মহান আল্লাহ বলেছেন, “স্বহস্তে উপার্জনকারী আল্লাহর বন্ধু”। দুনিয়াতে স্বহস্তে উপার্জনকারীদের সিংহভাগ মানুষই শ্রমিক। কিংবা হাতের শ্রম বেঁচে খায় যারা, তারাই প্রথম শ্রেণীর শ্রমিক।
রাসুল (সাঃ) বলেছেন,
“শ্রমিকের দেহের ঘাম শুকিয়ে যাবার আগেই, শ্রমিকের পাওনা তাকে বুঝিয়ে দাও”
এভাবে আল্লাহ এবং আল্লাহর রাসুল (সাঃ) শ্রমিক ও শ্রমের মূল্য দিয়েছেন।
মোহাম্মাদ (সাঃ) এর প্রিয়তম কন্যার জন্যে ব্যবসায়ী ধনীরা বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এলেও, তিনি তার কন্যা ফাতিমাকে (রাঃ) বিয়ে দেন একজন দিন মজুর শ্রমিক আলী (রাঃ) এর সাথে।
অন্নের সংস্থান করতে আলী (রাঃ) বের হয়েছিলেন শ্রমের সন্ধানে। পথিমধ্যে এক মহিলা মাটির দেওয়াল তৈরি করতে কাদামাটির কাই বানাচ্ছিলেন। তিনি তার কাজে শ্রমিক হিসেবে নিজেকে উপস্থাপন করেন।
মহিলা গভীর কুয়া থেকে প্রতি বালতি পানি তোলা, শ্রমের বিনিময়ে একটি করে খেজুর প্রদানের চুক্তি করেন। আলী (রাঃ) ষোল বালতি পানি তুলে ষোলটি খেজুর নিয়ে ঘরে ফিরেন।
এমন শ্রমসাধ্য আয়ের খেজুর দিয়ে তিনি স্ত্রী ও দুটো সন্তানের আহার জুটিয়েছেন। এভাবে আলী (রাঃ) কখনও বন থেকে লাকড়ি জোগাড় কিংবা ঘাস খেটে বাজারে বিক্রি করে, পেশাদারী শ্রমিকের জীবিকাকে বরণ করেছেন।
এভাবে শ্রমের বিনিময়ে গরিবি জীবনকে বরণ করার জন্যে, রাসুল (সাঃ) স্বীয় কন্যার স্বামীকে কখনও ভৎসনা করেন নি! বরং দুনিয়ায় যাতে তারা সেরা সুখী পরিবার হতে পারে, সেজন্যে আল্লাহর দরবারে হাত তুলেছেন।
রাসুল (সাঃ) নিজেও শ্রমের বিনিময়ে একজন বিশ্বস্ত শ্রমিক হিসেবে জীবিকা নির্বাহ করেছেন! তিনি স্বল্প মূল্যে তপ্ত মরুভূমিতে অন্যের ছাগল চড়িয়েছেন।
তিনি একজন বিশ্বস্ত কর্মচারী হিসেবে, তদানীন্তন আরবের অন্যতম ধনী মহিলা ও ব্যবসায়ী খাদিজা (রাঃ) এর ব্যবসায়ে দীর্ঘমেয়াদী শ্রম দিয়েছেন। ফলে তিনি উচ্চ মাত্রার মুনাফা অর্জনকারী ব্যবসায়ীক হিসেবে পরিগণিত হন।
একজন বিশ্বস্ত শ্রমিক একটি ব্যবসায়ের মোড় কিভাবে ঘুরিয়ে দিতে পারে সেটা দেখে খাদিজা (রাঃ) বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে পড়েন এবং তিনি নিজেই তার কর্মচারীর প্রতি বিয়ের প্রস্তাব পাঠান!
এভাবে ইসলাম শিখিয়েছে একজন শ্রমজীবী মানুষ কিভাবে নীচ থেকে সমাজের উঁচু-স্থানে উঠে যেতে পারে। সমাজের নেতৃত্ব দেওয়া ও কর্তৃত্ব কিভাবে তার পদতলে এসে পড়ে।
আবার তিনি নিজেও ধনী ব্যবসায়ীর বিপরীতে একজন সৎ, নিরহংকার ও কর্মঠ শ্রমিকের কাছে নিজের প্রিয় কন্যাকে বিয়ে দিয়ে জীবনের দৃষ্টিভঙ্গি বদলিয়ে দিয়েছেন। শ্রমিকের জীবনকে উচ্চ-স্থানে নিয়ে গেছেন।
শ্রম বেচে খাওয়া মানুষকে ইসলাম গরীব মনে করেনা। বরং গরীব বলে সেই মানুষকে যে নির্বোধ, অলস ও অন্যের কাছে ধর্না দিয়ে জীবন চালায়।
একজন শ্রমিকের জীবনকে ইসলাম তুচ্ছ ও হেয় মনে করেনা। বরং শ্রমিকের দেহের নির্গত ঘামের ঘ্রাণ আল্লাহর আরশ পর্যন্ত পৌঁছে যায়। ফলে মহান আল্লাহ তাকে বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করে থাকে।
পৃথিবীর সকল নবীরাই জীবনের কোন এক পর্যায়ে শ্রমিক ছিলেন এবং তারা সবাই শ্রমের মর্যাদা দিয়েছেন। ফলে খেটে খাওয়া সকল শ্রমিকেরাই নবী-রাসুলদের সহযাত্রী হয়েছেন।
একজন পরিশ্রমী শ্রমিকের হাতে একটি রাষ্ট্র গড়ে উঠে যার প্রমাণ দাউদ (আ) দিয়েছেন। আর শ্রমের প্রতি মর্যাদা-দানকারী ব্যক্তির পক্ষে একটি বিশাল জাতি গড়ে উঠে, তার প্রমাণ দিয়েছিলেন মুহাম্মদ (সা) নিজেই।
আমাদের যুগে কঠোর পরিশ্রমে অভ্যস্ত শ্রমিকের হাতে নিজের কন্যাকে তুলে দেবার নজীর যেমন নেই। নিজের বিশ্বস্ত কর্মচারীকে সৎ ব্যক্তি ও শ্রম-সাধনায় নিবিষ্ট দেখার পরে তার কাছে বিয়ের প্রস্তাব পাঠানোর নজিরও নেই।
এটার মাধ্যমে বুঝা যায়, মানুষ প্রকৃতই শ্রমিক ও শ্রমের মূল্য বুঝতে পারেনি। যার ফলে শ্রমিক ও মালীক যেন একে অপরের চরম শত্রু এমন ধারণা দিয়েই সমাজের চিন্তাগুলো সাজানো।
রাসূল (সাঃ) নিজে শ্রমিক ছিলেন এবং পরবর্তীতে নিজে মালীকও হয়েছেন। আরো নবীদের এমন উদাহরণে ভরপুর রয়েছে। তাই শ্রমিকের অধিকার রক্ষায় যেন মালীকের সম্পদের ক্ষতি করা না হয়, সেটি দেখাও শ্রমিকের কর্তব্য।
আবার একদল বিশ্বস্ত শ্রমিকের হাত দিয়ে একজন মালীক মিলিয়ন ডলারের মালীক হয়ে যেন না ভাবে, এ সবই তার তীক্ষ্ণ বুদ্ধি ও একক করিৎকর্মার ফল। এই কৃতিত্বে অন্য কারো অবদান নেই!
শ্রমিক যেভাবে মালীক হতে পারে সেভাবে মালীক কিংবা মালীকের সন্তানেরাও আচানক কোন এক সময় শ্রমিক হয়ে যেতে পারে। এই বিবেক ও বোধ শক্তিকে হৃদয়ে ধারণ করাই শ্রমিক দিবসের মূল প্রতিপাদ্য বিষয়।
Discussion about this post