ছোট কালে আমাদের খামার বাড়ীর উৎপাদিত কৃষি পণ্য আমাকেই বাজারে দাঁড়িয়ে বিক্রি করতে হত। আগে বড় ভাই ও মেজ ভাই করতেন। তারা যথাক্রমে কলেজ ও মাদ্রাসার উচ্চ শিক্ষার জন্য দূরে গেলে পর, আমার কাঁধেই দায়িত্ব পড়ে। মধ্যস্বত্ব ভোগে সামাজিক ক্ষতি
তৃতীয় শ্রেণীর ছাত্র থাকাবস্থায় বাজারে ক্রয়-বিক্রির এই রূঢ় বাস্তবতার দীক্ষা পেয়েছিলাম, হাজারো মানুষের চরিত্র থেকে। বিক্রির পদ্ধতি হাতে কলমে মেঝ ভাই শিখিয়েছিলেন, তিনি মাদ্রাসায় চলে গেলেন। বাজারের প্রকৃতি, ক্রেতার চাহিদা ও ক্রয় ক্ষমতা এসব বুঝার জ্ঞান পেতাম মায়ের নিকট থেকে।
আমরা গরীব ছিলাম না, শিক্ষিত পরিবার, পিতার ভালই জায়গা-জমি ছিল। গোয়ালে ছিল গরু, জমিতে কয়েক জোড়া হাল, ঘরে কয়েকজন চাকর-চাকরানী। এরা সবাই উৎপাদের হাতিয়ার। পেয়ারা, কলা, বরবটি, বেগুন, সিম, কাঁকরোল সহ বহু ধরনের ফসল উৎপন্ন হত। আমার কাজ শুধু পণ্য বিক্রি করা।
বয়স তো কম, তাই পলিসি বুঝি নি। একবার ভাল বাজার দর পাওয়াতে একসাথে সকল পণ্য বেপারীর কাছে বিক্রি করে দেই। পরের বাজারে ব্যাপারীরা আর আমাকে বাজারে ঢুকতে দেয় নাই। পথিমধ্যেই কিনে ফেলে। এভাবে মালামাল বিক্রি হওয়াতে আমি নিজেকে নির্ভার মনে করি এবং বাজারে কবিয়ালের পুঁথি-কবিতা শুনার সুযোগ গ্রহণ করি।
আমাদের পণ্যের নির্দিষ্ট কিছু ক্রেতা ছিল। তারা আমাকে কিছু না বললেও এই কাজে বড় মনক্ষুন্ন হল। এটা না করতে আমাকে মৌখিকভাবে জানাল। ইতিমধ্যে খবরটি মায়ের কানে চলে গেল। এর ফল স্বরূপ এমন কঠিন চপেটাঘাতের মুখোমুখি হয়েছিলাম, যার ব্যথা আজো ভুলি নি।
বেপারীর কাছে মাল বিক্রি করতে মায়ের মানা ছিল। যেহেতু বিক্রির কাজটি আমি করি, বাজারের গতিবিধি আমিই ভাল বুঝি। অধিকন্তু ঘরে বসে থাকা আম্মাকে কিছুটা বুদ্ধিহীন মনে করে কাজটি মায়ের অজান্তেই করে ফেলি।
যাই হোক, মা জানালেন এমন ভুল জীবনেও করোনা। আমাদের পণ্যগুলো স্পেশাল। এগুলোর পিছনে খাটুনী দিতে হয়, তাই তরকারীগুলো নীরোগ, পোকা-বিহীন। এগুলো মৌসুমের অগ্রিম ফসল এবং সবার আগে বাজারে পৌঁছে। সৌখিন মানুষেরা মৌসুমের শুরুর এমন তরকারী ভাল দামে কিনে। বেপারীরা এগুলো কিনে দুই গুনের বেশী দামে বিক্রি করবে। তুমি মাঝপথে বেপারীকে অন্যায্য সুযোগ দিয়েছে এবং এলাকার মানুষদের জন্য ক্রয় ক্ষমতাকে কঠিন করে তুলেছ।
হায়! হায়! মাথায় হাত! তখনই বুঝলাম কেন কিছু দিন ধরে বেপারীদের কাছে আমার কদর বেড়েছে এবং স্থানীয় কিছু মানুষ পেরেশান হয়েছে।
পুনশ্চ: এ ধরনের মধ্য-স্বত্বভোগী কারবার ইসলাম নিষিদ্ধ করেছে। এতে করে ক্রেতা এবং উৎপাদক দু’জনই ঠকে কিন্তু মাঝপথের ফড়িয়ারা ফেঁপে-ফুলে মোটা হয় এবং এক পর্যায়ে ব্যবসায়ের শক্তি তাদের হাতে কুক্ষিগত হয়। বাজারে না পৌছা অবধি, পথিমধ্যে মালের দরদাম করা। একজনের দামের উপরে অন্যজনে মূল্য হাঁকা। ট্রাকে পণ্য থাকাবস্থায় দর-দাম ঠিক করা ইসলামে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। বাজার নিয়ন্ত্রণে রাখার বিষয়টি অনেকটা স্থানীয় চেয়ারম্যানের দূরদর্শিতার উপরেও নির্ভর করে।
Discussion about this post