১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ ভারত থেকে পাকিস্তান নামক একটি দেশ সৃষ্টি হবার মধ্য দিয়ে পূর্ব বাংলার শিক্ষাঙ্গনে একটি বিরাট শূন্যতার সৃষ্টি হয়। পাকিস্তান জন্মের শুরুতে নানা কারণে বিবাদ, সাংবিধানিক সংকট, ঐক্য-হীনতা, রাষ্ট্রের মূলনীতি ঠিক না থাকা আবার মুসলিম-লীগে ধনীদের প্রাবল্য, অজনপ্রিয় কর্মসূচী ইয়াংদের মধ্যে নানা কারণে সিদ্ধান্তহীনতার সৃষ্টি করে। আবদুল মালেক
অন্যদিকে তখন সারা দুনিয়ায় কমিউনিস্ট বিপ্লবের জয়-জয়কার। কিউবা ও ভিয়েতনাম বিপ্লব। পূর্ব ইউরোপের বিশাল অংশে সমাজতন্ত্রের উত্থান। সোভিয়েত ইউনিয়ন ও চীনের সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠার ধারণা, আমাদের দেশের তরুণ শিক্ষিতদের মধ্যে প্রবল আগ্রহের সৃষ্টি করে। ছাত্ররা তো বটেই, মাওলানা ভাসানী, মাওলানা তর্কবাগীশের মত রাজনৈতিক পণ্ডিত পর্যন্ত কমিউনিজমের বড়ি গিলে বসে ছিলেন। তারা বিশ্বাস করেছিলেন, চীনা সাম্যবাদের কাছে, আর ওমর (রাঃ) সাম্যবাদের প্রতিচ্ছবি দেখতে পাচ্ছিলেন!
ইসলামী রাজনীতির ধারণা তখনও দুর্বল ভিত্তের উপর দাঁড়িয়ে এবং মাঠে অনুপস্থিত! ১৯৪৭ সালে জামায়াতে ইসলামী ৬ বছরের একটি শিশু মাত্র। যদিও দোষ দেবার ক্ষেত্রে এমন ভাবে বুঝানো হয় যে, ওরাই যেন দাদা বয়সের এক প্রবীণ শক্তি ছিল। এই ফাঁকে ১৯৪৮ সালের ৬ ই মার্চ পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টি গঠিত হয় এবং এর কার্যক্রম বাংলাদেশ অংশেই বেশী সচল ছিল। যদিও ব্রিটিশ ভারতের বাংলা ভাষা-ভাষিদের মধ্যে ১৯২০ সাল থেকেই কমিউনিষ্টদের সক্রিয় কার্যক্রম শুরু হয়েছিল। বলে নেওয়া ভাল ১৯৫৬ সালে ছাত্র সংঘ প্রতিষ্ঠিত হয় কিন্তু খোঁড়া পায়ে চলতে থাকে। ১৯৬৩ সালে একেএম নজীর আহমেদ প্রাদেশিক সভাপতি হবার মধ্য দিয়ে ছাত্রদের মধ্যে ইসলামী রাজনীতির একটি সক্রিয় ধারা শুরু হয়। মুসলিম জনগোষ্ঠির ছাত্রদের মধ্যে, নতুন ধারণার ইসলামী রাজনীতির দাওয়াত দেওয়া, তখন অত সহজ ছিল না। যেখানে তদানীন্তন আলেম সমাজই, যখন ইসলামে রাজনীতিকে হারাম বলে ফতোয়া দিয়ে মাঠ গরম করছিলেন। ফলে ছাত্র সংঘ একদিকে আলেমদের কটুবান ও অসহযোগীতা সহ্য করা, অন্যদিকে ছাত্র ইউনিয়নের মত সাংগঠনিক শক্তির বাধায় তেমন গতি পায় নি। তারা তাদের মতই কাজের আঞ্জাম দিচ্ছিলেন। এখনও তো সেই চিত্রের তেমন পরিবর্তন হয়নি, সুতরাং তখনকার সময় অনুমেয়।
কমিউনিস্টেরা পূর্ব পাকিস্তানে মুসলিম-লীগ কে (যদিও মুসলীম লীগ অর্থ মুসলমানদের দল কিন্তু ওরা মুসলীম লীগের দুর্বলতা গুলোকে ইসলাম ধর্মের দুর্বলতা হিসেবে তুলে প্রচার চালাত, এখনও চালায়) হটিয়ে সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠার ধূয়া তুলে। এটিই সেই শুন্যতা! যেখানে কুফুরী শক্তির বিপক্ষে কোন বুদ্ধি-ভিত্তিক, আধুনিক ইসলামিক আদর্শ উপস্থিত ছিল না। শূন্য কখনও ফাঁকা থাকে না। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের চিন্তাশীল মেধাবী ছাত্ররা, নতুন দুনিয়া গড়ার প্রত্যয়ে দলে দলে কমিউনিস্ট দলগুলোর দিকে ঝুঁকে পড়তে থাকে।
যার কারণে ১৯৫০ – ১৯৭০ পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তানের বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতে সৃষ্টি হওয়া বেশীর ভাগ মেধাবী তরুণ, বামপন্থী ধ্যান ধারণায় প্রভাবিত হিসেবেই গড়ে উঠেছিল! প্রথম দিকের কমিউনিস্টের বইগুলো অনুবাদ করা হতো, পশ্চিম বঙ্গের হিন্দু কমরেড দ্বারা। এতে তারা দুই ধারি তরবারী চালাবার সুযোগ পায়। সে সব সাহিত্য পাঠকদের মন মানসে এমন ধারণা গেঁথে দেওয়া হয়েছিল যে, বামপন্থী হতে গেলেই, ইসলামকে ঘৃণা ও শত্রু জ্ঞান করতে হবে! এবং পশ্চিম বঙ্গিয় হিন্দু ঘরানার শিক্ষিতরাই প্রকৃত সুশীল, আপডেট ও গ্রহনীয় ব্যক্তি। যার কারণে সবাই আর মাওলানা ভাসানী থাকেনি, একেক জন পাঁড় ইসলাম, ওলামা ও ধার্মীক মুসলিম বিদ্বেষী হয়ে উঠে। তারা ইসলামী সংস্কৃতি ও কৃষ্টিগুলোকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য তো করতই অধিকন্তু তার বিপরীতে নতুন সংস্কৃতি আনয়ন করে, তার পৃষ্ঠপোষকতা দিতে থাকে।
আবার বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টিগুলো সরাসরি সোভিয়েত ইউনিয়ন (বর্তমান রাশিয়া) ও চীন থেকে দল চালানোর জন্যে মোটা-দাগে আর্থিক সহযোগিতা পেত। বহিঃশক্তির বিশাল আর্থিক প্রভাব বিরাট কাজ দেয়। তারা বাংলাদেশে যথেষ্ট জনমত সৃষ্টি করতে না পারলেও, ছাত্রদের মধ্যে বিরাট সংখ্যক সমর্থক বাড়াতে সক্ষম হয়! যার ফল তারা পরে পেয়েছিল আরো পরে। বাংলাদেশ নামক নতুন একটি দেশ গঠিত হলে, দলে দলে খালি জায়গাগুলোতে এসব বামপন্থী বলয়ের ছাত্র-পেশাজীবীরা সুযোগ নেয়। “আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর” বইতে ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহফুজ আনামের পিতা আবুল মনসুর আহমেদ লিখেন। তার ছেলে (মাহফুজ আনাম) ইংল্যান্ডের শ্রেষ্ঠতম ভার্সিটির উচ্চ শিক্ষার সুযোগের পাশাপাশি, শিক্ষকতার অফার ফিরিয়ে দিয়েছিলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি হবার বিনিময়ে!
তোফায়েল আহমেদ থেকে শুরু করে তদানীন্তন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যত ছাত্র তৈরি হয়েছিল, তারা পরবর্তীতে ভিন্ন ভিন্ন রাজনৈতিক দলে ভিড়ে গিয়ে সেই দলের নেতা-কর্মী হলেও ওরা সবাই ছিল কমিউনিস্ট থেকে ধীক্ষা নেওয়া অনুসারী। তখনকার আওয়ামীলীগের এমন কোন রাজনৈতিক দর্শন কিংবা মতাদর্শ ছিল না, যেগুলো ছাত্ররা বছর খানেক ধরে পড়ে, অতঃপর সেই দলের নেতা হবেন। একই দশা বিএনপির বেলাতেও ঘটে। দলের এমন দুর্বল ও অকার্যকর দিক থাকার ফলে বন্যার স্রোতের ন্যায় বামপন্থীরা এই দুই দল এবং জাতীয় পার্টতে ঢুকে বড় বড় পদ দখল করে নেয়। ফলে দল দুটো নিজের অস্তিত্ব হারিয়ে বর্তমান বামপন্থি দলে পরিণত হয়েছে।
সেই একই কারণে তোফায়েল আহমেদ আওয়ামীলীগের কর্মী থাকলেও, তাদের সাথে চিন্তার সখ্যতা ছিল বামপন্থীদের সাথে। ফলে ইসলাম পন্থিরাই ওদের মূল শত্রু বিবেচিত হয়। যার কারণে, কয়েক দলের নেতা কর্মী তথা তোফায়েল আহমেদ, রাশেদ খান মেনন, আসম আবদুর রব, মাহবুব উল্লাহ (ছাত্র ইউনিয়ন নেতা) সহ অন্যরা সংঘবদ্ধ হয়ে তদানীন্তন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র ছাত্র সংঘের ঢাবি নেতাকে হকিস্টিক দিয়ে পরিকল্পিতভাবে নির্মম কায়দায় হত্যা করে।
কেন তারা শহীদ আবদুল মালেকের উপর এত ক্ষিপ্ত হয়েছিল,
আপনারা যারা উপরে উল্লেখিত ঘটনাগুলো পড়েছেন, তারা বুঝতেই পেরেছেন ১৯৫০ থেকে প্রায় ১৯৭০ পর্যন্ত বাংলাদেশের শিক্ষাঙ্গনে একছত্র-ভাবে বামপন্থিদের প্রভাব ছিল। আবার তারা ইসলামকে ঘৃণা ও শত্রু মনে করে। উপরন্তু এই সময়ে বামপন্থিদের সাথে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিতে পারবে এমন কোন ইসলামী দলও ছিল না, তেমন সম্ভাব্য শক্তিশালী নেতাও ছিল না। ইসলামী রাজনীতি তখনও জনপ্রিয়তা পায়নি।
এমন পরিস্থিতিতে তাদের মধ্য থেকেই হঠাৎ উদয় হলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জৈব রসায়ন Biochemistry (তখনকার দিনে অতি মূল্যবান সাবজেক্ট) বিভাগের সবচেয়ে মেধাবী ছাত্র আবদুল মালেক। তিনি সময় পান খুব অল্প। তবুও তার অনর্গল ইংরেজিতে বলা বক্তৃতায় “ইসলামী শিক্ষা ব্যবস্থা” ব্যবস্থা নামে আরেকটি বিষয়কে তুলে ধরে প্রমাণ করেন যে, এটা ছাড়া অন্য যত শিক্ষাকেই প্রতিস্থাপিত করা হউক না কেন, একটি দেশপ্রেমিক, স্বনির্ভর, আর্ত-মর্যাদাশীল শিক্ষিত জাতি উপহার দেওয়া সম্ভব নয়।
বিষয়টি পুরানো হলেও, সচেতনতার জন্যে একটু পিছনের ঘটনাগুলো জানা সবারই দরকার।
আবদুল মালেক! ৫০ বছর ধরে বানানো ধর্মনিরপেক্ষতার মূল খিলান ধরে টান মেরেছিলেন
২০২৫ সালের ডাকসুর ভিপি ও জিএস নির্বাচিত হয় ছাত্রশিবির থেকে যথাক্রমে সাদিক কাইয়্যেম ও ফরহাদ।
১৯৬৮ সালে ডাকুসর ভিপি নির্বাচিত হয় ছাত্রলীগ নেতা তোফায়েল আহমেদ ও জিএস নির্বাচিত হয় ছাত্র ইউনিয়নের মেনন গ্রুপ নেতা নাজিম কামরান চৌধুরী।
তৎকালীন পাকিস্তান সরকার এয়ার মার্শাল নূর খানের নেতৃত্বে একটি শিক্ষা কমিশন রিপোর্ট প্রকাশ করে, যেখানে ইসলামী আদর্শের প্রাধান্য পরিলক্ষিত হয়। বামপন্থী ও ধর্ম নিরপেক্ষতা-বাদীরা এই শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে ক্ষেপে যায়, তারা তা বাতিলের দাবি জানায় এবং জনমত গঠনের চেষ্টা চালাতে থাকে।
সেই প্রতিবাদের অংশ হিসেবে পাকিস্তানের শিক্ষা ব্যবস্থা আসলেই কেমন হওয়া উচিত। সরকারকে পরামর্শ ও ধমক দেওয়ার প্রত্যয়ে বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই একটি খোলামেলা বিতর্ক সভার আয়েজনের চিন্তা করা হয়।
১৯৬৯ সালের ১২ ই আগষ্ট টিএসসি তে ‘ডাকসু’ কর্তৃক এমনই একটি বিতর্ক প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়। বিষয়বস্তু হল, ‘শিক্ষার আদর্শিক ভিত্তি’ বা ‘জাতীয় শিক্ষানীতি’ কি হওয়া চাই, সে সম্পর্কে খোলামেলা বিতর্ক। এই বৈঠকের সভাপতিত্ব করেছেন, ডাকসুর তৎকালীন ভিপি “তোফায়েল আহমেদ”। আবদুল মালেক বক্তা হিসেবে নিজের নাম তালিকায় অন্তভূক্তি করার জন্যে বারবার চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন কিন্তু কমিটি সুযোগ দিতে রাজি হচ্ছিলেন না! তারা সময় ক্ষেপণ করতে থাকেন। আবদুল মালেক যাকে প্রস্তুতি নিতে না পারেন সে কারণে একেবারে শেষ মুহূর্তে জানানো হয় যে, তাকে শেষ বক্তা হিসেবে বক্তব্যের সুযোগ দেওয়া হবে কিন্তু সময় মাত্র পাঁচ মিনিট। পরে এই পাঁচ মিনিটই মেধাবী আবদুল মালেকের জন্যে কাল হয়ে দাঁড়ায়। যাক
সেই সভায় পাকিস্তানের শিক্ষা ব্যবস্থা কেমন হওয়া চাই, সে সম্পর্কে যারা নিজদের মতামত তুলে ধরেন তারা হলেন,
- তোফায়েল আহমেদ (ডাকসু ভিপি, তৎকালীন ছাত্রলীগ নেতা)
- রাশেদ খান মেনন (ছাত্র নেতা, বামপন্থী ছাত্র সংগঠনের)
- শামসুদ্দোহা (ছাত্র ইউনিয়ন নেতা)
- হাসানুল হক ইনু (তৎকালীন ছাত্রলীগ নেতা)
- আ স ম আব্দুর রব (তৎকালীন ছাত্রলীগ নেতা)
- মাহবুবউল্লাহ (তৎকালীন ছাত্র ইউনিয়ন নেতা)
দর্শক হিসেবে থাকেন উপস্থিত ছাত্র জনতা। উপরের সকল নেতারাই লম্বা বক্তব্য ও ফিরিস্তি তুলে ধরে পাকিস্তানের শিক্ষা ব্যবস্থা ধর্মনিরপেক্ষ বা সমাজতান্ত্রিক আদর্শের আলোকে করতে হবে বলে যুক্তি তর্ক তুলে ধরেন।
আবদুল মালেক তার সংক্ষিপ্ত সময়ে প্রতিপক্ষ দলের প্রতি এক ঝাঁক পয়েন্ট ছুঁড়ে দেন। তাছাড়া ভূমিকায় ইসলামী শিক্ষার পক্ষে এমন জোরালো বক্তব্য তুলে ধরেন। যার ফলে পুরো অডিয়েন্স নড়ে চড়ে বসে। সরকার যেহেতু কিছুটা ইসলামী ঘেঁষা আগে থেকেই ছিল; আবদুল মালেকের এই যুক্তিপূর্ণ তথ্যভিত্তিক বক্তব্যের কারণে, জনমত আবদুল মালেকের পক্ষে চলে যাবার সম্ভাবনা দেখতে পায়। ফলে তারা কোন সিদ্ধান্তে না এসে, অনুষ্ঠানটি স্থগিত করে দেয়। অর্থাৎ অনুষ্ঠানটি যে কারণে করা হয়েছিল, তার পুরো লক্ষ্যটাই লন্ডভণ্ড হয়ে যায়, উপরন্তু কিছু প্রশ্ন তাদের ঘাড়ের উপরে রেখে যায়, যেগুলোর উত্তর পরবর্তীতে তাদেরকে দিতেই হবে। আবদুল মালেকের বক্তব্য ছিল অত্যন্ত যুক্তিপূর্ণ, তথ্য-নির্ভর এবং বাগ্মীতায় ভরা। এই সংক্ষিপ্ত বক্তব্যেই তিনি উপস্থিত শ্রোতাদের চিন্তার রাজ্যে বিপ্লবী ঝড় সৃষ্টি করেন এবং সভার মোটিভ পরিবর্তন করে ইসলামী শিক্ষার পক্ষে জনমত তৈরি করতে সক্ষম হন।
বামপন্থিদের আয়োজনে, বামপন্থি বক্তাদের সারাদিনের ঝড়ো গতির প্রচেষ্টা এক আবদুল মালেকের পাঁচ মিনিটের তাণ্ডবে উড়ে যায়। তারা ক্ষিপ্ত হয় এবং আশংকা করতে থাকে এমন ব্যক্তি যদি একজনও জীবিত থাকে, তাহলে ১৯২০ – ১৯৭০ পর্যন্ত ৫০ বছর ধরে ধীরে ধীরে বানানো কমিউনিজমের দুর্গ খান খান করে ভেঙ্গে পড়বে। তাছাড়া পাকিস্তান সরকারে নূর খান কমিশন যে ইতিমধ্যে ইসলামী ঘেঁষা শিক্ষা ব্যবস্থার পক্ষে দাঁড়িয়েছেন, আবদুল মালেকের এক বক্তব্যেই সরকারের পালে হাওয়া লাগবে। সুতরাং অবস্থা বেগতিক হবে।
আবদুল মালেক বুঝিয়েছেন ইসলামী শিক্ষার মাধ্যমেই জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণীত হওয়া উচিত। যাতে তাওহীদ, রেসালাত ও আখেরাতকে মৌলিক বিষয় হিসেবে প্রাধান্য দিয়েই জাগতিকতাকে সাজাতে হবে। তাঁর বক্তব্যের মূল কথাগুলো ছিল:
- মতাদর্শগত ঐক্য: তিনি বলেছিলেন, “মতাদর্শগত শূন্যতা নয়, পাকিস্তানের লক্ষ্য হওয়া উচিত মতাদর্শগত ঐক্য। এর জন্য প্রয়োজন এমন একটি স্বতন্ত্র ও সমন্বিত শিক্ষা ব্যবস্থা যা ইসলামের অনুশাসনের উপর ভিত্তি করে একটি অভিন্ন সাংস্কৃতিক মূল্যবোধের সমাজে গড়ে তুলতে সক্ষম হবে।”
- ধর্মীয় ও নৈতিক দিক: তাঁর মতে, শিক্ষার সঙ্গে ধর্মীয় ও নৈতিক দিক সংযুক্ত না হলে শিক্ষাব্যবস্থা জাতির সামগ্রিক উন্নয়নে সমন্বিত ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে না। এতে সৎ শাসক এবং সৎ প্রশাসক সৃষ্টি হবার সুযোগ থাকবে না।
- শিক্ষার উদ্দেশ্য: শিক্ষার উদ্দেশ্য কেবল ডিগ্রি বা ডিপ্লোমা অর্জন নয়, বরং সম্মানজনক জীবন যাপনের জন্য প্রয়োজনীয় জ্ঞান অর্জন। ধর্মবোধ তথা স্রষ্টার প্রতি আনুগত্যই মানুষকে দায়িত্ববোধ-সম্পন্ন, কর্তব্যনিষ্ঠ, ন্যায়পরায়ণ, সৎকর্ম-শীল ও বিনয়ী হতে শেখায়। এই গুণাবলী না থাকলে কর্মকর্তা যতই যোগ্য হউক, দেশ ও জাতি কোনদিন ন্যায় নিষ্ঠ হবে না।
তোফায়েল বাহিনী সিদ্ধান্ত নেয়। আবদুল মালেক কে দুনিয়ার বুক থেকে চিরতরে সরিয়ে দিতে হবে। তার প্রতিপক্ষ সকল বক্তারা এক জোট হয়ে সিদ্ধান্তে উপনীত হয়। জ্ঞান-বুদ্ধিতে না পারলেও অন্তত গায়ের শক্তিতে তো তারা বলীয়ান! সুতরাং তাকে সরাতে হবে। আবদুল মালেক নিজেও আক্রমণের কোন আলামত দেখতে পায় নাই। সন্ধ্যার আলো আধারিতে চলার পথে আবদুল মালেক কে একা পেয়ে, তারই প্রতিপক্ষ বক্তাদের কয়েকজনের হাতে তাকে নিষ্ঠুরভাবে নিহত হতে হয়। ওরা নিজেদের অস্তত্বের ভয়ে এতটুক সঙ্কিত হয়, কোন পেশাদারী হত্যাকারী কিংবা ভাড়াটে আনার কথাও চিন্তা করেনি! এ কাজে কোন দলীয় কর্মীকেও রাখা হয়নি! একেবারে সকল প্রতিযোগী, প্রতিপক্ষ নেতারাই একত্রিত হয়ে, সরাসরি হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে।
অথচ আবুদল মালেক কোন দলের পক্ষে হয়ে লড়েন নাই। তিনি স্রেফ আল্লাহর কিতাব ও রাসুল (সাঃ) আদর্শকে সমুন্নত রাখার জন্যে দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরেছিলেন। মানুষের কাছে শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়েই যেখানে ধারণা ছিল না। সেখানে আবদুল মালেকের ইসলামী শিক্ষা ব্যবস্থা কি, কেন প্রয়োজন, সেটা নিয়েই অর্ধ শতাব্দীর বেশী সময় মানুষ থেকেছে অন্ধকারে।
পরবর্তীতে উনসত্তরের গন-আন্দোলনে ওসব ছাত্র নেতাদের বড় ভূমিকা ছিল। দেশ টাল মাটাল হয়, পরিবর্তন হয় মানচিত্রের। তাই আর হত্যাকাণ্ডের বিচার হয়নি এবং দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা পরিচালিত হয় ধর্মনিরপেক্ষতার আড়ালে হিন্দুয়ানী ভাবধারায় আত্মাহুতি দেবার মাধ্যমে। স্কুল-কলেজ থেকেই নৈতিকতা উঠে যায়। ব্যক্তিকেন্দ্রিক নৈতিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জন্ম হতে থাকে। গ্রামে-গঞ্জে বাড়তে থাকে ইসলামী শিক্ষা সমেত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা। এটা দিয়ে তো একটি জাতি নিয়ন্ত্রণ করা যায় না।
বাংলাদেশের সরকার ব্যবস্থা, দুর্নীতি সহায়ক শিক্ষা ব্যবস্থা, প্রশাসনে সৎ মানুষের অপ্রতুলতা আবার অসৎ মানুষের কদর, ঝুকিপূর্ন রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা ব্যবস্থা, অবিশ্বস্ত রাজনৈতিক নেতা, ডাকাত রূপে বিশৃঙ্ক্ষল রাজনৈতিক কর্মী-বাহিনী, অরাজক সমাজ ব্যবস্থা, ক্ষণভঙ্গুর নাগরিক সেবা, দস্যুদের হাতে ব্যাংক বীমা, প্রতারকের হাতে বাজার ব্যবস্থা, ঠগদের হাতে চিকিৎসা সেবা, চোরদের হাতে রাষ্ট্রীয় সেবার চাবিকাঠি সব তো ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষা ব্যবস্থার কল্যাণেই হয়েছে। আবদুল মালেক সেদিন হয়ত বিদায় হয়েছে কিন্তু তার বর্ণিত ইসলামী শিক্ষা ব্যবস্থা চালু হলে, এই রাষ্ট্র, এই দেশের চিত্র নিশ্চয়ই ভিন্ন হতো। সেই শিক্ষা ব্যবস্থার অভাব হেতু সমগ্র দেশে অগণিত ইসলামি স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা গড়ে উঠেছে।
Discussion about this post