মেহমান ও মেহমানদারী কথা দুটোই আমাদের সামাজিক চিত্রে স্থায়ীভাবে লেপটে আছে। বাঙ্গালী বরাবরই মেহমানদারীতে আলোচিত ছিল। কিন্তু সমাজ জীবনে মেহমানদারী নিয়ে যত কথা হয় উত্তম মেহমান হবার জন্যে তেমন কোন আলোচনা থাকেনা।
মেহমানদারী অন্যতম একটি সুন্নাত। রাসুল (সাঃ) বলেছেন, “মেহমানের সামনে যতক্ষণ দস্তরখান বিছানো থাকে, তা না উঠানো পর্যন্ত ফিরিশতারা তোমাদের ওপর রহমত বর্ষণ করতে থাকে” বুখারী – ৬০৩৪
কারো বাড়িতে আন্তরিক মেহমানদারী পেতে হলে, নিজেকে অবশ্যই বিনয়ী ও নিরহংকারী ব্যক্তি হওয়া বাঞ্ছনীয়। মেহমান নিজেই যদি উৎপীড়ক হয়ে আগমন করেন, তাহলে কারো মেহমানদারীতে ও অনাকাঙ্ক্ষিত ত্রুটি বিচ্যুতি ঘটতে থাকবে।

এতে করে নিজে মেহমান হয়ে অন্যের আপ্যায়নে যেমন খুশী হতে পারেন না; তেমনি মেহমানদারী করেও সেই ব্যক্তিকে আগত মেহমানের নানা অসঙ্গতি নিয়ে বদনাম করতে দেখা যাবে।
গ্রামের ওয়াজ মাহফিলে জোতদার ব্যক্তিটি, তাদের পীর সাহেবকে এনেছিলেন মানুষদের ভাল ও সুন্দর কথা শুনানোর জন্যে। পীর সাহেব গ্রামে এসে জোতদার ব্যক্তির সন্তানদের লাগিয়ে দিয়েছিলেন হাত-পা টেপানোর কাজে! এতে করে তিনি তার সমুদয় আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন এবং মেহমানদারীতেও তার আছর পড়ে।
গ্রামের নিকটাত্মীয়দের কেউ শহরে মেহমান হয়ে এসেছিলেন। মেহমানদারীর কোন ঘাটতি না থাকলেও ঘর-ওয়ালীর নিজস্ব শয়নকক্ষটি থাকার জন্যে ছেড়ে না দেবার কারণে মনঃক্ষুণ্ণ হয়ে, সেটাকেই বদনামীর পয়েন্ট বানিয়ে ফেলে।
আরো পড়ুন…
মেহমান যখন খালা আর ফুফু
ঈদের দিনে ধনী কৃপণের বাড়ীতে
ঘরে বাইরে ওভেনের ব্যবহার
যথেষ্ট সম্পদের অধিকারী এক ধনী ব্যক্তির সাথে দীর্ঘ পথ ও লম্বা সময়ের সাথী হবার সুযোগ হয়েছিল। এমন সুযোগ কয়েকবার পেয়েছিলাম। পথিমধ্যে তাকে মেহমানদারী করার জন্যে আহবান আসে এবং তাকে কারো কারো মেহমান হতেই হয়। যদিও তিনি হোটেলে থাকার ইচ্ছা নিয়েই বের হয়েছিলেন।
মেহমানের সংখ্যা বেড়ে যাবার কারণে, এই ধনী ব্যক্তি নিজেকে সবার সাথে ড্রয়িং কক্ষের ফ্লোরে একই সাথে বিছানা করে দেবার জন্যে আহবান করেন। তার এমন বিনয়ী ভাবের কারণে উপস্থিত সবাই উৎফুল্ল হয়ে উঠে এবং সারারাত আন্তরিকতার সাথে সময় পার হতে দেখেছি।
আমাদের দেশে মেহমানদারী মানে তার জন্যে বাজারের সেরা দামী বস্তু ক্রয়, দামী তরকারী রান্না, আদর সমাদরে তুঙ্গে রাখা, প্রশংসায় ভাসিয়ে দেওয়া, তাকে মেহমান হিসেবে পেয়ে নিজেদের ছোট ভাবে উপস্থাপিত করা, মেহমান দ্বারা কষ্ট পেলেও সদা হাসি মুখে থাকাই উত্তম মেহমানদারী প্রদানের নিয়ম!
আবার মেহমান বলবেন যথেষ্ট হয়েছে! আর লাগবে না! বলার পরও সেই জিনিষ জোর করে তার পাতে তুলে দেওয়া সেরা মেহমানদারী নমুনা। স্থানীয় ভাষায় এটাকে বলে ‘লুইত’ এবং তা অবশ্যই পালনীয়। মেহমানের প্রতি এই আচরণকে মনে রাখা হয়!
মেহমান চলে যাবার সময় মনে মনে খুশী হলেও; প্রকাশ্যে বদনখানি মলিন করে রাখাই যেন মেহমানের প্রতি আন্তরিকতার প্রমাণ! অচিরেই আবারো যেন বেড়াতে আসে সেই তাগাদা না দেওয়াও মেহমানের প্রতি অনাস্থার শামিল বলে বিবেচনা করা হয়!
সামাজিক প্রটোকল মেনে প্রতি পদে পদে লক্ষ্য রেখে অনুষ্ঠান পালনের নাম মেহমানদারী নয়। ইচ্ছে থাকা স্বত্বেও সবার পক্ষে এমন মেহমানদারী করা দুষ্কর। এমন মেহমানদারীতে কারো মন জয় করা যেমন কঠিন তেমনি এমন মেহমানদের অবশ্যই আপদ হিসেবে বিবেচনা হবে।
রাজনৈতিক নেতা, পীর, হবু বর, শ্বশুর বাড়ী মানুষেরা একজন মেহমানকে খুশী করতে যত খানা বানায়, সেগুলো দিয়ে বহু মানুষকে মেহমানদারী করা যায়; এখানে সে কথা বলা হচ্ছে না! তবে,
যিনি মেহমান তিনিই যদি দূরদর্শী, বিনয়ী ও সদাচারী হন, তাহলে উত্তম মেহমানদারি পাওয়া তাদের জন্যে কোন অবস্থাতেই কষ্টকর নয়। শুধুমাত্র সামান্য আচরণের পরিবর্তনে এমন ব্যতিক্রম ফল আসে।
তাই উত্তম মেহমানদারী পাবার আগে নিজেকেই যেন উত্তম মেহমান হিসেবে পরিগণিত করতে পারি; সে চেষ্টা থাকা প্রথমেই বাঞ্ছনীয়।
Discussion about this post