তৃতীয় শ্রেণী থেকে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত আমাকে দিয়ে ঘরের বাজার করানো হত। বাজারের ঝুড়ি কিংবা থলের সাথে সরিষার তৈলের একটি শিশিও দেওয়া হত। বাজারের পরিমাণ যতই হউক না কেন, তৈলের শিশি উল্টে যাবার ভয় সদা থাকত। প্রতি সোম ও বৃহস্পতিবারে এই শিশিতেই করে অন্য সওদার সাথে বাজার থেকে সরিষার তৈল আনতে হত। রান্নায় কতটুকু তৈল চাই
আমাদের পরিবারে প্রতি বাজারে এক ছটাক তৈল লাগত। বুঝার জন্য হিসেবটা জানা দরকার। ষোল ছটাকে এক সের। আবার পরিমাপের দিক দিয়ে, সের এর ওজন কেজির চেয়ে একটু কম। সে হিসেবে এক ছটাক তৈলে ১০০ মিলি ঔষধের বোতলের অর্ধেকের চেয়ে সামান্য উপরে থাকত।
বিকেলে বাজারে যাবার সময় যে কিছুটা তৈল অতিরিক্ত থাকত, সেটা আরেকটি আধপোয়া বা দুই ছটাকি তৈলের বোতলে রেখে ঢুকিয়ে রাখতাম। এগুলোকে বলা হয় হল ‘তোলা’। এটা করা হত সংসারের বরকতের আশায়। কোন অঘটন কিংবা বাড়িতে মেহমান আসলে এই তোলা তৈলে হঠাৎ কাজ দিত। তাছাড়া প্রতি দুই মাস অন্তরে এই তোলা তৈল দিয়ে আরো অতিরিক্ত দিন দশেক পার করা যেত।
প্রতি বাজারে বোতল টানাটানিকে মায়ের বেকুবি সিদ্ধান্ত ভেবে, একদিন সেই আধপোয়া বোতলে ভরে এক সাথে দুই ছটাক তৈল নিয়ে আসি! যাতে করে মায়ের এক বাজারের চিন্তা কমে যায়। মাকে না জানিয়ে এমন কর্ম করার জন্য সজোরে কান মলা ও চপেটাঘাত জুটেছিল। তিনি বললেন, তৈল কোন ভাল জিনিষ নয়। এভাবে বোতলে তৈল ভরা থাকলে, নিজের অজান্তে ব্যবহার বেড়ে যাবে। ঘরের মানুষ অসুস্থ হবে! তখন প্রতি সপ্তাহে চার ছটাক তৈল ব্যবহারের অভ্যাস গড়ে উঠবে।
আমরা গরীব ছিলাম না। ঘরে খাওয়ার মানুষ ছিল। শক্ত-সামর্থ্য চাকর-চাকরানী সহ সবাইকে খাওয়াতে প্রতিদিন ছয় সের (প্রায় ছয় কেজি) চাউলের দরকার হত। কলে ধান ভাঙ্গার কাজটিও আমার দায়িত্বে ছিল। বলছিলাম তৈলের কথা। এলাকার ধনী গরীব যারাই বাজারে যেত তাদের ঝুড়ির সাথে গলায় রসি টাঙ্গানো একটি সরিষার তৈলের শিশি থাকত।
বাজারে ফুটপাতে তৈল বিক্রি করার ব্যবস্থা ছিল। এটাই তাদের জীবিকার মাধ্যম ছিল। ফিরে আসার সময় নিয়ে আসার জন্য, মানুষেরা ওদের কাছেই তৈলের শিশি জমা রাখত। মানুষেরা ক্ষেতেই সরিষার চাষ করত। অতিরিক্ত সরিষা এরাই কিনে, ঘানিতে তৈল বানিয়ে বাজারে খুচরা বিক্রি করত। ধনী-গরীব নির্বিশেষে এটাই ছিল তদানীন্তন সময়ের সামাজিক চিত্র। মাত্র এতটুকু তৈল দিয়েই রমণীরা সংসার নির্বাহ করত।
ভাসা পাকন নামে তৈলে ভাজা একটি পিঠা বানানো হত। গরম তেলে কাই ডেলে সহসা সহজে এটা বানানো যেত। আর কোন নাস্তা তৈল নির্ভর ছিল না। পাকন পিটার জন্য ব্যবহার হত বাদাম তেল। এটি দামে সস্তা এবং রান্নায় ব্যবহার হতো না। এই পিঠাও বুড়ো-বুড়িরা খেতে সমীহ করত, কেননা তৈলের পিটা খেলে. ভাল শরীরেও গ্যাস্ট্রিকের উপদ্রব হত।
মানুষের ঘরে ঘরে দুধ-ঘি এর ব্যবহার ছিল। রোজার দিনে সেহরিতে চিনি ও ঘি সমেত গরম ভাত খাওয়া হত। অন্য সময়েও এভাবে খাওয়ার প্রচলন ছিল। ফলে মানুষের দেহ দেখতে ক্ষীণ হলেও, ছিল বলশালী ও হজম শক্তিতে মজবুত। ঘি শরীরের স্নেহ সংঘটিত সমস্যা দূর করে। যা বৃদ্ধ মানুষদের জন্য ছিল দরকারি।
ষষ্ট শ্রেণিতে পড়ার সময় বাজারে সয়াবিন তেল আসে। সেটা সরিষার চেয়ে দুই টাকা কম মূল্যে পাওয়া যেত। তবুও মানুষ রান্নার জন্য সয়াবিন কিনত না। তবে সেটা বাদাম তৈলের বিকল্প হিসেবে টিকে যায় এবং সওদাগরেরা বুট-পিয়াজি ভাজার জন্য কাজে লাগাতে থাকে।
তাছাড়া সরিষা শুধু তেলের কাজই করত না। উপস্থিত খাদ্য তৈরিতে এর জুড়ি নেই। যে কোন সিদ্ধ জিনিষে সরিষার তৈল ও লবণ যোগে ভর্তা বানিয়ে খাদ্যের বিকল্প হিসেবে ব্যবহৃত হয়। যা অন্য কোন তৈলের মাধ্যমে হয় না। আমার ছাত্র ও কর্ম জীবনে আলু, সিম, বরবটি, ঢেঁড়স, বেগুন, কচু সহ যত ধরনের সবজি পেতাম, তা এভাবেই খেয়ে সুস্থ থেকেছি।
কলেজ জীবনের দিকে বাজারে পাম তেল আসা শুরু করে। অধিক মাত্রার চর্বি সমৃদ্ধ এই তেল আগে শুধুমাত্র সাবান তৈরিতে ব্যবহার হত। বিজ্ঞানীরা কায়দা করে এটাকে কিছুটা তরল রাখার বুদ্ধি আবিষ্কার করে। হরদম চারিদিকের বিজ্ঞাপনে মানুষ এটির প্রতি আকৃষ্ট হতে থাকে। মানুষের জীবনে তৈলের ব্যবহার দিন দিন বাড়তে থাকে। বাজারে ফাস্ট ফুড আসতে থাকে। যা অধিকাংশই ফ্রাই নির্ভর। রোগ শোকও পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকে। মানুষের রুচিরও পরিবর্তন হতে থাকে।
পাম তেলকে নিয়ন্ত্রণের বুদ্ধি দুনিয়াতে বিরাট ব্যাবসায়িক সফলতা আনয়ন করে। সস্তা এই পাম তেলকে নানাবিধ কাজে ব্যবহার করা শুরু করে। এমনকি এটা দিয়ে যখন কনডেন্স মিল্ক তৈরির বুদ্ধি আবিষ্কার হয়, তখন চায়ের দোকান গুলোতে উপচে পড়া ভিড় পরিলক্ষিত হতে থাকে। মানুষ জানেই না যে, দুধ বানানো হয় এমন তৈল দিয়ে, যা দিয়ে আগে সাবানের মত শক্ত চর্বির জন্ম দিত। তা পেটে গেলে কি দশা হবে বলাই বাহুল্য।
দুধের নামে তেল খাওয়া, এমন তেল দিয়ে চা খাওয়া, এই তেল দিয়ে কেকের ক্রিম বানানো, রান্না বান্না সহ হাজারো কাজে তেলের এখন জয় জয়কার। এখনকার মানুষ জানেই না, কিঞ্চিত মাত্র তেল দিয়ে অনেক তরকারী রান্না করা করত, তাদেরই পূর্ব পুরুষেরা। বর্তমানে তেলের কারণে মানুষও সমান তালে অসুস্থ হতে থাকে। ফলে কোলেস্টেরল মানুষের জীবন সঙ্গী হয়ে উঠে। দেহ মুঠিয়ে যাওয়া সহ হাজারো রোগের উপসর্গ এই তেল।
Discussion about this post