চেষ্টা করছে সে এখন কোথায়। এসির ঠাণ্ডা ও আমাদের ব্যবহারে সে একটু ধাতস্থ হয়েছে। প্রাণীদের অভ্যাস আমি খুব উপভোগ করি। বারে বারে সেটি আমার কান, মাথা, ঘাড়, কাপড় বরাবর তার নাক এনে ঘ্রাণ নিচ্ছে। ঘাড় ও মাথায় জিহ্বা দিয়ে আদর করছে। একই কাজ সে ম্যাডামের সাথেও করছে। পরে বুঝলাম সে আসলে আমাদের মুখ দেখতে চাচ্ছে। মুখ দেখালাম। নাক, কপাল, চোখ বরাবর তার মুখ এনে কয়েকবার ঘ্রাণ নিল এবং একই কাজ ম্যাডামের সাথেও করল। একটু আদর করে দিলাম। অতঃপর সে নিশ্চিত হয়ে বাহিরের দৃশ্য দেখায় মন দিল।
করোনা পরিস্থিতি মোকাবেলায় এদেশে সরকার যেমন আন্তরিক, আইন প্রয়োগকারী সংস্থাও তেমন কঠোর। ঈদ মুসলমানদের অন্যতম একটি গুরুত্বপূর্ণ দিন। তাই এই দিনটিও পালন করতে হবে আবার রোগ থেকে নিরাপদও থাকতে হবে। এধরনের সুষ্ট ব্যবস্থাপনা সরকারের আন্তরিকতার মাধ্যমেই সম্ভব। আমিরাত সরকার সেটাও করে রেখেছে। কোন ব্যাপারে মানুষের ভোগান্তি আসে ঘটনার সময়ে, বদনাম হয় ঘটনার পরে, যে দাগ আর মুছে দেয়া যায় না। এদেশে ভোগান্তির পিছনের কারণগুলো চুল ছেড়া বিশ্লেষণ করে যথাযথ পদক্ষেপ নেয়া হয়। জুলাই মাসের প্রখর সূর্যতাপের এই দেশে হাজার হাজার গাড়ির সমারোহ ও দলে দলে মানুষের উপস্থিতি ও অগণিত প্রাণীর কোরবানির এই কর্মযজ্ঞ চোখে না দেখলে বুঝা যাবে না। নাগরিক জীবনের প্রতি সরকারী চিন্তাধারা কত নিখুঁত ও সুদূর প্রসারী।
Discussion about this post