আমাদের গ্রাম্য বাজারে একজন তাবিজ বিক্রেতা আসতেন। একই সাথে ইঁদুরের বিষ, ক্রিমির বড়ি ও নানাবিধ টোটকা পারিবারিক জিনিষেরও পসার বসাতেন। খুব সামান্যই আয় হত তবুও এভাবেই টেনে-হিঁচড়ে সংসার চালাতেন। তার ছিল এক অনন্য প্রতিভা! উপস্থিত ঘটনাকে কেন্দ্র করে, দ্রুত কবিতা বানিয়ে ফেলতে পারতেন! না, না, কয়েক লাইনের কবিতা কিংবা ছড়া নয়। রীতিমত পাণ্ডুলিপি গড়তে পারতেন! এসব কবিতার পাণ্ডুলিপি শহর থেকে ছাপিয়ে মাত্র ২৫ পয়সা দরে বাজারে বিক্রি করতেন। সবার কাছে “কবিয়াল খোরশেদ” হিসেবে পরিচিত মানুষটি ছিলেন খুবই আমুদে ও প্রাণচঞ্চল! প্রেমের উপন্যাস লিখার গাইডলাইন
আরো পড়তে পারেন…
- একচোখা নিতীর খারাপ প্রভাব
- দোষারোপ কারী আজীবন অসুখী
- হিংসা : উনুনে তাতানো বিষের নাম
বাংলাদেশের মানুষের অন্যতম একটি স্বভাব হল, সুর ও ছন্দের প্রতি দুর্বলতা। কবিয়াল খোরশেদ বাজারের দিনে, বেলা থাকতেই বাজারে আসতেন এবং সুর করে কবিতা আবৃত্তি শুরু করতেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই সেখানে, বহু মানুষের জটলা সৃষ্টি হয়ে যেতো। এ ধরনের একটি কবিতার বই পড়ে শেষ করতে কয়েক ঘণ্টা লেগে যাবে। তাই আকর্ষণের মূল জায়গা থেকে পড়েই, কিছুটা শুনিয়ে উপস্থিত মানুষকে প্রভাবিত করতেন। ফলে বহু মানুষের বাজার সওদার মধ্যে একখানা কবিতার বইও সংসার ধর্মের অংশ হয়ে যেত! অনেক পুরুষ আবার সময় করে গ্রামের মানুষদের এসব শুনিয়ে গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করতেন।
কবিয়াল খোরশেদ বেশীর ভাগ সময়ই প্রেমের কবিতা লিখতেন। স্রোতাদের এগুলোই বেশী আগ্রহী করত। না, এগুলো বাজে কবিতা ছিল না। ছোট বড় সবার সামনে উপস্থাপন করা যেত, এমন মান সম্পন্ন। প্রেমের কাহিনী গুলো ভাবের মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলা হত। ফলে স্রোতাদের ওসব বুঝার জন্য কিছুটা কাণ্ডজ্ঞানেরও দরকার হতো।
যাই হউক, কবিয়াল খোরশেদ ছিলেন “পেশাদারী কবি”, ভাবুক প্রকৃতির মানুষ। ব্যতিক্রমী প্রতিভার অধিকারী। কবিতা লিখেই কাজ শেষ করতেন না, সেটার সূর কেমন হওয়া উচিত, তাও বাজারে দাঁড়িয়ে মানুষকে শিখিয়ে দিতেন। তবেই তার চার আনা দামের কবিতাটি বিক্রি হত।
কবি মানুষ সর্বদা ভাবেন বেশী, কবিতার ছন্দের দরকার, লিখার বিষয় দরকার এবং কবিতার উপকরণ দরকার। ফলে, নিত্য নতুন কোন ঘটনার জন্য কবিয়াল সাহেব তক্কে তক্কে থাকতেন। কিন্তু তিনি এমন চৌকশ মানুষ যে, কারো ছেলে কোন মেয়েকে একটি রুমাল উপহার দিয়েছে। এ ধরণের একটি ক্ষুদ্র অনুল্লেখ-যোগ্য ঘটনাটিও তার কবিতায় প্রাণবন্ত হয়ে উঠত। এটাকে কেন্দ্র করেই আধা মাইল লম্বা কবিতা ফেঁদে ফেলতে পারতেন! রগরগে ঘটনা বলে মানুষকে উত্তপ্ত করতেন না বরং মানুষ যাতে সচেতন ও সজাগ থাকে, সেজন্য সতর্ক করতেন।
বাজারের এই কবি থেকে আমি একটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা অর্জন করেছিলাম। আজকের মূল বিষয় সেটিই।
স্কুল জীবন থেকেই আমি লিখতে চেষ্টা করতাম। নিজের লেখা পড়ে নিজেই আনন্দ পেতাম। জানিনা অন্যদের জীবনে বিষয়টি কিভাবে ধরা পড়ত। গল্প, নাটক যা মন চাইত, তাতেই কলম চালাতাম। এসব লিখার কোন পাঠক ছিলনা। বন্ধুদের ধরিয়ে দিতাম। তারা বিরক্ত হত, উপেক্ষা করত। স্কুলে প্রতিবছর নাটক হতো, তাই বন্ধুদের সহযোগিতায় একটি নাটক স্যারের কাছে জমা দিয়েছিলাম। উল্টো তিনি ধমক দিয়ে বললেন,
ওসব নাটক-ফাটকে মন দিও না, লেখা-পড়ায় মন দাও। বুঝেছিলাম, হয়ত আমার লিখার বিষয়গুলো তখনও অপ্রাসঙ্গিক কিংবা গ্রহণযোগ্য নয়। তবে আমার বাবা আমার সব লিখা মন দিয়ে পড়তেন। হয়ত আমার মতিগতি বুঝার জন্য নয়ত আমাকে উৎসাহ দেবার তরে।
আমার মন তো লিখতে চায় কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ উপাদান, লিখার বিষয়বস্তু ও প্লট কিভাবে সংগ্রহ করা যায় বুঝে আসত না। দশম শ্রেণীর পরীক্ষা শেষে অফুরন্ত সময়। সিদ্ধান্ত নিলাম প্রেমের উপন্যাস লিখব! এবার বন্ধুরা আর না পড়ে থাকতে পারবে না কিন্তু লেখার প্লট সমস্যা রয়েই গেল।
তখনই মনে পড়ল, কবিয়াল খোরশেদের কথা। ওনি যখন ঘটনা বর্ণনা করেন তখন সকল মানুষ একমনে কথা গিলতে থাকে। মানুষ তন্ময় হয়ে শুনে। কবিয়াল মানুষের এমন তন্ময়তা দেখে মাঝে মাঝে বলে উঠতেন, ভাইয়েরা পকেট সাবধান। এখানে কিন্তু পকেটমার ঢুকে পড়েছে। পরে আমাকে দোষ দিতে পারবেন না। ভাবলাম, তারই শরণাপন্ন হয়ে, প্রেমের উপন্যাস লিখার পরামর্শ চাইব।
তিনি জানালেন গুরুত্বপূর্ণ কথা,
– উপন্যাস লিখায় হাত দিতে হলে কমপক্ষে ৫০টি উপন্যাস পড়া লাগবে। তখন বুঝতে পারবে শব্দ ও বাক্যের গাঁথুনি কিভাবে জোড়া লাগাতে হয়। সুন্দর উপস্থাপনার মাধ্যমে কিভাবে সাধারণ ঘটনাকে অসাধারণ করে তোলা যায়।
– সমাজে নোংরামি বেশী, মানুষের কথা লিখতে হলে ওসব এড়ানো যায় না। সুন্দর কথা সবাই লিখতে পারে কিন্তু সমাজে ঘটে চলা বিশ্রী ঘটনাকে কলমের ভাষায় উপস্থাপন করতে না পারলে বুঝবে, তুমি এখনও লিখতে শিখ নি!
– যে জাল বুনতে জানে সে প্রেমের উপন্যাস লিখতে পারে। এটা লিখার জন্য আহামরি তেমন কিছুর দরকার হয় না। চারজন বিবাহিত ব্যক্তির জীবনের ঘটনা, বিরহ, বেদনা সংগ্রহ করো এবং দু’জন যুবকের দাম্পত্য স্বপ্ন জেনে নাও। অতঃপর একজনের ঘটনাকে অন্যজনের সাথে সাথে প্যাচ লাগিয়ে, অবিবাহিত যুবকদের কল্পনায় মলম মাখিয়ে, নতুন আরেকটি ঘটনার জন্ম দাও। এটা প্রেমের ভাল উপন্যাস না হলেও, একেবারে মন্দ হবেনা। ভাষার কারুকার্য যদি মসৃণ হয় ও অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগানো যায়, তাহলে একদিন অমর প্রেমের উপন্যাস লিখতে পারবে।
– তবে এখন উপন্যাস লিখায় মন না দিয়ে, লেখাপড়ায় মন দাও। আমার কবিতা শোনার জন্য শিক্ষিত মানুষ আসেনা, গ্রাম্য মানুষই আসে। আকারে ইঙ্গিতে প্রেমের কথা শোনার মানুষ এখন আর নাই। স্রোতা এখন সরাসরি ঘটনার বিবরণ শুনতে চায়! আমাদের তো দিন শেষ, লিখালিখির বাজারও শেষ। তাছাড়া তোমার এই বয়সে কারো পারিবারিক কাহিনী যোগাড় করা সম্ভব নয়। একটা বয়স পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয় নতুবা মানুষ, “ইঁচড়ে পাকা, অকালপক্ব ভাববে”।
বাংলা ব্যাকরণ পড়তে গিয়ে এই দুটি শব্দের সাথে পরিচিত ছিলাম। কবিয়ালের কাছে যেভাবে শব্দ দুটোর নতুন পরিচিতি পেলাম, স্কুলের স্যারের বকুনি-ধমকানি খেয়েও, সেভাবে বুঝি নি। যাক, সেটা ভিন্ন কথা
গ্রাম্য কবিকে আমি হালকা ভেবেছিলাম এই মর্মে যে, সামান্য টাকার জন্য বাজারে দাঁড়িয়ে মানুষদের আনন্দ দিয়ে জিনিষপত্র বিক্রি করে। আমার আগ্রহের কথা শুনে হয়ত তিনিও আমায় মূল্যায়ন করবেন। কিন্তু হিতে বিপরীত। তার কাছে গিয়েছিলাম ভিন্ন কিছু শুনতে। পেলাম এক বস্তা উপদেশ! যা আমাকে নিরাশ করে দেবার জন্য যথেষ্ট। হলোও তাই।
ফেরার সময়, তিনি ডাক দিয়ে থামিয়ে বললেন,
দেখ, জীবনে কোনদিন সম্ভব হলে মৌলিক সাহিত্য লিখো, ঠিক ডাক্তার লুৎফর রহমানের মতো। প্রয়োজনে দশ বছর অপেক্ষা করে একটি বই লিখবে। “যেটি জনকল্যাণে কাজে আসবে এবং সেটি আজীবন তোমায় জীবিত রাখবে। প্রেমের উপন্যাস নদীর স্রোতে পড়া গাছের তাজা ডালের মত, যা আর একই স্থানে অবস্থান করে না। লেখক ও পুস্তক দুটোই ভাটির টানে হারিয়ে যায়।”
Discussion about this post