চট্টগ্রামের মাইজ ভাণ্ডারের ওরসের সময় দেশের অধিকাংশ কাওয়ালদের মেলা বসত। ভারত পাকিস্তান থেকেও কাওয়ালদের ভাড়া করে আনা হত। বাংলা মুল্লুকের উর্দু কাওয়াল
বড় সড় রেস্টুরেন্টগুলোতে ঢুকার মুখে একপাশে কাওয়ালেরা জায়গা দখল করত। মাঘ মাসের ভয়ানক ঠাণ্ডাকে পরাজিত করে, জড়সড় হয়ে বসে ক্রেতারা সারারাত ভাড়া করা কাওয়ালদের গান শুনত আর দোকানের চায়ের গোষ্ঠী উদ্ধার করত।
সবাই যে উর্দু-হিন্দি মিশ্রিত এসব কাওয়ালী বুঝত তা নয়। সুর, তাল, লয় আর হালকায়ের জিকিরের অনবদ্য মিশ্রণে মানুষ নিজের মধ্যে হারিয়ে যেত। ভারতীয় উপমহাদেশের মানুষ এমনিতেই একটু সুর পাগল। সুরেলা কণ্ঠের মানুষকে গুরুত্ব দিত।
এরই সূত্র ধরে আমাদের এলাকার কিছু মানুষ পাকিস্তান গিয়েছিল কাওয়ালী শিখতে! তাদেরই একজন বাংলা কাওয়ালীতে মশহুর হয়েছিল, যার কথা পরেই আলোচিত হবে।
মানুষ ছিল ধর্মপ্রাণ এবং এসব কাওয়ালী গানকে অনেকেই ধর্মীয় কর্ম মনে করেই পালন করত। ফলে গ্রামে গঞ্জে নিজের পকেটের টাকা খরচ করে, কাওয়াল ভাড়া করে, মাইক লাগিয়ে, সারা গ্রামের মানুষের ঘুম তাড়িয়ে, কান ঝালাপালা করে, ফজরের আজানের আগেই, কাওয়ালী অনুষ্ঠানের ইস্তফা হত।
এগুলো করার মত ধনীদের অভাব হতোনা। আজো আমরা দেশের বহু জায়গায় শিক্ষিত মৌলভীদের মাধ্যমে এমন কর্মকাণ্ড দেখে থাকি।
আমাদের পারিবারিক জীবন ছিল পীর, মুরীদ, দরগাহ, ওরস, জেয়াফত, মিলাদ, কেয়াম কেন্দ্রিক। এলাকায় এগুলো আঞ্জাম দেবার মত যথেষ্ট পরিমাণ আলেম থাকলেও কোরআন-হাদিস ব্যাখ্যা দানকারী আলেম ছিল না বললেই চলে।
এলাকার আলেমদের জীবন দোয়া মাহফিল, কোরআন খতম, ফাতেহা, ওরস, মিলাদ, কেয়ামের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। তাদের কখনও পুথি, জারি, কাওয়ালী গানের বিপক্ষে দাঁড়াতে দেখিনি।
অর্থ না বুঝলেও আমিও কাওয়ালী পছন্দ করতাম। মাইকে শুনেই মুখস্থ করতাম এবং নিজে নিজেই গুন গুন করে গাইতাম। আমার জীবনে গাওয়া সেরা কাওয়ালী হল,
“দমা দম মাস্ত-কালান্দর, শাহী শাহ বাজ কালান্দর…”
সম্ভবত উপমহাদেশে এটিই সবচেয়ে বেশী গাওয়া কাওয়ালী। এই কাওয়ালীটি বুঝে না বুঝে, যেভাবেই পড়া হউক, কোন মুসলমানের ঈমান থাকবেনা! সেটা না হয় আরেকদিন বলা হবে, আজকে বলছিলাম আমাদের বাঙ্গালী কাওয়ালের কথা।
তিনি পাকিস্তান ও দিল্লী থেকে কয়েক মাসের প্রশিক্ষণ নিয়ে এলাকায় কাওয়ালীদের নেতৃত্বের আসন দখল করলেন। তবলা বাদক এই কাওয়াল অচিরেই মশহুর হয়ে গেলেন।
অন্যূন দু’সেট তবলা হাজির না থাকলে তিনি গান ধরতেন না। তবলা বাজাতে গিয়ে বহুবার তবলাই ফেটে ফেলত। আসলে তিনি তো তবলা বাজাতেন না, রীতিমত তবলায় কিলাইতেন! নিস্তব্ধ রজনীর পরিবেশ খান খান করে, সপ্তাহে অন্তত একবার হলেও মাইকে, তার কাওয়ালী শোনার সুযোগ হত।
আমি ছোট মানুষ বুঝি ওসব বুঝতাম না। তবে এক মুরুব্বীকে জিজ্ঞাসিলে তিনি বললেন, তার কাওয়ালী না উর্দু, না হিন্দি! ওটাতো রীতিমত বাংলাতেই গায়।
বাংলা বাক্যের শেষে ইঙ্গে, হাঙ্গে, টাঙ্গে লাগিয়ে উর্দু বলে চালিয়ে দেওয়া হয়। সেই ঐতিহাসিক কাওয়ালীর কয়েকটি চরণ আজো মনে আছে।
বিবিজান খাবড়া খোল,
যদি মাল ভাল হঙ্গে,
তেরি মেরী পেয়ার করে,
সাম্পানে তার বাম্বু টাংগে…
আজো এই গানের অর্থ বুঝি নি কিন্তু এই গানের সুরে মানুষ তখন মাতোয়ারা হত। এগুলোর সাথে না আছে ধর্মের সম্পর্ক, না আছে কর্মের।
তার অর্থ এই নয় যে, সকল কাওয়ালীর ভাবার্থ খারাপ। অনেক সুন্দর মর্মার্থ ও সুরের কাওয়ালী আছে বলেই আজ-কাল শিক্ষিত, বুজুর্গ মানুষেরাও কখনও সেদিকে ঝুঁকে পড়েন। এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের অঙ্গনেও আজ কাওয়ালী ঢুঁ-মারছে।
Discussion about this post