ঘটনার মুলে যাবার আগে বলতে হয়, শিয়া মতবাদ ইসলামী মূল স্রোতধারা থেকে সম্পূর্ণ আলাদা ও খণ্ডিত একটি গোষ্ঠী। ইসলামের কিছু অংশ মানা, কিছু অংশ অস্বীকার করা, সত্যের সাথে মিথ্যার সংমিশ্রণ আবার মিথ্যাকে সত্য বলে চাপিয়ে দেওয়া প্রবণতাই হল শিয়া মতবাদের মূল ভিত্তি। শিয়া মতবাদ অনেক শাখা প্রশাখায় বিভক্ত, আবার সেখান থেকেও বিভিন্ন মতবাদের সৃষ্টি হয়েছে। সে সব মতবাদ বা গোষ্ঠীর মধ্যে একটির নাম ‘নিজারী ইসমাইলিয়া সম্প্রদায়’। পৃথিবীতে এদের সংখ্যা কম হলেও আলোচনায় সর্বদা তাদের নাম সবার আগে চলে আসে। সচেতন মুসলমানেরাও এদের সম্পর্কে তেমন একটি ধারনা রাখেন না, কিংবা সঠিক তথ্য পাওয়া থেকে বঞ্চিত থাকেন। মুসলমানদের আচরণের সাথে কিছুটা সাদৃশ্য থাকায়, এই সম্প্রদায়কে অনেকে মুসলিম মনে করে বিরাট ভূল করে। অথচ অনেকেই জানেন না যে, এদের কাজ ও বিশ্বাসের সাথে একমত হলেই, তার ঈমান নষ্ট হবে। আবার এদের খপ্পরে পড়লে বের হওয়াটা খুবই দুরহ! এরা খুবই শক্তিশালী, প্রচুর অর্থ-বিত্তের মালিক। সংখ্যায় কম হলেও ক্ষমতার দাপট আকাশচুম্বী, আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে এদের নিয়ন্ত্রণ অবিশ্বাস্য জনক বেশী। তাদের সাথে ময়দানে লড়াই করা নয় বরং আল্লাহর প্রতি একত্ববাদ ও রাসুলের (সাঃ) প্রতি অনুগত মুসলমানদের নিজের ঈমান বাঁচানো ও নিরাপত্তা রক্ষার্থে তাদের সম্পর্কে ধারনা রাখাটা খুবই জরুরী বলেই আজকের এই প্রতিবেদন।
আগা খানদের বংশীয় উৎপত্তি ও খ্যাতি:
হাসান আলী শাহ (১৮০৪ – ১৮৮১)
তিনি আগা খান-১ হিসেবে বিশ্বব্যাপী পরিচিত এবং ইসমাইলিয়া সম্প্রদায়ের ৪৬ তম ইমাম হিসেবে বিবেচিত। তিনি ইরানের খাহাকে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা শাহ খলিল উল্লাহ ইসমাইলিয়া সম্প্রদায়ের ৪৫ তম ইমাম। ১৮১৭ সালে প্রতিদ্বন্ধি আরেকটি শিয়া গ্রুপের ইমাম মুল্লাহ হুসাইন ইয়াজদির অনুসারীদের সাথে সংঘর্ষে, তিনি কতিপয় মুরিদ সহ নিহত হন। হাসান আলী শাহ ১২ বছর বয়সে একেবারে বাল্যকালেই তাঁর পিতা থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে ইসমাইলীয়া খেলাফত প্রাপ্ত হন। তাঁর মাতা ‘বিবি শার্কারা’ পুত্রকে নিয়ে দীর্ঘদিন ইরানের বিভিন্ন স্থানে স্বামী হত্যার বিচারর জন্য ধর্না দেন। বিবি শার্কারা স্বামী হত্যার বিচার চেয়ে ইরানের রাজা ‘ফাতেহ আলী’ শাহের কাছে নালিশ দেন। রাজা ফাতেহ আলী এই হত্যা কাণ্ডের বিচার করেন। এমনকি রাজা স্বীয় কন্যা ‘সৌরভ-ই-জাহান’ কে হাসান আলী শাহের সাথে বিয়ে দিয়ে তাঁকে ‘আগা খান’ উপাধিতে ভূষিত করেন। অতপরঃ নতুন জামাতাকে ইরানের কোম নগরীর গভর্নর নিয়োগ দেন। পরবর্তীতে তিনি ইরানের কারমান প্রদেশেরও গভর্নর নিযুক্ত হন। ধারনা করা হয় আগা খান শব্দটি তুর্কি ভাষা থেকে আগত, যার অর্থ ‘মহা সম্মানিত’। হাসান আলী শাহ আরো রাষ্ট্র ক্ষমতার আশায়, আশে পাশের বিভিন্ন রাজ্যের সাথে ধন্ধ সংঘাতে জড়িয়ে পড়েন। প্রথম দিকে রাজ্য জয়ে কিছুটা সফল হলেও চারিদিকে শত্রু বাড়িয়ে ফেলার কারণে, শেষ যুদ্ধে অপ্রত্যাশিত পরাজয়ের আশঙ্কায় তিনি তাঁর লোকবল নিয়ে আফগানিস্তানে পালিয়ে যান। পরবর্তীতে আফগান সীমান্ত অঞ্চলের উপজাতি বিদ্রোহীদের নমনীয় রাখতে ব্রিটিশ সরকার তাঁকে ব্যবহার করে। ব্রিটিশের প্রতি তাঁর আন্তরিক কাজের ফল স্বরূপ, তিনি ব্রিটিশ রাজত্বের একজন নিরেট খাটি বন্ধু হিসেবে পরিগণিত হন। ব্রিটিশ রাজত্ব হাসান আলী শাহ’র বিশ্বস্ততার জন্য যথেষ্ট আস্থা-ভাজন ছিলেন। পরবর্তীতে তাঁর অধঃস্থন বংশধরেরা উত্তরাধিকারী সূত্রে, নামের শেষে আগা খান লিখতে থাকেন। ব্রিটিশের কৃপায় এক পর্যায়ে তিনি তাঁর অনুসারী সহ ভারতের বোম্বে নগরীতে চলে আসেন এবং সেখানেই তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
আকা আলী শাহ (১৮৩০-১৮৮৫)
আকা আলী, আগা খান-২ হিসেবে বিশ্বব্যাপী পরিচিত। তিনি হাসান আলী শাহের জ্যৈষ্ঠ পুত্র এবং ইসমাইলীয়া সম্প্রদায়ের ৪৭ তম ইমাম মনোনীত হন। তাঁর জন্ম হয় ইরানে। যেহেতু তাঁর বাবা কোম ও কারমান নগরীর গভর্নর ছিলেন এবং তাঁর মাতা রাজ কন্যা ছিলেন। সে হিসেবে ইরানী রাজ পরিবারে তিনি প্রিন্স খেতাবে বড় হয়ে উঠেন। আকা আলী তথা আগা খান – ২, ব্যক্তি জীবনে উচ্চ শিক্ষিত মানুষ ছিলেন। পিতার মৃত্যুর পর তিনি উত্তরাধিকারী সূত্রে ইসমাইলীয়া সম্প্রদায়ের ধর্মীয় প্রধান হন। পিতার ধর্ম প্রসিদ্ধি এবং মাতার রাজত্ব প্রসিদ্ধি তাঁকে বিশ্বময় পরিচিতি করে তুলে। তিনি পিতা-মাতার দুটি খ্যাতিকে দক্ষতার সাথে কাজে লাগাতে পেরেছিলেন। জন্ম লগ্ন থেকেই ব্রিটিশ রাজত্বের বাহুল্য ও আশীর্বাদ তাঁকে বেষ্টন করে রেখেছিল। একজন ধর্মীয় প্রধান হিসেবে ইসমাইলীয়া সম্প্রদায়ের পক্ষে তিনি পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ করেন। তিনি প্রিন্স হিসেবে একাধারে প্রতিটি রাষ্ট্রের সম্মান নিয়েছেন আবার ধর্মগুরু হিসেবে নিরাপত্তা ও মর্যাদা গ্রহণ করেছেন। ব্যক্তি হিসেবে তিনি ব্রিটিশ সরকারের কাছে পিতার চাইতেও অনেক বেশী আস্তা ভাজন হয়ে উঠেন এবং ব্রিটিশ রাজত্বের পক্ষে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে কাজ করেছেন। এর ফলে, ব্রিটিশের কনোলিয়াল দেশগুলো (যেসব দেশে ব্রিটিশের ক্ষমতা কার্যকর ও শাসন চালু ছিল) তথা আফ্রিকা এবং দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশে যথেষ্ট প্রভাব তৈরিতে সক্ষম হন। ভারতে হিন্দু মুসলিম সমস্যায় নীতি নির্ধারক হিসেবে ব্রিটিশের বিশ্বস্ত হিসেবে, তিনি মুসলমানদের নেতা হয়ে ভারতীয় মুসলমানের পক্ষে নেতৃত্ব দিয়েছেন! ১৮৮৪ সালে নিউমোনিয়া রোগে আক্রান্ত হয়ে ভারতের পুনেতে মৃত্যুবরণ করেন। চার বছর পরে তাঁর মরদেহ ইরাকের নাজাফ নগরীতে স্থানান্তরিত করা হয়। পরবর্তী বংশধর গন তাঁর পিতা ‘আগা খান’ পদবীর মত, আকা আলীর শাহ’র ‘প্রিন্স’ পদবীও বংশ পরম্পরায় ব্যবহার করতে থাকেন।
স্যার সুলতান মোহাম্মদ শাহ (১৮৭৫-১৯৫৭)
তিনি আগা খান – ৩ হিসেবে বিশ্বব্যাপী পরিচিত। মাত্র ৮ বছর বয়সে শিশুকালেই পিতার নির্দেশনার মাধ্যমে তিনি ইসমাইলীয়া সম্প্রদায়ের ৪৮ তম ইমাম মনোনীত হন। তিনি পাকিস্তানে করাচীতে জন্মগ্রহণ করেন। একজন ধর্ম গুরু হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবার মত জ্ঞান ও যোগ্যতা অর্জনের প্রতি তার মা সর্বদা সচেষ্ট ছিলেন। ইউরোপীয় শিক্ষার প্রতি তাঁর প্রবল আকর্ষণ ছিল। দুনিয়ার বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ইসমাইলীয়াদের তিনি একত্রিত করেন। এ কাজে তিনি ব্রিটিশের সরাসরি সহযোগিতা ও পরামর্শ পেয়েছেন। ১৮৯৭ সালে রানী ভিক্টোরিয়া কর্তৃক ব্রিটিশ সরকার প্রদত্ত ‘নাইট কমান্ডার’ উপাধি প্রাপ্ত হন। ১৯০২ সালে তাঁর রাষ্ট্রীয় মর্যাদা আরো বেড়ে যাবার কারণে, ব্রিটিশ সপ্তম এডওয়ার্ড তাঁকে ‘নাইট গ্র্যান্ড কমান্ডার’ উপাধিতে ভূষিত করেন। তখন থেকেই তিনি নামের আগে স্যার সুলতান লিখতে থাকেন। স্যার শব্দটি ব্রিটিশের অন্ধ আনুগত্যের একটি সম্মানজনক স্বীকৃতি। এছাড়াও তিনি আরো অনেক খেতাব প্রাপ্ত হয়েছিলেন। যেমন, নিজ সরকারের বিশ্বস্ত, চৌকস এবং সেরা কর্মকর্তা হিসেবে জার্মান সম্রাট তাঁকে খেতাব দেন। এমনকি তুর্কি সম্রাট ও পারস্য সাম্রাজ্য থেকেও তিনি রাষ্ট্রীয় স্বীকারোক্তি অর্জন করেন। ফলে তিনি পুরো ভারতে অসম্ভব ক্ষমতা বান ব্যক্তি এবং ব্রিটিশের নিকট শ্রেষ্ঠতম বিশ্বস্ত মুসলমান হিসেবে স্বীকৃতি হাসিল করেন! ১ম বিশ্বযুদ্ধের পর তিনি আরব ও ইউরোপীয় ঘোড়ার সংমিশ্রণে উন্নত তেজি ঘোড়ার সংকর জাত সৃষ্টি করে দুনিয়া-বাসীকে চমক লাগিয়ে দেন। এসব ঘোড়া বাজারে বিক্রি করে, বহু মিলিয়ন ডলার অর্থ সম্পদের মালিক হন। প্রতিযোগিতার জন্য সংকর জাত ঘোড়া সৃষ্টি করার পদ্ধতি শুধুমাত্র তাঁর দখলেই ছিল। সংকর জাতের নতুন প্রজাতির ঘোড়ার সৃষ্টির পিছনে মেধা খাটাতে গিয়ে, তাঁর দৃষ্টি অন্যদিকে প্রসারিত হয়ে যায়। তিনি তাঁর অনুসারীদের নির্দেশ দিয়েছিলেন, নারী পুরুষ সবাইকে উচ্চ শিক্ষিত হতে হবে, তাহলে সম্পদ, খ্যাতি, ক্ষমতা পদতলে লুটিয়ে পড়বে। নামী-দামী বিদ্যালয়ে পড়তে হবে, তাহলে ক্ষমতাবান ব্যক্তিদের সন্তানের সাথে পরিচিত হবে ফলে খ্যাতিমানদের সাথে বন্ধুত্ব হবে। তাদের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হবে, তাহলে পুরো পৃথিবীতে একটি ক্ষমতাশালী জাতি হিসেবে বেড়ে উঠতে পারবে।
তৃতীয় আগা খান তাঁর বহুমুখী প্রতিভা ও খ্যাতি দিয়েই পুরো ব্রিটিশ রাজত্বে, আফ্রিকা থেকে এশিয়ার বিশাল জনপদে, তার মতাদর্শের অনুসারীদের ক্ষমতার প্রভাব বলয়ে নিয়ে আসতে সক্ষম হন। সকল অনুসারীকে শিক্ষিত করে তুলতে তিনি শতভাগ সফল ছিলেন। আবার তাদেরকে বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় পদে বহাল, পেশাদারী ব্যবসায়ী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। তিনি অল ইন্ডিয়া মুসলিম কাউন্সিলে ক্ষমতাধর ব্যক্তি হিসেবে প্রথম প্রেসিডেন্ট মনোনীত হন! পৃথ্বী কাউন্সিলের সদস্য ও লীগ অব নেশনের মেম্বার হিসেবে ভারতের হয়ে তিনি ব্রিটিশের প্রতিনিধিত্ব করেছেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষে ব্রিটিশ বহু টুকরায় বিভক্ত হয়ে যায়। মধ্য প্রাচ্য, ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, কেনিয়া, রুয়ান্ডা, তাঞ্জানিয়া, উগান্ডা, জায়ার সহ পৃথিবীর বহু ভূ-খণ্ডের ইসমাইলীয়া সম্প্রদায়কে রক্ষা, একত্রিত করা, ও স্বাবলম্বী করার কাজে ব্যাপক ভূমিকা রাখেন। পৃথিবী ব্যাপী পরিচিতি দিয়ে তিনি প্রতিটি দেশের রাষ্ট্র প্রধানদের সহযোগিতা ও মনোযোগ কেড়ে নিতে পারদর্শীতা দেখান। দুনিয়া-ব্যাপী ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ইসমাইলীয়া সম্প্রদায়কে একত্রিত করে রাজনৈতিক স্বাধীনতা এনে দিতে সক্ষম হয়েছেন। ব্রিটিশ সরকার মুসলমানদের রক্ষার নামে যাবতীয় রাষ্ট্রীয় সুযোগ সুবিধা এই সম্প্রদায়কেই দিয়েছেন! ১৯৫৭ সালে সুইজারল্যান্ডের জেনেভা নগরীতে তৃতীয় আগা খান মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী তাঁকে মিশরের নীল নদ বিধৌত পর্যটন কেন্দ্র আসওয়ানে সমাহিত করা হয়। তিনি মৃত্যুর আগেই তাঁর সমাধি তৈরি করে রেখেছিলেন। মৃত্যুকালে একটি উইলে লিখে যান, ‘পারমাণবিক যুগের আধুনিকতায় সকল কিছুই বদলে গিয়েছে। তাই নতুন নেতৃত্ব সৃষ্টিতে, ইসমাইলীয়াদের রক্ষার্থে, নিজ সম্প্রদায়কে উচ্চ শিখরে নিয়ে যেতে, ১৩০০ শত বছরের নিয়ম রেওয়াজ ভঙ্গ করে, ছেলের ঘরের নাতি তথা করিম আগা খানতে ইসমাইলীয়া সম্প্রদায়ের ৪৯ তম ইমাম নির্বাচিত করা হইল’।
প্রিন্স করিম আগা খান – ১৯৩৬
তিনি আগা খান-৪ হিসেবে প্রসিদ্ধ। যদিও তাঁর স্থান হত ৫ নম্বরে, তাঁর পিতা ও চাচাকে ডিঙ্গিয়ে তাঁকে মনোনয়ন দেওয়া হলে তিনি চতুর্থ আগা খান হিসেবে স্থলাভিষিক্ত হন। তিনি ১৯৩৬ সালে সুইজার ল্যান্ডের জেনেভায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর দাদার উইল মোতাবেক পিতা প্রিন্স আলী আগা খান ও চাচা প্রিন্স সদরুদ্দীন আগা খানকে টপকে মাত্র ২০ বছর বয়সে ১৯৫৭ সালে ইসমাইলীয়া সম্প্রদায়ের ৪৯ তম ইমাম মনোনীত হন। ইউরোপের সবচেয়ে দামী প্রতিষ্ঠান সুইজারল্যান্ডের Institut Le Rosey School থেকে সদ্য বের হওয়া প্রিন্স করিম আগা খান ইসমাইলিয়া সম্প্রদায়ের প্রধান ধর্মীয় ইমাম তথা ধর্ম গুরুর দায়িত্ব পেয়ে যান। প্রধান ইমাম হিসেবে দায়িত্ব পাবার দুই বছর পরে ১৯৫৯ সালে হার্ভাড ইউনিভার্সিটি থেকে কৃতিত্বের সাথে ইতিহাসে গ্রাজুয়েশন শেষ করেন। তিনিই বর্তমানে ইসমাইলীয়া সম্প্রদায়ের প্রধান ধর্মীয় ইমামের দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন। আন্তর্জাতিক ফোবর্স ম্যাগাজিনের ২০১০ সালের তথ্য অনুযায়ী প্রিন্স করিম আগা খান ৮০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের সমপরিমাণ সম্পদের মালিক। পৃথিবীর সেরা দশ জন রাজকীয় ধনীর একজন তিনি। তাঁর অগণিত সম্পদ রাজির মধ্যে ব্যক্তিগত দুইটি গোলন্দাজ বিমান একটি বড় হেলিকপ্টার রয়েছে। নিজের বিমান ও নিজস্ব বাহিনী নিয়ে তিনি পৃথিবীতে ভ্রমণ করেন। প্রিন্স করিম আগা খান জগত বিখ্যাত অনেক গুলো কোম্পানির মালিক ও পরিচালক। হোটেল, মিল, ফ্যাক্টরি, শিল্প কারখানা, চা বাগান সহ হেন কোন লাভজনক প্রতিষ্ঠান দুনিয়ায় বাকী নাই, যেখানে তাঁর অর্থনৈতিক অবস্থান নাই। তাঁর নিজের কোন রাজ্য না থাকার পরও, পুরো দুনিয়াতে তিনি রাজার মত সম্মান কুড়িয়ে নিতে সক্ষম হয়েছেন। বর্তমানে তাঁর উপাধী হচ্ছে, His Royal Highness the Aga Khan IV.
ইসমাইলীয়া সম্প্রদায়ের বিশ্বাস, দুনিয়ার বিত্ত-বৈভব ও আখেরাতের শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন, দুটোই হল ইমানের মূল দাবী। তাই তাঁদের ইমামদেরকে, দুই জগতের খ্যাতি, যশ, ঐশ্বর্য, সম্পদ, সুখ লাভের জন্য; পরকালীন ধর্মীয় জ্ঞান যেমন দরকার। তেমনি দুনিয়ার শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের জন্য; বুদ্ধি-ভিত্তিক দক্ষতা, তীক্ষ্ণ প্রতিভা, আধুনিক জ্ঞান, ব্যবসা-প্রশাসন ও বাণিজ্য ব্যবস্থা সম্পর্কেও পান্ডিত্য থাকতে হবে। বর্তমানে ইসমাইলীয়া সম্প্রদায়ের কাছে, ইহ জাগতিক ও পর-কালীন জ্ঞান, বিজ্ঞানে প্রজ্ঞাবান ব্যক্তি হিসেবে প্রিন্স করিম আগা খানের চেয়ে যোগ্য উত্তরসূরি আসলেই দ্বিতীয়টি নাই! তাঁর অগাধ সম্পদ রাজির পরিমাণ, তা অর্জন করার আধুনিক জ্ঞান, সুচারু পরিচালনা, সময়ের সাথে বানিজ্যের প্রতিযোগীতা, বিশ্বময় বাজার সৃষ্টি এবং অনুসারীদের হাতের মুঠোয় রাখতে পারার মাধ্যমে বুঝা যায়, তার যোগ্যতা দক্ষতার মান কোন পর্যায়ে! এই সম্প্রদায়ের বিভিন্ন ইমামদের সময়ে ধর্মীয় রীতি রেওয়াজে পরিবর্তন, পরিবর্ধন, সংযোজনের আলামত দেখা যায়। মাত্রাতিরিক্ত পরিবর্তনের দোলায় ইসলাম ধর্মের কেন্দ্র থেকে বিচ্যুত এই গোষ্ঠীটি বর্তমানে প্রায় খৃষ্ট ধর্মের মত হয়ে গিয়েছে। তফাৎ শুধু, এদের কিছু আচরণ দেখতে এখনও মুসলমানের মত। তারা নিজেদের ইসমাইলিয়া মুসলমান দাবী করে, এবাদত গৃহ দেখতে মসজিদের মত। নিজেদের খাঁটি মুসলমান দাবী করার বিপরীতে যখন তাদের অবস্থান এমন দেখা যায় যে; ধর্মের প্রতি অনুগত, বিত্তশালী, আধুনিক শিক্ষিত কিংবা সরকারের বড় কর্মকর্তা হিসেবে! তখন সাধারণ মুসলমান দ্বিধায় পড়ে যায়, কদাচিৎ নিজের অজান্তেই কোন এক সময় তাদের প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠে। দুনিয়াবি সমস্যার সাময়িক সমাধান কল্পে চিরতরে তাদের হাতে ইমান আকিদা সব বিসর্জন করে বসে। একজন দুর্বল মানুষ তো দূরের কথা অধিক সচেতন মানুষও বুঝতে পারেনা কার পাল্লায় পড়েছে এবং শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়ে ঠেকবে!
১. নিজারী ইসমাইলিয়া সম্প্রদায়, শিয়াদের মধ্য থেকে একটি দলছুট সম্প্রদায়। তাদের বিশ্বাসের মূলে শিয়া মতবাদ থাকায় বুঝা যায় সুন্নিদের সাথে তাদের সাংঘার্ষিক চিন্তাধারা আছেই। শিয়ারা দাবী করে আল্লাহ একজন এবং মোহাম্মাদ (সাঃ) আল্লাহর রাসুল। রাসুল (সাঃ) মৃত্যুকালে খেলাফতের ইমামত আলী (রাঃ) কে দিয়ে যান। রক্তের বন্ধনে আবদ্ধ যে ইমামত রাসুল (সাঃ) আলী (রাঃ) দিয়ে যান, সে ইমামত একই ভাবে তাদের অধঃস্থন বংশধরদের মাঝে বংশ পরম্পরায় চলতে থাকবে! এটাই সকল শিয়াদের মূল দাবী। এই ক্ষেত্রে নিজারী শিয়ারা দাবী করে যে, নিজারী ইমামদের বংশ ধারা হযরত আলী (রাঃ) ও হযরত ফাতেমা (রাঃ) এর ঔরসজাত বংশ ধারা থেকে প্রবাহিত। নিজারী শিয়াদের দাবী ও তালিকা মোতাবেক তাদের প্রথম ইমাম হল আলী (রাঃ)। তাঁর পুত্র হুসাইন (রাঃ) দ্বিতীয় ইমাম, যথাক্রমে তাঁর পুত্র জয়নুল আবেদিন তৃতীয়, তাঁর পুত্র মোহাম্মদ আল বাকের চতুর্থ, তাঁর পুত্র ঈমাম জাফর সাদেক (রহঃ) পঞ্চম। ঈমাম জাফর সাদেকের দুই সন্তান, যথাক্রমে মুসা কাজেম ও ইসমাইল। এই ইসমাইল এর ১৪ তম অধঃস্থন পুরুষ নিজার এবং নিজারের ২৭ তম অধঃস্থন পুরুষ প্রথম আগা খান। খলিফা আলী (রাঃ) এর সূত্র ধরে তাদের হিসেবে বর্তমানের প্রিন্স করিম আগা খান ইসমাইলিয়া সম্প্রদায়ের ৪৯ তম ইমাম।
২. এদের নিজস্ব কোন ধর্মগ্রন্থ নাই। তারা দাবী করে যে, কুরআন হল তাদেরও ধর্ম গ্রন্থ। তারা আরও দাবী করে যে, কোরআন সর্বকালের সমাধান দিতে দুনিয়াতে আসেনি। ১৪০০ বছর আগে তদানীন্তন আরবের সমস্যার সমাধান দিয়েই কোরআনের কাজ শেষ হয়ে গিয়েছে। তাদের ভাষায় সুন্নিরা কোরআনের ব্যাখ্যা অনুযায়ী ওহী আসার ছিল সিলা বন্ধ হয়ে গিয়েছে বলে যে দাবী করা হয়, সেটিও আসলে ভুল ব্যাখ্যা! তাদের দৃষ্টিতে সঠিক হল, কেয়ামত পর্যন্ত আসমানি ওহী আল্লাহর সু-নির্দিষ্ট বান্দাদের উপর আসতে থাকবে। যেভাবে ইসমাইলিয়া ইমামদের উপর আসে। ফলে তারা কোরআনের কথা অস্বীকার করেনা বরং সম্মান করে, তবে কোরআনে ১৪০০ বছর পূর্বের তদানীন্তন সময়ের জন্য প্রয়োজনীয় তথ্য আছে বলে, কাউকে পড়তে উৎসাহিত করা হয়না। তাদের মতে এই ১৪০০ বছরে পৃথিবীর অনেক কিছুই বদলিয়েয়ে, কোরআনে সে সবের কোন আধুনিক ব্যাখ্যা নাই। কোরআনে এসবের ব্যাখ্যা নাই বলে, ধর্ম তো আর এক স্থানে দাঁড়িয়ে থাকতে পারেনা! তাই ধর্ম-কর্মের গতি অব্যাহত রাখতে, ধর্মের সাথে সাজুস্য রেখে, আধুনিক প্রশ্নের ব্যাখ্যা ও দিক নির্দেশনা দিবেন ধর্মের ইমাম গন। অনুসারীদের কিছু জানতে হলে ইমাম কিংবা ইমাম নিযুক্ত কোন ধর্মীয় পুরোহিতের শরণাপন্ন হওয়া বাঞ্ছনীয়ই। এটাই হল ইসমাইলিয়াদের ঘোষিত রীতি।
৩. ইসমাইলিয়াদের ইমাম নির্বাচিত হন উত্তরাধিকার সূত্রে। যে ভাবে উপরে কয়েকটি উদাহরণ দেওয়া হয়েছে। রাসুলের (সাঃ) বংশধর হবার সুবাধে ইসমাইলিয়া ঈমাম দের সকল পাপ মার্জনীয়। তাঁদের পাপ সমূহ লিপিবদ্ধ হয়না, তাঁরা চিরকাল নিষ্পাপ ও নিষ্কলঙ্ক থাকবেন। অধিকন্তু ইমামেরা জগতের সমস্ত পাপী ইসমাইলিয়া অনুসারীর পাপ ক্ষমা করতে পারেন। একজন ইমাম যে কাউকে নিষ্পাপ করতে পারেন। পাপীরা ইমাম আগা খানের নিকট এসে পাপের পায়চিত্তের জন্য ক্ষমা চাইলে, তিনি স্বীয় গুনে তা ক্ষমা করার অধিকার রাখেন।
৪. ইমাম আগা খান দাবী করেন যে, তিনি খোদার প্রত্যক্ষ নূর, তথা আলো। তাঁর আর খোদার মাঝে কোন পর্দা নাই। তাই খোদা তায়ালা পৃথিবীর সকল ক্ষমতা তাঁর হাতেই ন্যস্ত করেছেন। তিনি কারো কল্যাণ ও অকল্যাণ দুটোই করতে পারেন। তাই তার পায়ে সিজদা করা যাবে এবং তা করা উচিত। ইমামের নিযুক্ত কোন ধর্মীয় গুরু, অনুসারীদের পাপ মোচন করতে পারেন। প্রিন্স করিম ইমাম আগা খান পাকিস্তান ভ্রমণে আসলে পর, শত শত যুবতি নারী শ্রদ্ধা ও গভীর ভালবাসায় রাস্তায় দুই পাশে শুয়ে, মাথার চুল বিছিয়ে রাস্তা বানিয়েছিলেন। ইমাম প্রিন্স করিম আগা খান যুবতীদের বিছানো চুলের উপর দিয়ে পায়ে হেটে, তাদের উৎসর্গকে ধন্য করেছিলেন।
৫. ইসমাইলিয়ারা ইসলাম ধর্মের রীতি-নীতি অনুসারে নামাজ, রোজা, হজ্জ পালন করেনা। বরং নামাজের স্থলে দৈনিক তিন বার আল্লার সাথে শিরিক মিশ্রিত কিছু দোয়া পড়ার নিয়ম শিক্ষা দিয়ে থাকে। রোজার বেলায় বলা হয় তা ব্যক্তিগত অভিরুচির ব্যাপার। হজ্জের ব্যাখ্যার বলা হয় তা মহান আল্লাহর দিদার প্রাপ্তির মাহেদ্রক্ষণ। তা জীবনে একবার করতেই হয়, বর্তমান ইমাম হিসেবে, প্রিন্ম করিম আগা খানের চেহারার দিকে নজর দিতে পারলেই, হজ্ব কর্ম সম্পাদন হয়ে যায়। প্রিন্ম করিম ব্যবসায়ের উদ্দেশ্যে কখনও বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ করে থাকেন। তখন তিনি তাঁর অনুসারীদের দেখা দেওয়ার ব্যবস্থাটি করে থাকেন। এতে করে অনুসারীদের হজ্জের অনুষ্ঠানটি পালন করার সুযোগ ঘটে যায়। এসব কাজে প্রতিটি দেশের সরকার গন নিজ উদ্যোগে নিরাপত্তার ব্যবস্থা দিয়ে থাকেন। বাংলাদেশে তিনি যতবার এসেছেন, সরকারের পক্ষ থেকে ততবার লাল গালিচা সম্বর্ধনা পেয়েছেন।
৬. আগা খানের নির্বাচিত ধর্মীয় পুরোহিতেরাও অনেক সম্মানিত ব্যক্তি হিসেবে বিবেচিত। এসব পুরোহিত বিভিন্ন দেশে গিয়ে হজ্জের কাজটি মিটিয়ে দেন এবং অনুসারীদের ক্ষমা করে আসেন। অনুসারীরা বিশ্বাস করে, ইমামদের মাধ্যমে কোন ভাবে, একবার ক্ষমা পেয়ে গেলে, একই অপরাধের জন্য কেয়ামতের দিন, নতুন করে কোন প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হবেনা। ফলে অনুসারীরা ইমাম কিংবা পুরোহিতদের প্রতি খুবই অনুগত থাকে!
৭. ব্যক্তিগত জীবনে বর্তমান ঈমাম প্রিন্স করিম আগা খান, বাল্যকালে কেনিয়া এবং বাকী জীবন ইউরোপে কাটানোর কারণে খৃষ্ট ধর্মের প্রভাব তাঁকে আচ্ছাদিত করেছিল। তিনি খৃষ্টধর্মের বাইবেলের সু-সমাচার পদ্ধতির উপর আকৃষ্ট ছিলেন। তাঁর অনুসারীদের ক্ষমা করা করার রীতি, রেওয়াজ দেখতে বাইবেলের মতই। ধর্ম বিশ্বাস মুসলমানদের মত না হয়ে তা খৃষ্ট ধর্মের কাছাকাছি হয়ে যায়। নম্র-ভদ্রতায় খৃষ্টীয় চরিত্র, বাহ্যিক দৃষ্টিতে পরিপূর্ণ ইসলামী কায়দা, পীরদের মুরিদ করার স্টাইলে, এসব কাজ করা হয়। সাধারণ মানুষ এতে বিভ্রান্ত হয়ে যায় এবং নিজের অজান্তে ভুল পথে পরিচালিত হয়।
৮. ইমাম করিম আগা খানের বড় মেয়ে, ‘প্রিন্সেস জাহারা’ হার্ভাড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গ্রাজুয়েশন শেষে বিয়ে করেন ব্রিটিশ মডেল ও ব্যবসায়ী ‘মার্ক বয়ডেন’ কে। এর পর থেকে ইসমাইলিয়া সম্প্রদায়ের মাঝে খৃষ্টানদের অনুপ্রবেশের সুযোগ ঘটে যায়। এই ঘটনার পরে, ইমামে জামান ধর্মীয় রীতিতে সংশোধনী আনেন। নতুন আইনে বলা হয়, প্রতিপত্তি লাভের আশায় ইসমাইলিয়া মুসলমান মেয়েরা যদি খৃষ্টান ছেলেদের পছন্দ করে, তাহলে কন্যার বাবা-মা বিয়েতে বাধ সাধতে পারবে না। তাদের কে তাদের মত সিদ্ধান্ত নেবার সুযোগ দিতে হবে। উল্লেখ্য, স্বামী-স্ত্রীর মাঝে কেউ ধর্ম পরিবর্তন করে এক ধর্মের হলে গেলে এক কথা ছিল, যেমন প্রিন্স করিম আগা খানের দুজন বিধর্মী স্ত্রী মুসলমান হয়েছিলেন, তাই সমস্যা ছিলনা। এখানে কণ্যা প্রিন্সেস জাহারা ও তাঁর হবু স্বামী কেউ তাদের স্বীয় ধর্ম পরিবর্তন করেন নি। সে জন্যই ধর্মীয় নীতিতে সংশোধনী আনাটা জরুরী হয়ে পড়েছিল।
৯. পবিত্র কোরআনে সরাসরি হারাম ঘোষিত কিছু বিষয়কে আগা খান হালাল ঘোষণা করেছেন। ইমামের তত্ত্বাবধানে একটি ইসলামী তরিকা বোর্ড পরিচালিত হয়। নতুন পরিবর্তিত কানুন গুলো তরিকা বোর্ডে পাশ হতে হয়। পাশ হবার পর পরই তা ধর্মের অনুসারীদের জন্য মেনে চলা আবশ্যক হয়ে যায়। আগা খান তরিকা বোর্ডের মাধ্যমে সুদকে হালাল ঘোষণা করেছেন। তিনি বিশ্ববিখ্যাত প্রতিষ্ঠান AKFED (Aga Khan Fund & Economic Development) গড়ে তুলে ছিলেন। যে প্রকল্পে তাদের নিজেদের মানুষের মাধ্যমে, স্বল্প সুদে দীর্ঘ মেয়াদি ঋণ দেবার ব্যবস্থা করেছেন। এই ব্যবস্থায় তারা পৃথিবীর দেশে দেশে বহুজাতিক কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করে। যার নিয়ন্ত্রণ থেকে শুরু করে উচ্চ পর্যায়ের সকল কাজ ইসমাইলিয়াদের হাতে থাকে। আবার রাষ্ট্র শক্তিরও সমর্থন পায়, কেননা প্রতিটি রাষ্ট্রই এটাকে নিজেকের দেশের উন্নয়নের গতি হিসেবে ভেবে থাকে। এসব কাজকে ইংরেজিতে “Venture Capital” হিসেবে চিত্রায়িত করা হয়। এই পদ্ধতির উদ্ভাবক স্বয়ং আগা খান নিজেই এবং এর মাধ্যমে সহজে ঋণ দেবার কারণে দুনিয়াতে তাঁর সাফল্য ও সফলতা ব্যাপকভাবে প্রসিদ্ধি লাভ করে। আজ পর্যন্ত সারা বিশ্বে AKFED এর চেয়ে শক্তিশালী কোন অর্থনৈতিক সংস্থা নাই। যার ফল ভোগ করে ইসমাইলিয়া সম্প্রদায় ভুক্ত মানুষেরা। আগা খান এসব প্রতিষ্ঠানের বিপুল পরিমাণ লাভ থেকে চ্যারিটি, সমাজ উন্নয়ন, খেলাধুলা ও সহযোগিতার নামে সাহায্য দিয়ে থাকে। এতে করে ব্যক্তি প্রিন্স আগা খান একটি প্রবল, উদার ও বিশাল হিতাকাঙ্ক্ষী মানুষ হিসেবে চিহ্নিত হয়। অন্তরালে বিভিন্ন দেশের সরকার থেকে, তিনি তাঁর ধর্মের অনুসারীদের জন্য ইচ্ছামত সুযোগ সুবিধা আদায় করে নেন। Venture Capital পদ্ধতির লাভ ও দীর্ঘ মেয়াদী স্থায়িত্ব দেখে এন,জি,ও সহ নানা ধরনের সংস্থা, আর্থিক লাভের আশায় নতুন করে বহু সাহায্য সংস্থার সৃষ্টি হয়েছে। তবে আগা খানের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য যে উদ্দেশ্যে নিবেদিত; এনজিওদের লক্ষ্য সে উদ্দেশ্যে নিবেদিত নয় বলে, এনজিও গুলো গরীবের রক্ত চোষাকে লক্ষ্য স্থির করে। এনজিওরা মার খায় এবং তাদের ঋণ নিয়ে গরীবের সংখ্যা শুধু বাড়তেই থাকে। আগা খানের সংস্থা লাভের সাথে আদর্শিক দৃষ্টি ভঙ্গিকে জড়িয়ে রাখে বলে এনজিওদের মত মার খায়না। উদারহরণ হিসেবে বাংলাদেশ ইসলামী ব্যাংকের নাম বলা যায়, যারা ব্যবসার সাথে একটি আদর্শিক দৃষ্টিভঙ্গিকে উজ্বল করতে চায়, ফলে সেটা দিন দিন উন্নতির দিকে যাচ্ছে।
১০. মুসলিম উম্মাহ ও তাদের নেতারা এসব তথ্য উপাত্ত থেকে অনেক দূরে। এসব নিয়ে ভাববার মত জ্ঞান, প্রজ্ঞা তাদের অনেকের থাকলেও তারা এসব বিষয়কে দুনিয়াবি বিষয় বলে উপেক্ষা করতে চায়। দুনিয়ার প্রতি আকৃষ্ট হবার ভয়ে কিংবা তথ্য-হীনতার কারণে এসবকে উপেক্ষা করে চলে। প্রিন্স করিম আগা খানের ইমামতে তাদের হিসেবে পুরো দুনিয়াতে অনুসারীর সংখ্যা ছিল ৫০ লাখ। সোভিয়েত রাশিয়া ভেঙ্গে বহু দেশে বিভক্ত হয়ে যাবার ফলে, আগা খান তাজিকিস্তানে ঢুকে পড়ে এবং AKFED মাধ্যমে ব্যাপক শিল্প কারখানা গড়ে তুলে। দীর্ঘ বছর কমিউনিস্টের যাঁতা কলে পিষ্ট সেখানকার মুসলমানেরা ইসলামের মূল ভিত্তি থেকে অনেক দূরে চলে যায়। এই সুযোগটি কাজে লাগায় আগা খানের অনুসারীরা। তারা মানুষদের ইহ-কালীন অর্থনৈতিক স্বাবলম্বীর সাথে সাথে পর-কালীন মুক্তির জন্য ইসমাইলিয়া ধর্মকে উপস্থাপন করে। দলে দলে মানুষ তাদের সাথে ভিড়ে যায়! এই পদ্ধতিতে শুধুমাত্র তাজিকিস্তান থেকেই প্রায় ১ কোটি অনুসারীকে দলে ভিড়াতে সক্ষম হয়! প্রিন্স করিম বিশ্বব্যাপী ঘোষণা করেন যে, এখন তার অনুসারীর সংখ্যা দেড় কোটি! ইসলামী দুনিয়ার অনৈক্য, ইহকালের সমৃদ্ধিকে দুনিয়ার লোভ ভাবা ও পর-কালীন কল্যাণের জন্য বৈরাগ্য নীতি গ্রহণ, যুগোপযোগী জ্ঞানের অভাব ও ইসলাম প্রচারে অবহেলার সুযোগ নিয়ে; ইসমাইলিয়ারা মধ্য এশিয়ার বিভিন্ন দেশ ঢুকে পড়েছে অনেক আগেই। অর্থনৈতিক সুবিধার ধুয়া তুলে, কাজাকিস্তান, তুর্কমেনিস্তান, আজারবাইজান সহ বিভিন্ন দেশের মুসলমানদের অর্থনৈতিক মুক্তির লোভ দেখিয়ে তাদের ইমান-আকিদাকে শেষ করে দিচ্ছে।
১১. আজ দুনিয়ার প্রতিটি জাতি, শক্তি ও রাষ্ট্র আগা খানের সুবিধা নিয়ে, তাদের দেওয়া অর্থে বিভিন্ন ধরনের সহযোগিতা মূলক কাজ করে যাচ্ছে। অর্থ দিচ্ছে AKFED আর তার পক্ষে কাজ করে যাচ্ছে রাষ্ট্রশক্তি গুলো। কিছু ব্যক্তি দুনিয়াবি স্বার্থের লোভে ধর্ম বিনষ্টকারী কার্যকলাপ করে যাচ্ছে। নিজের সমুদয় যোগ্যতা, দক্ষতা, বুদ্ধি, জ্ঞান, বিচক্ষণতা আগা খানের বেতনের লোভে নিজ জাতির বিরুদ্ধে ঘটিয়ে চলছে। সচেতনতা, তথ্য-উপাত্ত, দায়বদ্ধতা, দেশপ্রেম বোধ ও বিশুদ্ধ ইমানের অভাবে মুসলমানেরা দাঁড়াতে পারছে না। আগা খানের বিভিন্ন সংস্থা পাকিস্তান, ভারত, তাঞ্জানিয়া, উগান্ডা, কেনিয়া, বাংলাদেশে বহু আগে থেকেই কাজ করে যাচ্ছে। বর্তমানে তাজিকিস্তানকে পুরোপুরি করতলগত করে এখন তারা দৃষ্টি দিয়েছে মুসলিম মধ্য এশিয়ার বিশাল ভূ-ভাগের দুর্বল জনগোষ্ঠীর দিকে।
১২. আগা খানের AKFED ফান্ড এখন আরো বিশাল কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। শিক্ষা, চিকিৎসা, বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিক্যাল কলেজ, ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ সহ বিশ্বমানের অত্যাধুনিক শিল্প সমৃদ্ধ প্রজেক্ট গড়ে তুলবে। বিভিন্ন দেশে শত বিলিয়ন ডলার অর্থ এসব প্রজেক্টে ইনভেষ্টের অপেক্ষায়। সহজে নজর কারার মত যোগ্যতা, দক্ষতা, অভিজ্ঞতা এই ফান্ডের আছে। আগা খান গোল্ড কাপ দিয়ে উনবিংশ শতাব্দীর প্রায় অর্ধেক সময় তারা একাই দুনিয়াকে মাতিয়ে রেখেছিল। জাগতিক প্রতিটি বিষয়ে তাদের রয়েছে প্রচুর বিশেষজ্ঞ। তাদের সন্তানদের উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করে গড়ে তোলাকে জীবনের প্রধান সোপান মনে করে। সুতরাং তারা সংখ্যায় কম হলেও শক্তিকে বিপুল। আজ মুসলমান দের সময় এসেছে এসব বিষয় নিয়ে সচেতন হবার। এই শক্তির মোকাবেলা করতে হলে, নিজেদের সন্তানদের উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করানো ব্যতীত কোন পথ নাই। শিক্ষাকে যদি উন্নতির সোপান মনে করে সামনে পথ চলা শুরু হয়, তাহলে মুসলমানদের দুনিয়াবি এবং পর-কালীন মুক্তির পথ মিলতে পারে। তাছাড়া এসবের বিপরীতে ভূমিকা না রাখাও ইমানের দাবী নয়।
ব্যক্তি জীবনে প্রিন্ম করিম আগা খান:
বর্তমান ইমাম আগা খানের ব্যক্তিজীবনের দুই একটি ঘটনা উল্লেখ না করলে নয়। আগা খান ইমামত পাবার দুই বছর পর তথা ১৯৬৯ সালে ব্রিটিশ মডেল কন্যা ‘সারাহ’ কে বিয়ে করেন। সারাহ’র জন্য এটি ছিল দ্বিতীয় বিয়ে, তিনি মুসলমান হয়ে নাম রাখেন ‘বেগম সালিমাহ আগা খান’। দীর্ঘ সংসার জীবনের এক পর্যায়ে সালিমাহ স্বামীর আচরণে সন্দেহ পোষণ করেন! স্বামীর সাথে বিভিন্ন নারীর উঠা বসাকে সহজে মেনে নিতে পারেন নি। এই নিয়ে স্ত্রী সালিমাহ ১০ বছর পৃথক থেকেছেন। ১৯৯৫ সালে তিনি ২০ মিলিয়ন পাউন্ডের বিনিময়ে তালাক প্রাপ্ত হন। আগা খান ১৯৯৮ সালে ‘গ্যাব্রিয়েল’ নামের ইউরোপিয়ান আরেক তরুণীকে বিয়ে করেন, যিনি মুসলমান হয়ে নাম রাখেন ‘বেগম ইনারা আগা খান’। তিনিও পূর্বের স্ত্রীর ন্যায় স্বামীর আচরণের খুশী ছিলেন না ফলে ২০১১ সালে ৫০ মিলিয়ন পাউন্ডের বিনিময়ে তালাকপ্রাপ্তা হন। আগা খান পরিবারের বউ হিসেবে এই দুই রমণী পৃথিবীতে খ্যাত হয়েছিলেন, যার কারণে তাঁদের বিবাহ বিচ্ছেদের এসব কাহিনী দুনিয়ার সেরা খবরের একটি বিরাট অংশ দখল করে রেখেছিল।
তাঁর ব্যক্তি জীবনের এই কাহিনীটি নিন্দা করার জন্য তোলা হয়নি। এগুলো কোন গোপনীয় কথা নয়, বরং দুনিয়া কাঁপানো কাহিনীর মধ্যে অন্যতম। এই ধরনের কোন ঘটনা একজন সাধারণ ইসলামী নেতার জীবনে ঘটলে, দুনিয়াতে তার বেঁচে থাকা দায় হত। প্রিন্স করিম আগা খানের জীবনে এসব মামুলী ঘটনা। তাঁদের ধর্মীয় চেতনা বোধে এসব ঘটনা কোন প্রভাব ফেলেনি। বরং ২০১২ সালের হিসেব মতে, ইমাম আগা খান বিশ্বের প্রভাবশালী ৫০০ জন মুসলিম ব্যক্তিদের মাঝে ৩১ তম স্থান অর্জন করতে সক্ষম হয়েছেন! ব্যক্তি জীবনের এসব ঘটনা, তাঁর অনুসারীদের ধর্ম চিন্তায় কিংবা ধর্মের প্রতি আন্তরিকতায় কোন ব্যত্যয় হয়নি। ব্যক্তিজীবন নিয়ে তারা তাদের ইমামের সমালোচনায় পঞ্চমুখর হয়নি! এমনকি এত কিছুর পরও তিনি পাপীদের পাপ মোচনের অধিকার হারান নি। অধিকন্তু প্রতিজন নিজারী ইসমাইলিয়া শিয়া, প্রতিবছর তাদের ইমাম প্রিন্স করিম আগা খানকে তাদের ধর্মীয় ভাষায় ‘দাসন্দ’ দিয়ে থাকেন। যার পরিমাণ পৃথিবীর সকল ইমমাইলীয়া দের বাৎসরিক আয়ের ১২.৫%! ধারনা করা হয় এই ফান্ডেই প্রতি বছর হাজার মিলিয়ন ডলার জমা হয়। দৃশ্যত, অনুসারীদের ভালবাসা এই কারণেই দৃঢ় হয়েছে যে, তিনি তাঁর অনুসারীদের পর-কালীন জীবনকে হয়ত সন্দেহাতীত করে রেখেছেন, তবে দুনিয়াতে তাদের কাউকে পরমুখাপেক্ষী করে রাখেন নি। তাই সবাই তাঁকে অকাতরে ভালবেসে।
উপসংহার:
আজ প্রকৃত মুসলমানদের উন্নত চরিত্র ও উচ্চ মৌলিক গুণাবলী থাকার পরও তারা অধঃপতিত হচ্ছে। তাদের মত দ্বীন, হীন, অসহায়, দয়ার কাঙ্গাল সমাজে আর দ্বিতীয়টি নেই। আমাদের দেশের মুসলমানেরা আজ জনগণের জন্য আর্থিক কোরবানি কথা ভুলে গিয়েছে। তদুপরি কাউকে সামান্য সাহায্য করতে পারলে সমাজে ঘোষণা দিয়ে বলে বেড়ায়! সামাজিক দায়িত্ব পালন করা হয় সম্মান, সুখ্যাতি আর নির্বাচনে ভোট পাবার আশায়। সমাজ ও রাষ্ট্রে গঠন মূলক কাজ গড়ে উঠছে না। বিপরীতে ধ্বংস করে চলেছি সমুদয় কল্যাণ মূলক প্রতিষ্ঠান। জনকল্যাণে নিয়োজিত ইসলামী ব্যাংকের বিরুদ্ধে মুসলমানদের ছেলেদের উস্কে দিয়ে, ভাঙ্গার জন্য সমানে কুড়াল চালানো হচ্ছে! তীব্র গতিতে আগুন জ্বালাবার জন্য মানুষদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। ফলে প্রতিটি মুসলমানের হাত আজ ভিখারির হাতে পরিণত হয়ে গিয়েছে। অথচ আল্লাহ মুসলমানদের কে পরমুখাপেক্ষী না হয়ে স্বাবলম্বী হতে বলেছেন। আল্লাহ মুসলমানদের কে চাকুরীজীবী না হয়ে ব্যবসায়ী হতে বলেছেন। আল্লাহ বুদ্ধি বিক্রি করে বুদ্ধিজীবীর জীবন ধারণ না করে মাথাকে বিজ্ঞানে ব্যস্ত রেখে, হাতকে কারিগরিতে লাগাতে বলেছেন। আল্লাহ কাউকে গরীব থাকতে বলেন নি, বরং তিনি উৎসাহ দিয়েছেন অর্থ সম্পদ অর্জন করে ব্যাপক হারে জাকাত, সদকা, হাদিয়া দিয়ে সমাজকে উন্নয়নে ভাসিয়ে দিতে। সোলায়মান (আঃ) আল্লাহর কাছে সম্পদ ও ক্ষমতা শালী হতে দোয়া করেছেন। আল্লাহ সেই দোয়া পছন্দ করেছেন এবং কবুল করেছেন। আইয়্যূব (আঃ) তদানীন্তন সমাজে সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যবসায়ী ও ধনী ব্যক্তি ছিলেন। ওসমান (রাঃ) সম্পদ কমানোর জন্য রাসুল (সাঃ) এর কাছে দোয়া চেয়েছিলেন, তাঁর সম্পদ তো কমেনি বরং আরো বেড়েছিল। আনাস (রাঃ) সকল সম্পদ বিতরণ করে, দুনিয়ার জীবনে শূন্য হাতে থাকতে চেয়েছিলেন। আল্লাহ তাঁকে আরো সম্পদ বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। এমনকি আল্লাহ কোরআন পাকের মধ্যেই নিজেই শিখিয়ে দিয়েছেন যে, আমার কাছে দুনিয়া ও আখেরাতের জন্য উত্তম জীবন চাও, আমি তোমাদের দুটোই দিব। মন্ত্রীর হাত থেকে কোন পুরষ্কার নিতে গেলেও, একটি নিয়মের মাধ্যমে তাকে ধন্যবাদ দিতে হয়, কৃতজ্ঞতা জানাতে হয়। ঠিক আল্লাহও যখন দিতে চায়, সেটা নেবারও নিয়ম আছে এবং এই নিয়ম রীতি গ্রহীতাকে জানতে হবে! সে জন্য চাই জ্ঞান, প্রজ্ঞা ও বুদ্ধিমত্তা। আর এসব অর্জন করতে লাগবে শিক্ষা। তাই শিক্ষা ব্যতীত কোন গত্যন্তর নাই। সেজন্য ইসলাম শিক্ষাকে ফরজ করেছেন, বিনা টাকায় শিক্ষা বিতরণ রাষ্ট্রের জন্য বাধ্যতামূলক করেছেন। শিক্ষা থাকলে টাকা শিক্ষিতের পিছনে ঘুরবে কিন্তু আফসোস! আজ মুসলমান শিক্ষা-বিহীন শরীর নিয়ে টাকার পিছনে দৌড়াচ্ছে!
Discussion about this post