উদ্ভিদের সাথে কথা বলতে ভাল লাগে! আমি যেন তাদের মনের কথা বুঝতে পারি। তাদের আপন করে নিতে তৃপ্তি লাগে। সে কারণে উদ্ভিদ বিজ্ঞানের ছাত্র হিসেবে নিজেকে গর্ববোধ করতাম। স্কুল জীবন থেকেই যেখানে ভিন্ন ধরনের উদ্ভিদ দেখতাম তার ছবি তোলার চেষ্টা করতাম। ঘন জঙ্গলে ঘুরে বেড়ানো, গহীন অরণ্যে ঢুঁ মারা আমার নিত্য খাসিয়তের অন্যতম। আমার বন্ধুরা এই বিদঘুটে চরিত্রের জন্য হাসাহাসি করত। তখনো ক্যামরা ও রীল সহজ লভ্য ছিলনা, বন্ধুরা তোলে নিজের ছবি আর আমি তুলি বনের ছবি! সবাই হাসবে না তো, কি উৎসাহ দিবে?
যে দেশেই গিয়েছি, সুযোগ পেলে সেদেশের পার্কে অবশ্যই পৌঁছেছি। আরব দেশে আমাদের মত সবুজ বন নাই কিন্তু নয়নাভিরাম পার্ক আছে। আন্তর্জাতিক দুনিয়ার বিচারে এসব পার্ক চোখ ধাঁধানো। অর্থ থাকলেও সবার চিত্ত সমান নয় কিন্তু আরব দেশে বিশাল ঘর বানিয়ে সেখানে সেন্ট্রাল এসি দিয়ে কোথাও শুকনো, কোথাও আর্দ্র, কোথায় সেঁতসেঁতে, কোথাও কাদার কৃত্রিম পরিবেশ সৃষ্টি করে গাছ পালন করার বহু দৃশ্য পর্যটকেরা দেখে থাকে।
মরুর বুকেও আছে বহু পার্ক। শিশু থেকে বুড়ো সবার জন্য চিত্ত বিনোদনের ব্যবস্থা এসব পার্কে থাকে। থাকে লাখ লাখ মানুষের অবস্থান করার ব্যবস্থা। এসব পার্কে স্ত্রী-পুত্রকে নিয়ে ঘুরতে গিয়ে যখন আমি গাছের ছবি তোলার পিছনে সময় দেই, তখন তারাও ত্যক্ত-বিরক্ত হয়ে উঠে। আমার আর্কাইভে এ ধরনের হাজার হাজার ছবির সমারোহ রয়েছে।
উদ্ভিদ বিজ্ঞানের ছাত্র হিসেবে জানতে পেরেছিলাম ঢাকার বিখ্যাত জমিদার নরেশ নারায়ণ রায়ের কথা। তিনি ছিলেন উপমহাদেশের সবচেয়ে বড় উদ্ভিদ প্রেমিক মানুষ। তার জমিদারী আয়ের সমুদয় অর্থ খরচ করে ১৯০৯ সালে গড়ে তুলেছিলেন পুরানো ঢাকার ওয়ারীর পাশেই ‘বলধা গার্ডেন’। পৃথিবীর সকল মহাদেশ সেঁচে, দুনিয়ার দুর্লভ গাছের সমাহার ঘটিয়েছিলেন এই বাগানে। টমেটোর মত সুস্বাদু সবজি তার বাগানের জন্যই তিনি দক্ষিণ আমেরিকা থেকে প্রথম উপমহাদেশে নিয়ে আসেন।
অপেশাদার লেখকেরা একটি কথা লিখতে গিয়ে কখনও ঘটনার অলি গলিতে হারিয়ে যায়, আমারও হয়েছে তাই! পাঠক, আমি বলছিলাম ঢাকা শহরের পার্কের কথা।
বিদেশের বহু পার্ক দেখার সুযোগ ঘটলেও, ঢাকার গুলশান পার্ক কিন্তু সম্পূর্ণ ভিন্ন। একটি লেকের চারিধারকে কেন্দ্র করে এই ছোট্ট পার্কটি গড়ে উঠে। গুলশানের এই স্থানে ঢাকার অভিজাত পরিবার ও বিভিন্ন দেশের এমব্যাসির গুলোর পরিবার পরিজনকে এখানে স্বাচ্ছন্দ্যে ঘুরতে দেখা যাবে। ঢাকা সেনানিবাসের অনেক অফিসারদের দেখা যাবে এখানে। কোন টিকেট নাই, গাড়ীর বিদঘুটে হর্নের কোলাহল মুক্ত এই পরিবেশটি ঢাকার ব্যস্ততম জীবনের ভিন্ন ধরনের একটি আবহ সৃষ্টি করে। নানা প্রজাতির উদ্ভিদে ভরপুর এবং অনেক গুলো গাছ পুরানো দিনের সাক্ষী হয়ে ঠায় দাড়িয়ে আছে। এসব গাছের নিচে, ছায়ার আশ্রয়ে, নিরিবিলি পরিবেশে শারীরিক ব্যায়ামের কাজটি দারুণ ভাবে করা যায়। নিবিড় ছায়ায়, পায়ে চলা মেঠো পথের ব্যবস্থা আছে এখানে। ঝোপ-ঝাড়, গাছের গুড়ির ফাঁকে, যত্র তত্র লুকিয়ে আছে মাইক। চলার পথে সর্বত্র শুনতে পাওয়া যায় দেশাত্মবোধক গানের মৃদু-ধ্বনি। পাখির কলবরে সদা চঞ্চল এই পার্কটি, প্রকৃতি প্রেমী যে কোন মানুষের মন কেড়ে নেবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা দিতে আসা ছেলেকে নিয়েই এ পার্কে ঘুরতে গিয়েছিলাম। অতীত অভ্যাসের মত বহু ফটো তুলেছি এবং নয়ন ভরে উপভোগ করেছি তার স্নিগ্ধ নীরবতা!
এই পার্ক বানাতে সরকারকে অগণিত টাকা খরচ করা লাগেনি। বিদেশের মত মিলিয়ন টাকা ব্যয় করে পানি সিঞ্চনের ব্যবস্থা রাখতে হয়নি। আমাদের দেশের জলবায়ু, পার্ক ও উদ্যানের জন্য খুবই উপযোগী। এই পরিবেশেই পার্কের গাছ গুলো রোপণ করা হয়েছে। শুধুমাত্র সাবধানতা ও আদরের সাথে পরিচর্যা করাই মূল কাজ। এখানে সেটিই করা হয়েছে, তাই এর আভ্যন্তরীণ দৃশ্য এত সুন্দর, এত মনোমুগ্ধকর। গাছপালা আমরা হরদম দেখি, তাদের কখনও উৎপাত হিসেবে বিবেচনা করি বলে, আমাদের চোখগুলো এসব দৃশ্যে হয়ত ভিন্ন বিশেষত্ব খোজে পায় না। তবে পৃথিবীর যে কোন পর্যটকের দৃষ্টিকে নিশ্চিতই আটকাবে, কোন সন্দেহ নেই। অথবা, অনুধাবন করতে আমার মত একটি বিদঘুটে মনের দরকার হবে। আল্লাহ কত দয়া করে আমাদের কে এই ধরনের একটি উত্তম জলবায়ু দান করেছেন, যার মূল্য বুঝা আমাদের পক্ষে কোন দিনই সম্ভব হয়নি! ইবনে বতুতা অনুন্নত যোগাযোগের এই বাংলাদেশের পরিবেশ-প্রকৃতি দেখে বলেছিলেন, “এটা একটা সম্পদে ভরা এক দোযখ’।
আগেই বলেছিলাম বলধা গার্ডেনের কথা। উদ্ভিদবিদ্যায় যারা পড়ে তাদের জন্য এই বাগানে বহু বিরল প্রজাতির গাছ রয়েছে। এখানে বিরল মানে বিদেশী গাছ। গবেষণা ও লেখাপড়ার জন্য বিদেশী গাছ, হাতের কাছেই থাকে বলে এই বাগান শিক্ষার্থীদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ স্থান। যেহেতু আমি উদ্ভিদ প্রেমী মানুষ, যেহেতু আমি উদ্ভিদ বিজ্ঞানের ছাত্র, যেহেতু আমি বলধা গার্ডেনের গুরুত্ব বুঝি, সেহেতু আমার চিন্তাই ছিল, সুযোগ পেলেই এই বাগান দেখব ও ফটো তুলব। সুযোগ পেয়েও যাই এবং পিতা-পুত্র দু’জনেই ছুটে যাই পুরানা ঢাকায় ওয়ারী এলাকায়।
চারিদিকে উঁচু দেওয়াল ঘেরা এক জায়গায় হাজির হই। যার দেওয়ালে লিখা ছিল এটা সরকারী গুরুত্বপূর্ণ জায়গা তাই পোষ্টার লাগানো নিষেধ। চারিদিকে ঘুরে-ফিরে অবশেষে সেই ঘেরা জায়গার ফটকে উপস্থিত হই। গেইটের উপরে দুই ইঞ্চি আকারের ছোট্ট দুটি শব্দ ‘বলধা গার্ডেন’! স্বাভাবিক ভাবে এই লিখা নজরে পড়বেনা। জোড় করে সন্ধান করতে হবে! এত বড় বাগানের এত ক্ষুদ্র সাইন বোর্ড দেখে তাজ্জব হলাম! ভিতরে ঢুকার জন্য ফি দিতে হবে ‘ত্রিশ’ টাকা। বুঝতেই পারলাম, এই গুরুত্বপূর্ণ স্থানটি রক্ষার করা জন্য সরকার খুবই সচেষ্ট। হয়ত আগ্রহী মানুষদের সুবিধা দিতেই বাগানের নামটি ছোট অক্ষরে লিখিত এবং চাঁদার ব্যবস্থাও রাখা হয়েছে।
ঢুকার মুখেই বড় অক্ষরের একটি লেখা নজর পড়ল, ‘এখানে অশ্লীল কাজ সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ’! ছেলে নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ জায়গা দেখতে এসে এ ধরনের পোষ্টার দেখে মতিভ্রম হল এবং ভাবলাম, দেশে কবেই বা অশ্লীল কাজ আইন শুদ্ধ ছিল! কেন তবে এই পোষ্টার! যাই হোক যথারীতি ক্যমরা হাতে নিলাম। কয়েকজন মানুষের চলাচলে কেমন জানি আচরণ পরিলক্ষিত হল। তাদের কেউ রান চুলকাচ্ছে, কেউ পাছা! হাতে বিড়ি, মুখে পান, দাড়ি-মোচে একাকার। চোখে-মুখে একরাশ বিরক্তিকর চেহারা দেখে মনে হলনা, এরা ত্রিশ টাকা চাঁদা দিয়ে এই বাগানে ঢুকেছে!
একটু পর পরই বড় অক্ষরের সেই নোটিশ নজরে পড়ে ‘এখানে অশ্লীল কাজ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ’। যাই হোক, বাগানে ঢুকার ডান পাশেই নরেশ নারায়ণের সমাধিফলক। কি লেখা আছে তা পড়ার আগ্রহ হল। সামনে আর আগানো গেলনা, বিশ্রী ভাবে বসে আসে দু’জন তরুণ-তরুণী। ডানে তাকালাম আরো বিশ্রী পরিবেশ। বামে তাকালাম, মোচ ওয়ালা একজন সামনে দাড়িয়ে আড়াল করতে চাচ্ছে আরেক জোড়া কপোত কপোতীকে!
পিছনে চলে আসতে বাধ্য হলাম, ভিন্ন একটি রাস্তা ধরলাম। সুন্দর পরিবেশ, নাম না জানা বৃক্ষের সাড়ি, বাদুরের চিৎকার। বেশীর ভাগ ছোট বৃক্ষকে পিঞ্জরে বন্ধী করে রাখা হয়েছে! হয়ত নিরাপত্তার জন্য। হাতে ক্যামরা লোকেশন সই করলাম। ক্যামরা স্বয়ংক্রিয়ভাবে নড়াচড়ার যায়গাগুলো ফোকাস করল। জঙ্গলের ভিতরে জোড়ায় জোড়ায় ভিড়ে সেটে আছে তরুণ-তরুণী যুগল। খোলা চোখে অত ভিতরের দৃশ্য খেয়াল করিনি। ক্যামরা ক্ষুদ্র নড়াচড়াকেও ধরে ফেলে। সামনের দৃশ্য বাদ দিয়ে, এদিকে ওদিকে ঘুরে অন্তত একটি ফটো তোলার চেষ্টা করলাম। ব্যর্থই হলাম। যে ফটো, যেভাবেই তুলি না কেন সর্বত্র নোংরামি, অশ্লীল, কদর্য এক যুগলের ছবি উঠবেই! পাশে ছেলেকে নিয়ে বিব্রত-বোধ করলাম। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে এসেছে সে। আজকে হয়ত তার পিতা সাথে আছে কিন্তু পিতা ছাড়াও তাকে এ ধরনের দৃশ্য এই নগরে আরো অনেক দেখতে হতে পারে। পাশ্চাত্যে যেসব ছাত্র উচ্চ শিক্ষা নিতে যায় তারা আরো বেশী দেখতে পায়। তাই স্বাভাবিক হয়ে তাকে কিছু বাস্তব পরামর্শ দিয়ে, গার্ডেনের আরো ভিতের যাওয়ার ইচ্ছা পরিত্যাগ করে, যথাসম্ভব তাড়াতাড়ি বলধা গার্ডেন ত্যাগ করলাম। ফিরার পথে দেখলাম, এক ভুক্তভোগী কয়লা দিয়ে লিখেছে, ‘অশ্লীলতা না করার জন্য ধন্যবাদ’!
দেশে অশ্লীলতা ব্যাপক, সুস্থ মানুষের বসবাসের জন্য দেশ ছোট হয়ে যাচ্ছে। সরকারী নিয়ন্ত্রণে থাকা একটি জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ স্থানের আজ এই দশা! টিকেট কেটে ভিতরে ঢুকে অশ্লীলতা উপভোগ করার যে আয়োজন সুকৌশলে করা হয়েছে। এসব কি পরিকল্পিত? নাকি ব্যবসায়ের একটি নতুন আইডিয়া? বুঝা গেলনা। যে জায়গাটি ছাত্রদের গবেষণার জন্য উন্মুক্ত থাকার কথা সেটা আজ যৌন বিনোদনের জন্য সুকৌশলে ব্যবহৃত হচ্ছে।
Discussion about this post