দশ মিটার দূরে থাকতেই স্মার্ট যুবককে দেখে, কোথায় দেখেছি দেখেছি বলে মনে হল।
সহাস্য বদনে সামনে এসে সালাম দিলেন, ‘আসছালামু আলাইকুম’ ভাই। কেমন আছেন? আপনার কোম্পানির বাংলাদেশী মানুষটার অকাল মৃত্যুতে বেশ খারাপ লেগেছিল…
ভাবছি তাইতো! আমি এখনও ওনাকে না চিনলেও তিনি ঠিকই আমাকে চিনে ফেলেছেন! যাই হোক মুসিবতে তো আমি পড়েছি তাই নাম-পরিচিতি আমাকেই উৎরাতে হবে। চেনা জানা মানুষকে সালামের শুরুতেই ভুলে যাওয়া নাম জিজ্ঞাসা করাটা বড় বিব্রতকর, তাই আমিও শুরু করলাম,
ওয়ালাইকুম সালাম, তা আপনি কেমন আছেন? অনেক দিন দেখিনা, কোথায় ছিলেন?
কেন আপনাকে তো প্রথমেই ফোন করে জানিয়েছিলাম, সামসাং কনাস্ট্রাকশন কোম্পানিতে ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে আমার চাকুরী হয়ে যাবার খুশীর কথাটি!
ওহ, হো! তাই তো, ভুলে গিয়েছিলাম, দুঃখিত। কণ্ঠ শুনে মনে হয়, তাকে আমি চিনিই তো! আবার ভাবছি, চিনলে নাম মনে আসছে না কেন? ভিতরে পেরেশান হচ্ছি, স্মরণ শক্তির দুর্বল সামর্থ্যের কথা ব্যাপার নিয়ে। কিভাবে যেন সব ভুলে যাচ্ছি। এ ধরনের পরিস্থিতি সামাল দিতে, গুরুজী মহাজাতকের একটি পরামর্শ ছিল, ব্রেন কে আলফা-বিটা লেভেলের গণ্ডি পার করে দিয়ে, যথাসম্ভব গামা লেভেলে পৌছাতে হবে। তাহলে ত্রিশ বছর আগের ভুলে যাওয়া নামও মনের পর্দায় ছল ছল করে ভেসে উঠবে।
অগোছালো কথার ফাঁকতালে, ঠাণ্ডা মাথায় ব্রেন কে অটো-সাজেশন দেবার চেষ্টা করলাম। কিন্তু সুযোগ কই? কথার উত্তর দিব নাকি ব্রেনকে সাজেশন দিব, বৎস একটু কোমল হও। আরে ধ্যাত! গত দুই মাস, চার মাস, ছয় মাস, এক বছর আগে কে কে চাকুরীর কথা জানিয়েছিল, এমন কোন ব্যক্তির কথাই মনে আসল না! না এভাবে হুলুস্থুল পরিবেশে ব্রেনকে সাজেশন দেওয়া চলেনা। অগত্যা সাজেশন পর্ব সেখানেই থামিয়ে, হতাশ হয়ে কাজের তাড়া আছে বলে ভালোয় ভালোয় কেটে পড়তে চাইলাম। ঠিক সেই মুহূর্তে একটি মাথায় একটি বুদ্ধি ভর করল। দেরীতে হলেও অটো সাজেশন ভিন্ন ভাবে কিছুটা কাজ দিচ্ছে বলে মনে হল।
জানালাম, তোমার ফোন নাম্বার টা হারিয়ে ফেলেছি, আমাকে একটা মিস কল দাও তো। চেনা জানা মানুষের হারিয়ে যাওয়া নাম-পরিচয় উদ্ধারে এটা একটা অন্যতম ডিজিটাল বুদ্ধি। তিনি জানালেন, মোবাইলটা গাড়িতে, আছরের নামাজের জন্য মসজিদে এসেছিলেন, গাড়িতে পৌঁছেই মিস কল দেবেন। এই মূহুর্তে তার নাম-পরিচিত জানলে বিদায় নেওয়ার সময় অন্তত নামটা ধরে বিদায় নিলে বিষয়টি সুখকর হত কিন্তু কি আর করা! তাকে তো আর নিজের দুর্বলতার কথা বলতে পারছিনা যে, তুমি চেনা-জানা মানুষ কিন্তু তোমার নাম পরিচয়টা এখনও মনে করতে পারিনি। অগত্যা নিজ গন্তব্যে রওয়ানা হলাম।
পথ চলছি আর ভাবছি, তিনি কে হতে পারেন? ভবিষ্যতে এ ধরনের পরিস্থিতিতে পড়লে কিভাবে নাম-পরিচয় উদ্ধার করা যাবে। ব্রেনকে আবারো প্রশ্ন করছি, কেমন এমন হল? কেন স্মৃতি থেকে এই ব্যক্তির নাম-পরিচিত হারিয়ে গেল ইত্যাদি। মোবাইল রিং এর কারণে সম্বিৎ ফিরে পেলাম। জয়নুল আবেদিন সাহেব ফোন করেছেন, দীর্ঘদিন মানুষটি কোথায় যেন হারিয়ে গিয়েছেন। রিং চলতেই রইল তাই ফোন ধরলাম, সালাম দোয়া হল, প্রশ্ন করলাম কতদিন দেখা-দেখি হয়না? তিনি আশ্চর্য কণ্ঠে জানালেন, বলেন কি? কিছুক্ষণ আগেই তো কথা বললাম, আপনি না আমাকে মিস কল দিতে বলেছিলেন?
ওহ! এবার সত্যিই লজ্জিত হলাম। আবারো মস্তিষ্কের গোলযোগ। মগজের কোথায় যেন সমস্যা হয়েছে তাই বিরাট প্যাচ লেগেছে। অটো সাজেশনের মাধ্যমে ব্রেনকে কাজ দিতে গিয়ে, চিন্তায় জঞ্জালে আটকা পড়ে, মিস কলের কাহিনী ভুলে গিয়েছিলাম। যাই হোক, নাম তো পাওয়া হয়েছে কিন্তু তারপরও গোলমেলে ব্যাপারটি থামে নি। ভাবছি তার যেন চেহারাটা কেমন জানি ছিল? কল্পনাতে ছবি আঁকা শুরু করলাম। নাকের পার্শ্বে একটি তিল ছিল, হ্যাঁ সেই তিল আজে আছে। চোখের উপরে একটা কাটা দাগ ছিল! ও হ্যাঁ! বুঝতে পেরেছি, আরে ইনি তো ইঞ্জিনিয়ার জয়নুল আবেদিন। আগে গাল ভরা দাড়ি ছিল এখন মুখমণ্ডল একেবারেই তেল তেলে! এই ভাবনায় নিজের উপরে গোস্বা উঠল, কেন তাকে চিনতে এত দেরী হল!
বাকী ঘটনা সংক্ষিপ্ত। অতীতের একটি ঘটনার কথা মনে পড়ে গেল। আছরের নামাজের পরে, মসজিদের সামনে কেউ একজন আমার সাথে দেখা করতে চায়। বেশী অপেক্ষা করতে হয়নি। একটি ছেলে তার কিছু বন্ধু-বান্ধব সহ সামনে এসে হাজির। তারা তাবলীগ জামায়াত করে, আমার সাথে বহুদিনের পরিচয়। জয়নুল আবেদিন সদ্য পাশ করে বের হওয়া মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার, তার একটি চাকুরী খুব দরকার। আমাদের কোম্পানিতে ব্যবস্থা করা যাবে কিনা এটাই ছিল মূল প্রশ্ন।
সদ্য পাশ করে বের হলেও জয়নুল কে দেখে ত্রিশ বছরের বেশী বয়সী বলে মনে হল। গাল ভরা দাড়ি। দাড়ির পরিধি কানের দুপাশ বেয়ে নিচের দিকে গোলাকার হয়ে আছে। মনে হল দৈনন্দিন চিরুনির কাজটা দুই হাতের দশ আঙ্গুল দিয়ে সারানো হয়। দাড়ি রাসুল (সা) সুন্নত ও মুসলমানদের অন্যতম পরিচিতি। কিন্তু জয়নুল কবে সেলুনে গিয়েছে সেটা তার দাড়ির অবয়ব দেখে বুঝা মুস্কিল। এই হালতে কোথাও ইন্টারভিয়্যু দিলে দুনিয়াবি কাণ্ডজ্ঞানে অনুমান করা যায় যে, নির্ঘাত চাকুরী হবে না! কারণ একটাই, সেটা নিশ্চিত দাড়ি নয়, সেটা হল নিজের প্রতি তার চরম অবহেলা! এ ধরনের মানুষের দাড়ি না থাকলেও, কোনদিনই চাকুরী হয়না। যে নিজেকে মূল্য দেয়না সে অন্যের সম্পদকেও মূল্য দেয়না। তরুণ ছেলে দাড়িকে একটু যত্ন করলে, লম্বা দাড়িতেই তাকে প্রিন্সের মত লাগত। মনে বহু প্রশ্ন উকি মারছিল, সে যখন দুনিয়াকে এত অবহেলা করে, তাহলে চাকুরীর দরকার টা কি ছিল? সাধু-সন্ন্যাসীর মত জীবন ধারণ করলেও তো চলত!
দাড়ি সম্পর্কিত কোন সাজেশন তাকে দিতে পারলাম না। সেটা আমার জন্য হিতে বিপরীত হতে পারে। তাছাড়া আমি সবেমাত্র দাড়ি রাখার প্র্যাকটিস শুরু করেছি এবং দাড়ির সীমানা প্রাচীরের মানদণ্ডের চেয়ে একটু খাট বলে অনেকেই ইতিমধ্যে সমালোচনা শুরু করে দিয়েছিলেন। যদিও ক্লিন শেভ জমানায় কোনদিন এ ধরনের পরিস্থিতির মোকাবেলা করিনি। তাই আমার এই চরম অধঃপতন পরিস্থিতিতে লম্বা দাড়ির জয়নুলকে পরামর্শ দেওয়া একেবারেই বে-মানান!
যাক, আমিতো তার জন্য একটি চাকুরী জোটাতে চেষ্টা করেছি কিন্তু সাড়ে তিন বছরেও তার কোথাও চাকুরী হয়নি। কেন হয়নি, জানতেও চাইনি। শুরুতেই তাকে আমি গাল ভরা দাড়ির মানুষ হিসেবেই দেখেছিলাম। দাড়ি শুন্য পরিস্থিতির কথা কখনও ভাবিনি। তাই আমার ব্রেন বারবার Fatal Error চিহ্ন দেখাচ্ছিল। কোন কারণে সে দাড়ি ফেলে দিয়ে ক্লিন হয়ে গিয়েছিল। কেন এমন হল সে প্রশ্ন তো তাকে করতাম কিন্তু শত চেষ্টাতে তো তার নাম-পরিচয় উদ্ধার করতে পারিনি। অন্তত তার আচরণে এটাই প্রমাণ করেছিল যে, তার দাড়িটা তার জন্য কিছু বিঘ্ন সৃষ্টি করেছিল। তাই চাকুরী কিংবা কোন বৈষয়িক স্বার্থ অর্জনের জন্য তাকে সে দাড়ি ফেলে দিতে হয়েছিল। তাকে বলা যেত, তার মত আনস্মার্ট মানুষ যতই যোগ্য হউক, চাকুরী হবার কথা নয়, এখানে দাড়ি কোন বিষয় ছিলনা।
আল্লাহ বলেছেন, তিনি নিজে সুন্দর তাই তিনি সুন্দরকে পছন্দ করেন। সুন্দর, পরি-ছন্ন, পরিপাটি হয়ে চলার জন্য ইসলাম ধর্মে বারবার তাগিদ এসেছে। দাড়ি পুরুষের অলংকার। কারো ইচ্ছে-অনিচ্ছায় মুখে দাড়ি গজায় না। নারীরা যেভাবে অলংকারকে যত্ন করে পুরুষদের উচিত তাদের দাড়িকে যথাযথ সৌন্দর্য মণ্ডিত করে রাখা। তাহলে তাকে স্মার্ট লাগবে। রাসুল (সা) ব্যক্তিত্বে, সকল ধরনের মানুষ আকৃষ্ট হত। তিনি রাস্তা দিয়ে চলে যাবার পরের পথিকেরা বুঝতে পারতেন কোন এক সময় এই রাস্তা দিয়ে রাসুল (সা) হেটে গিয়েছিলেন। পুরো পরিবেশ মন মাতানো সুবাসে মৌ মৌ করত। নতুন মানুষ সাক্ষাতে আসলে, আগে তাঁর চেহারা দেখেই হা করে তাকিয়ে থাকত! এত সুন্দর মানুষ কিভাবে পৃথিবীতে থাকে।
কথায় কথা এসে যায়, একদা এক শিয়া মতের মানুষের প্রতিষ্ঠানে যাই। সেখানে সবুজ চাদর পরা, লম্বা দাড়ির মুখমণ্ডল, সুরমা রাঙ্গা চোখের এক যুবকের ছবি দেখতে পাই। ছবিটি এত সুন্দর চোখ ফিরাতেই পারছিলাম না! আমি বারবার ভাবছিলাম মানুষের এত সুন্দর চেহারা কিভাবে থাকতে পারে। আজো সেই ছবির প্রতিটি রেখা আমার অন্তরে গেঁথে আছে। আমার তন্ময় আগ্রহ দেখে, প্রতিষ্ঠানের মালীক জানালেন এই ছবি এঁকেছেন ইরানের এক বিখ্যাত চিত্রকর। তিনি কোনদিন এই মানুষটিকে দেখেন নি। ইতিহাসের বর্ণনা শুনে, হুবহু হৃদয়ে আত্মস্থ করেই তিনি এই ছবির প্রতিটি আঁচড়ে তুলে এনেছেন সেই বিশাল ব্যক্তিত্ব কে, যার প্রশংসা সারা বিশ্বময়। কল্পনার এই ছবির মানুষটি হলেন মুহাম্মদ (সা)। মাথা ভৌঁ করে ঘুরে উঠল। বহু কষ্টে চেহারার দিকে থেকে মুখ ফিরালাম, আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইলাম। মানুষ কিভাবে এত সুন্দর ছবি আঁকতে পারে। ভাবতে রইলাম, রাসুল (সা) ইন্তেকালের কিছুকাল পরেই ছবি তোলার ক্যামরা আবিষ্কার হয়। তাই তাঁর ছবি ক্যামরা বন্ধী হয়নি। রাসুলের (সা) ছবি যদি কোন ক্যামরায় ধারণ করা হত, আর সেই ছবি যদি একটি আমার কাছে থাকত। তাহলে হাজারো অত্যাচার-নির্যাতন সহ্য করে, ধর্মীয় অপবাদ গায়ে মেখেও আমি সে ধরনের একটি ছবিকে বুকে ধারণ করে রাখতাম।
ধর্মীয় গণ্ডির মধ্যে থেকেও মানুষ অনেক স্মার্ট থাকতে পারে। নিজের প্রতি যত্নশীল হওয়া জরুরী। ফুল যখন ফুটে, তখন সে নিজ দায়িত্বেই সৌরভ ছড়ায় এবং তার পরিপূর্ণ শোভা প্রদর্শন করেই নিজেকে প্রচার করে। তাই প্রতিটি সচেতন মানুষের স্বীয় দায়িত্বই হল, নিজেকে প্রস্তুত করে ফুলের মত উদাহরণ সৃষ্টি করা। তাই আসুন এমন বেশভূষা ধারণ করি, যেটা নিজের ধর্ম, কৃষ্টি, সংস্কৃতি, তমদ্দুনের পক্ষে কথা বলে। নিজের প্রতি যেন অন্যরা আকৃষ্ট হয় সে ধরণের ব্যক্তিত্ব তৈরি করি। কোন অবস্থাতেই যেন নিজেকে হেয় করার কাতারে না রাখি। নতুবা যতই যোগ্যতা থাকুক না কেন গ্রহণযোগ্যতার অভাবে পরিশেষে ইঞ্জিনিয়ার জয়নুল আবেদিনের পথ ধরতে হবে।
সহাস্য বদনে সামনে এসে সালাম দিলেন, ‘আসছালামু আলাইকুম’ ভাই। কেমন আছেন? আপনার কোম্পানির বাংলাদেশী মানুষটার অকাল মৃত্যুতে বেশ খারাপ লেগেছিল…
ভাবছি তাইতো! আমি এখনও ওনাকে না চিনলেও তিনি ঠিকই আমাকে চিনে ফেলেছেন! যাই হোক মুসিবতে তো আমি পড়েছি তাই নাম-পরিচিতি আমাকেই উৎরাতে হবে। চেনা জানা মানুষকে সালামের শুরুতেই ভুলে যাওয়া নাম জিজ্ঞাসা করাটা বড় বিব্রতকর, তাই আমিও শুরু করলাম,
ওয়ালাইকুম সালাম, তা আপনি কেমন আছেন? অনেক দিন দেখিনা, কোথায় ছিলেন?
কেন আপনাকে তো প্রথমেই ফোন করে জানিয়েছিলাম, সামসাং কনাস্ট্রাকশন কোম্পানিতে ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে আমার চাকুরী হয়ে যাবার খুশীর কথাটি!
ওহ, হো! তাই তো, ভুলে গিয়েছিলাম, দুঃখিত। কণ্ঠ শুনে মনে হয়, তাকে আমি চিনিই তো! আবার ভাবছি, চিনলে নাম মনে আসছে না কেন? ভিতরে পেরেশান হচ্ছি, স্মরণ শক্তির দুর্বল সামর্থ্যের কথা ব্যাপার নিয়ে। কিভাবে যেন সব ভুলে যাচ্ছি। এ ধরনের পরিস্থিতি সামাল দিতে, গুরুজী মহাজাতকের একটি পরামর্শ ছিল, ব্রেন কে আলফা-বিটা লেভেলের গণ্ডি পার করে দিয়ে, যথাসম্ভব গামা লেভেলে পৌছাতে হবে। তাহলে ত্রিশ বছর আগের ভুলে যাওয়া নামও মনের পর্দায় ছল ছল করে ভেসে উঠবে।
অগোছালো কথার ফাঁকতালে, ঠাণ্ডা মাথায় ব্রেন কে অটো-সাজেশন দেবার চেষ্টা করলাম। কিন্তু সুযোগ কই? কথার উত্তর দিব নাকি ব্রেনকে সাজেশন দিব, বৎস একটু কোমল হও। আরে ধ্যাত! গত দুই মাস, চার মাস, ছয় মাস, এক বছর আগে কে কে চাকুরীর কথা জানিয়েছিল, এমন কোন ব্যক্তির কথাই মনে আসল না! না এভাবে হুলুস্থুল পরিবেশে ব্রেনকে সাজেশন দেওয়া চলেনা। অগত্যা সাজেশন পর্ব সেখানেই থামিয়ে, হতাশ হয়ে কাজের তাড়া আছে বলে ভালোয় ভালোয় কেটে পড়তে চাইলাম। ঠিক সেই মুহূর্তে একটি মাথায় একটি বুদ্ধি ভর করল। দেরীতে হলেও অটো সাজেশন ভিন্ন ভাবে কিছুটা কাজ দিচ্ছে বলে মনে হল।
জানালাম, তোমার ফোন নাম্বার টা হারিয়ে ফেলেছি, আমাকে একটা মিস কল দাও তো। চেনা জানা মানুষের হারিয়ে যাওয়া নাম-পরিচয় উদ্ধারে এটা একটা অন্যতম ডিজিটাল বুদ্ধি। তিনি জানালেন, মোবাইলটা গাড়িতে, আছরের নামাজের জন্য মসজিদে এসেছিলেন, গাড়িতে পৌঁছেই মিস কল দেবেন। এই মূহুর্তে তার নাম-পরিচিত জানলে বিদায় নেওয়ার সময় অন্তত নামটা ধরে বিদায় নিলে বিষয়টি সুখকর হত কিন্তু কি আর করা! তাকে তো আর নিজের দুর্বলতার কথা বলতে পারছিনা যে, তুমি চেনা-জানা মানুষ কিন্তু তোমার নাম পরিচয়টা এখনও মনে করতে পারিনি। অগত্যা নিজ গন্তব্যে রওয়ানা হলাম।
পথ চলছি আর ভাবছি, তিনি কে হতে পারেন? ভবিষ্যতে এ ধরনের পরিস্থিতিতে পড়লে কিভাবে নাম-পরিচয় উদ্ধার করা যাবে। ব্রেনকে আবারো প্রশ্ন করছি, কেমন এমন হল? কেন স্মৃতি থেকে এই ব্যক্তির নাম-পরিচিত হারিয়ে গেল ইত্যাদি। মোবাইল রিং এর কারণে সম্বিৎ ফিরে পেলাম। জয়নুল আবেদিন সাহেব ফোন করেছেন, দীর্ঘদিন মানুষটি কোথায় যেন হারিয়ে গিয়েছেন। রিং চলতেই রইল তাই ফোন ধরলাম, সালাম দোয়া হল, প্রশ্ন করলাম কতদিন দেখা-দেখি হয়না? তিনি আশ্চর্য কণ্ঠে জানালেন, বলেন কি? কিছুক্ষণ আগেই তো কথা বললাম, আপনি না আমাকে মিস কল দিতে বলেছিলেন?
ওহ! এবার সত্যিই লজ্জিত হলাম। আবারো মস্তিষ্কের গোলযোগ। মগজের কোথায় যেন সমস্যা হয়েছে তাই বিরাট প্যাচ লেগেছে। অটো সাজেশনের মাধ্যমে ব্রেনকে কাজ দিতে গিয়ে, চিন্তায় জঞ্জালে আটকা পড়ে, মিস কলের কাহিনী ভুলে গিয়েছিলাম। যাই হোক, নাম তো পাওয়া হয়েছে কিন্তু তারপরও গোলমেলে ব্যাপারটি থামে নি। ভাবছি তার যেন চেহারাটা কেমন জানি ছিল? কল্পনাতে ছবি আঁকা শুরু করলাম। নাকের পার্শ্বে একটি তিল ছিল, হ্যাঁ সেই তিল আজে আছে। চোখের উপরে একটা কাটা দাগ ছিল! ও হ্যাঁ! বুঝতে পেরেছি, আরে ইনি তো ইঞ্জিনিয়ার জয়নুল আবেদিন। আগে গাল ভরা দাড়ি ছিল এখন মুখমণ্ডল একেবারেই তেল তেলে! এই ভাবনায় নিজের উপরে গোস্বা উঠল, কেন তাকে চিনতে এত দেরী হল!
বাকী ঘটনা সংক্ষিপ্ত। অতীতের একটি ঘটনার কথা মনে পড়ে গেল। আছরের নামাজের পরে, মসজিদের সামনে কেউ একজন আমার সাথে দেখা করতে চায়। বেশী অপেক্ষা করতে হয়নি। একটি ছেলে তার কিছু বন্ধু-বান্ধব সহ সামনে এসে হাজির। তারা তাবলীগ জামায়াত করে, আমার সাথে বহুদিনের পরিচয়। জয়নুল আবেদিন সদ্য পাশ করে বের হওয়া মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার, তার একটি চাকুরী খুব দরকার। আমাদের কোম্পানিতে ব্যবস্থা করা যাবে কিনা এটাই ছিল মূল প্রশ্ন।
সদ্য পাশ করে বের হলেও জয়নুল কে দেখে ত্রিশ বছরের বেশী বয়সী বলে মনে হল। গাল ভরা দাড়ি। দাড়ির পরিধি কানের দুপাশ বেয়ে নিচের দিকে গোলাকার হয়ে আছে। মনে হল দৈনন্দিন চিরুনির কাজটা দুই হাতের দশ আঙ্গুল দিয়ে সারানো হয়। দাড়ি রাসুল (সা) সুন্নত ও মুসলমানদের অন্যতম পরিচিতি। কিন্তু জয়নুল কবে সেলুনে গিয়েছে সেটা তার দাড়ির অবয়ব দেখে বুঝা মুস্কিল। এই হালতে কোথাও ইন্টারভিয়্যু দিলে দুনিয়াবি কাণ্ডজ্ঞানে অনুমান করা যায় যে, নির্ঘাত চাকুরী হবে না! কারণ একটাই, সেটা নিশ্চিত দাড়ি নয়, সেটা হল নিজের প্রতি তার চরম অবহেলা! এ ধরনের মানুষের দাড়ি না থাকলেও, কোনদিনই চাকুরী হয়না। যে নিজেকে মূল্য দেয়না সে অন্যের সম্পদকেও মূল্য দেয়না। তরুণ ছেলে দাড়িকে একটু যত্ন করলে, লম্বা দাড়িতেই তাকে প্রিন্সের মত লাগত। মনে বহু প্রশ্ন উকি মারছিল, সে যখন দুনিয়াকে এত অবহেলা করে, তাহলে চাকুরীর দরকার টা কি ছিল? সাধু-সন্ন্যাসীর মত জীবন ধারণ করলেও তো চলত!
দাড়ি সম্পর্কিত কোন সাজেশন তাকে দিতে পারলাম না। সেটা আমার জন্য হিতে বিপরীত হতে পারে। তাছাড়া আমি সবেমাত্র দাড়ি রাখার প্র্যাকটিস শুরু করেছি এবং দাড়ির সীমানা প্রাচীরের মানদণ্ডের চেয়ে একটু খাট বলে অনেকেই ইতিমধ্যে সমালোচনা শুরু করে দিয়েছিলেন। যদিও ক্লিন শেভ জমানায় কোনদিন এ ধরনের পরিস্থিতির মোকাবেলা করিনি। তাই আমার এই চরম অধঃপতন পরিস্থিতিতে লম্বা দাড়ির জয়নুলকে পরামর্শ দেওয়া একেবারেই বে-মানান!
যাক, আমিতো তার জন্য একটি চাকুরী জোটাতে চেষ্টা করেছি কিন্তু সাড়ে তিন বছরেও তার কোথাও চাকুরী হয়নি। কেন হয়নি, জানতেও চাইনি। শুরুতেই তাকে আমি গাল ভরা দাড়ির মানুষ হিসেবেই দেখেছিলাম। দাড়ি শুন্য পরিস্থিতির কথা কখনও ভাবিনি। তাই আমার ব্রেন বারবার Fatal Error চিহ্ন দেখাচ্ছিল। কোন কারণে সে দাড়ি ফেলে দিয়ে ক্লিন হয়ে গিয়েছিল। কেন এমন হল সে প্রশ্ন তো তাকে করতাম কিন্তু শত চেষ্টাতে তো তার নাম-পরিচয় উদ্ধার করতে পারিনি। অন্তত তার আচরণে এটাই প্রমাণ করেছিল যে, তার দাড়িটা তার জন্য কিছু বিঘ্ন সৃষ্টি করেছিল। তাই চাকুরী কিংবা কোন বৈষয়িক স্বার্থ অর্জনের জন্য তাকে সে দাড়ি ফেলে দিতে হয়েছিল। তাকে বলা যেত, তার মত আনস্মার্ট মানুষ যতই যোগ্য হউক, চাকুরী হবার কথা নয়, এখানে দাড়ি কোন বিষয় ছিলনা।
আল্লাহ বলেছেন, তিনি নিজে সুন্দর তাই তিনি সুন্দরকে পছন্দ করেন। সুন্দর, পরি-ছন্ন, পরিপাটি হয়ে চলার জন্য ইসলাম ধর্মে বারবার তাগিদ এসেছে। দাড়ি পুরুষের অলংকার। কারো ইচ্ছে-অনিচ্ছায় মুখে দাড়ি গজায় না। নারীরা যেভাবে অলংকারকে যত্ন করে পুরুষদের উচিত তাদের দাড়িকে যথাযথ সৌন্দর্য মণ্ডিত করে রাখা। তাহলে তাকে স্মার্ট লাগবে। রাসুল (সা) ব্যক্তিত্বে, সকল ধরনের মানুষ আকৃষ্ট হত। তিনি রাস্তা দিয়ে চলে যাবার পরের পথিকেরা বুঝতে পারতেন কোন এক সময় এই রাস্তা দিয়ে রাসুল (সা) হেটে গিয়েছিলেন। পুরো পরিবেশ মন মাতানো সুবাসে মৌ মৌ করত। নতুন মানুষ সাক্ষাতে আসলে, আগে তাঁর চেহারা দেখেই হা করে তাকিয়ে থাকত! এত সুন্দর মানুষ কিভাবে পৃথিবীতে থাকে।
কথায় কথা এসে যায়, একদা এক শিয়া মতের মানুষের প্রতিষ্ঠানে যাই। সেখানে সবুজ চাদর পরা, লম্বা দাড়ির মুখমণ্ডল, সুরমা রাঙ্গা চোখের এক যুবকের ছবি দেখতে পাই। ছবিটি এত সুন্দর চোখ ফিরাতেই পারছিলাম না! আমি বারবার ভাবছিলাম মানুষের এত সুন্দর চেহারা কিভাবে থাকতে পারে। আজো সেই ছবির প্রতিটি রেখা আমার অন্তরে গেঁথে আছে। আমার তন্ময় আগ্রহ দেখে, প্রতিষ্ঠানের মালীক জানালেন এই ছবি এঁকেছেন ইরানের এক বিখ্যাত চিত্রকর। তিনি কোনদিন এই মানুষটিকে দেখেন নি। ইতিহাসের বর্ণনা শুনে, হুবহু হৃদয়ে আত্মস্থ করেই তিনি এই ছবির প্রতিটি আঁচড়ে তুলে এনেছেন সেই বিশাল ব্যক্তিত্ব কে, যার প্রশংসা সারা বিশ্বময়। কল্পনার এই ছবির মানুষটি হলেন মুহাম্মদ (সা)। মাথা ভৌঁ করে ঘুরে উঠল। বহু কষ্টে চেহারার দিকে থেকে মুখ ফিরালাম, আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইলাম। মানুষ কিভাবে এত সুন্দর ছবি আঁকতে পারে। ভাবতে রইলাম, রাসুল (সা) ইন্তেকালের কিছুকাল পরেই ছবি তোলার ক্যামরা আবিষ্কার হয়। তাই তাঁর ছবি ক্যামরা বন্ধী হয়নি। রাসুলের (সা) ছবি যদি কোন ক্যামরায় ধারণ করা হত, আর সেই ছবি যদি একটি আমার কাছে থাকত। তাহলে হাজারো অত্যাচার-নির্যাতন সহ্য করে, ধর্মীয় অপবাদ গায়ে মেখেও আমি সে ধরনের একটি ছবিকে বুকে ধারণ করে রাখতাম।
ধর্মীয় গণ্ডির মধ্যে থেকেও মানুষ অনেক স্মার্ট থাকতে পারে। নিজের প্রতি যত্নশীল হওয়া জরুরী। ফুল যখন ফুটে, তখন সে নিজ দায়িত্বেই সৌরভ ছড়ায় এবং তার পরিপূর্ণ শোভা প্রদর্শন করেই নিজেকে প্রচার করে। তাই প্রতিটি সচেতন মানুষের স্বীয় দায়িত্বই হল, নিজেকে প্রস্তুত করে ফুলের মত উদাহরণ সৃষ্টি করা। তাই আসুন এমন বেশভূষা ধারণ করি, যেটা নিজের ধর্ম, কৃষ্টি, সংস্কৃতি, তমদ্দুনের পক্ষে কথা বলে। নিজের প্রতি যেন অন্যরা আকৃষ্ট হয় সে ধরণের ব্যক্তিত্ব তৈরি করি। কোন অবস্থাতেই যেন নিজেকে হেয় করার কাতারে না রাখি। নতুবা যতই যোগ্যতা থাকুক না কেন গ্রহণযোগ্যতার অভাবে পরিশেষে ইঞ্জিনিয়ার জয়নুল আবেদিনের পথ ধরতে হবে।
Discussion about this post