রেস্টুরেন্টে ঢুকার মুখেই কয়েকজনের পাতে কচুর লতির তরকারী দেখলাম! রান্নায় কষ্ট ও সময়ের ব্যাঘাত বলে প্রবাসীদের ইচ্ছা থাকলেও এটা রান্না করে খেতে পারেনা। হঠাৎ করে রেস্টুরেন্টে যখন এই তরকারীর ব্যবস্থা হয় তখন তো সবার কাছেই লোভ লাগবে। চিংড়ী দিয়ে রান্না করা এই কচুর লতির প্রতি যার নজর যাবে, নির্ঘাত সে এটারই অর্ডার দিবে।
আমিও যথারীতি বসেই কচুর লতির জন্য অর্ডার হাঁকালাম। বলতে দেরী, আনতে দেরী নেই। মনে হল কাষ্টমার সম্পর্কে তাদের গণনা-পড়া আছে। এই তরকারী চাইবেই! তাই বেশ কিছু প্লেট আগেই সাজিয়ে রেখেছিল। মুখে দিলাম সুস্বাদু লেগেছে কিন্তু তিন গ্রাস মুখে ঢুকাবার আগেই গলা কড়-মড় করে চুলকিয়ে উঠল। আমরা তো গ্রামের ছেলে, লতি কোন নতুন জিনিষ ছিলনা। মনে হল এটা এক অচেনা কচুর লতি, যেন আফ্রিকা থেকে এসেছে! বেজায় চুলকানি যেন বুনো ওল!
ঠিক এমনি সময় সামনে এক দেশী ভাইয়ের আগমন। দর্শনে মনে হচ্ছে একটু চক্ষু-লজ্জার অভাব আছে। তিনি উঁকি দিয়ে, একটু দাড়িয়ে, কারো কাঁধের উপর দিয়ে অন্যজনের প্লেটের দিকে তাকিয়ে দেখছেন, কোন তরকারীর চেহারা কেমন, কোনটা যুতসই হতে পারে। আমার পাতের তরকারীর দিকে দু’বার নজর বুলালেন।
আমি তার আবেদন সঠিক বুঝতে পেরেছিলাম। তাকে ফিসফিস করে বললাম, কচুর লতি নিবেন না, ভীষণ চুলকায়! মনে মনে চিন্তা করলাম সে অন্য তরকারী নিলেও আমার থেকে কিছুটা খেতে দিব। কাজ হল না, যথারীতি লোভ বিজয়ী হল, সটান দাড়িয়ে হেঁড়ে গলায় অর্ডার দিল, কচুর লতি দেন। দ্রুততার সহিত লতি হাজির। বেয়ারা পিছন দিকে ঘুরতেই চুপি চুপি তিনটি লতি গলাধঃকরণ করে নিলো এবং প্লেটটিকে একটু সাজিয়ে দিল। তিনি ডাল নিলেন, নুন চিঠালেন এবং কি যেন ভেবে বেয়াড়াকে কাছে ডেকে নিয়ে বললেন, “লতি ফেরত নিয়ে যান কেননা সামনের এই লোক বলছে আপনাদের লতিতে নাকি গলা চুলকায়!
‘অল্প শোকে কাতর আর অধিক শোকে পাথর’। আমি নিজেও বুঝতে পারছি না আমার অবস্থান কোথায়? এই আগন্তুকের গলা আমার কাছে নিষ্ঠুরের মত লাগছিল। ভয়ানক লজ্জা পেলাম, আত্ম-যাতনায় কষ্ট লাগছে। ইচ্ছে হচ্ছে মাটি যদি দু’ভাগ হয়ে যেত তাহলে নীচের দিকে ঢুকে লুকিয়ে পড়ি।
ব্যাচেলর জীবন বেশীর ভাগ সময় বাইরে খাওয়া লাগে, তাই এই হোটেলে আমি প্রায়শই খাই। কেন জানি হোটেল মালিক আমাকে ভিন্ন ধরনের আতিথেয়তা করে, সম্মান দেখায়। তার শিক্ষিত ভাগিনা এই রেস্টুরেন্টে চাকুরী করে। আমি খেতে গেলে তার কাজ কমিয়ে দিয়ে টেবিলে আমার সাথে কথা বলতে বসিয়ে দেয়। সেই ব্যক্তির দোকানে আমি এভাবে বিব্রতর পরিস্থিতির মুখোমুখি হব ভাবতে পারিনি।
বারে বারে ভাবছি, আমিতো দোষ করিনি, ঐ ব্যক্তিকে সত্য কথাই তো বলেছি, তাহলে অনর্থক কেন এত লজ্জা করছি। আবার ভাবছি রেস্টুরেন্ট ওয়ালা তো দাবী করতে পারে, আপনাকে আমি শ্রদ্ধা করি, লতিতে গলা চুলকায় এটা তাকে না বলে আমাকে বলাটাই উচিত ছিল। এসব ভাবার ফাঁকেই সেই ব্যক্তিটি তার খানা শেষ করে উদাও হয়ে গেল।
খাদ্যের বিল দিতে গিয়ে শরম পাচ্ছিলাম। তিনি জানি আবার কি বলেন! ভদ্রলোক জানালেন তিনি সবই দেখেছেন। বললেন পঁচিশ বছর ধরেই তিনি ব্যবসা করেন, ফলে চিচিং-বাটপার সবই চিনেন। তিনি জানালেন, “আপনি ভদ্র মানুষ কিন্তু ভদ্রতার মূল্য সবাই দেয় না, সবাই বুঝেও না। আপনি প্রবাস জীবনে দেশী মানুষ হিসেবে তাকে ভালবেসেছেন। সে তা করেনি। সে আপনাকে বিক্রয় করল এই ভেবে যে, আপনি ফেঁসে গিয়ে শরম পেলে তার কি? আপনি তো কোনদিন তার কাজে আসবেন না”। তাই সবাইকে চোখ বন্ধ সহযোগিতা দিতে নাই। মূলত প্রবাস জীবনে আমাদের দেশী ভাইয়ের শিষ্টাচার মোটেও সুন্দর নয়। এদের কারো খাসিয়তে এত নীচতা প্রকাশ পায়, যার কারণে অনেকে জাতি ধরে গালি দেয়।
Discussion about this post