এছাক আলী ভাগ্যবান ব্যক্তিদের একজন। কেউ বলেন গোবরে পদ্মফুল, কেউ বলে আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ। বাস্তববাদীরা বলেন, পরিশ্রম সৌভাগ্যের প্রসূতি। এছাক আলী দুঃখ-কষ্টকে কখনও ভয় পায়নি। শ্রমের বিনিময়ে তিনি অভাবকে হার মানিয়েছেন, ছিনিয়ে এনেছেন সৌভাগ্যের চাবিকাঠি। তাই আজ তিনি মহা ভাগ্যবান ব্যক্তিদের একজন। তিনি এলাকাতে আসলে এলাকার মেম্বার, চেয়ারম্যান সহ সবাই তার খাতির যত্মে নিমগ্ন হয়ে পড়েন। যারা এছাক আলীর অতীত জীবন দেখেছেন, তারা কপালে হাত মারেন, কিভাবে দেখতে দেখতে একটি মানুষ এত অর্থ সম্পদের মালিক হয়ে গেল!
মন্তাজ আলীর জীবদ্দশায় দুই সন্তানকে নিয়ে তিনি মোটামুটি ভালই ছিলেন। বড় ছেলে হাশমত আলীকে দোকানে বসিয়ে, মালামাল আনার জন্য পিতা মন্তাজ আলী গঞ্জে যেতেন, শহরে যেতেন। পিতার সাথে থেকে ছেলে মন্তাজ আলী মুদি দোকান ঠিক মত চালাচ্ছিল; ব্যবসাও প্রায় রপ্ত করেছিল। এই দোকানের উপর নির্ভর করে তাদের পরিবারও ভাল ভাবেই চলে যাচ্ছিল। এই অবস্থায় হঠাৎ, ছোট ছেলে এছাক আলীর দুই বছর বয়সে, পিতা মন্তাজ আলী তথা মন্তাজ সওদাগর সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান। পরিবারের দায়িত্ব পড়ে বড় ছেলে হাশমত আলীর উপর। মা অসুস্থ বলে, সংসারের হাল ধরার জন্য হাশমত আলীকে বিয়ে করিয়ে দেন। কপালের দুর্গতি, পিতার মৃত্যুর দুই বছর পর অসুস্থ মা জননী দুনিয়া থেকে বিদায় নেন। চার বছর বয়সী এছাক আলী দেখা শোনার দায়িত্ব পরে তারই ভাবী হাশমত আলীর স্ত্রীর উপর। সম্পর্কে ভাবী হলেও তিনি নিজের সন্তানের মত আদর যত্নের অবহেলা করেননি। পিতা-মাতার মৃত্যুতে হাশমত আলী বেশী মুছিবতে পড়েন; তিনি পিতার রেখে যাওয়া মুদির দোকানের ব্যবসা ঠিক মত চালাতে পারলেও, পিতা বেঁচে থাকতে দোকান পাহারা দেবার যে সুযোগ তিনি পিতাকে দিতেন। সে ধরনের বিশ্বস্ত সুযোগ তার জন্য রইল না। কেননা ছোট ভাই এছাক আলী এত ছোট যে, তাকে আর সে কাজে লাগানো যায়নি।
হাশমত আলী আশায় থাকতেন ছোট ভাইটি বড় হলে, তাকে ব্যবসায়ে সাহায্য করতে পারবেন। এতে করে তার সুদিন ফিরে আসবে। ছোট ভাইকে ব্যবসায়ের উপযোগী করতে, টাকা পয়সার হিসেবে নিকেশ রাখতে বিদ্যার প্রয়োজন; সে জন্য তাকে এলাকার প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি করিয়ে দেন। তবে এছাক আলীর বিদ্যালয়ে যেতে ভীষণ ভয়।
গ্রামের ছেলেদের সাথে পুকুরে ঝাঁপ দেওয়া, মাছ ধরা, নদীতে সাঁতার কাটা, পানিতে শালুক খোঁজা ইত্যাদি তার খুব পছন্দ। খাওয়ার সময় ঘরে আসলে ভাবী হালকা ধমক, বকা-ঝকা করে খাবার খাইয়ে দিলে; আবারও দুষ্ট বন্ধুদের সাথে মিশে উদাও হয়ে যায়, এটা তার বদ-অভ্যাসে পরিণত হয়।
ভাবীর ভয়, শারীরিক শাস্তি দিলে, এতিমের উপর নির্যাতন ভাবতে পারে গ্রামের মানুষ। ফলে, দোষ-ত্রুটি যতটুকু সম্ভব উপেক্ষা করতেন। সর্বক্ষণ বুঝাতেন বড় হলে হয়ত ঠিক হয়ে যাবে। কোন ফল হয়নি, অগত্যা তাকে দোকানের কাজে লাগানো হল। কিশোর এছাক আলীর অত দায়িত্ববোধ জন্মেনি, ফলে সে কাজেও যথারীতি অবহেলা দেখাল।
এছাক আলী বড় ভাইয়ের সাথে থেকে একদা শারীরিক আকৃতিতে বড় হল বটে কিন্তু বড় ভাই হাশমত আলীর কোন উপকারে আসল না। সে দোকানের কাজের চাইতে, গ্যারেজের কাজের প্রতি উৎসাহী। নিজের সিদ্ধান্তে একদিন ভাইয়ের মতের বাইরে গিয়ে, মোক্তার হোসেনের গাড়ীর গ্যারেজে ঢুকে গেল। হাশমত আলী যে ভাইকে বাল্য কালে ধরে রাখতে পারেননি, তাকে কিশোর কালে ধরে রাখার প্রচেষ্টা বাতুলতা মাত্র মনে করেন। দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে; নিজের সন্তান বড় হলে তাকেই দোকানে বসাবেন বলে নতুন আশায় বুক বাঁধলেন। এদিকে এছাক আলী বড় ভাইয়ের ধমক সহ্য করে দোকানে বসতে না পারলেও মোক্তার সওদাগরের খ্যাতিপ্রাপ্ত গালাগালি ঠিকই হজম করে, গ্যারেজে কাজ করতে লাগল!
এলাকার ছেলেরা দলে দলে বিদেশে যাচ্ছে, আবার দলে দলে ছুটিতে আসছে। এই নবাগত বিদেশীরা একে অপরের সাথে প্রতিযোগিতা দিয়ে, এলাকার জমির দাম, বাজারে মাছের দাম, দোকানে কাপড়ের দাম বাড়িয়ে দিতে থাকল। এলাকাতে বিদেশী টাকায় হঠাৎ পয়সাওয়ালা ধনীদের প্রাদুর্ভাব বাড়ল। নতুন পয়সাওয়ালা ব্যক্তিদের দৃষ্টিকটু উৎপাতে এলাকার সকল বেকার যুবকের মাথা ঘুরিয়ে উঠল। চারিদিকে বিদেশ যাবার রব উঠল! এবার এছাক আলীও বিদেশ যাবে। বড় ভাই হাশমত আলীর টাকার জন্য তাগাদা দিল। বাপের একটি মাত্র ভিটে ছাড়া তাদের আর কিছুই ছিলনা। হাশমত আলী ছোট ভাইকে অনেক বুঝাল। আমার সাথে ব্যবসা কর তাহলে বিদেশের চাইতে বহু বেশী টাকা কামাতে পারবে। তারপরও বাপের ভিটে বিক্রি করো না, তোমার ভিটের অংশ বিক্রি করলে একদিন আমাকেও উচ্ছেদ হয়ে যেতে হবে।
এছাক আলী স্থানীয় ক্ষমতাশালী ব্যক্তি, মামুন চৌধুরীর কাছে তার অংশ বিক্রি করে দেবার পরও বিদেশে যাওয়ার মত টাকার ব্যবস্থা হলনা। উপায়ন্তর না পেয়ে কন্যাদায় গ্রস্ত ব্যক্তি সফদার মিয়ার তৃতীয় কন্যা জ্যোৎস্না বেগমকে বিয়ে করে বাকী টাকার ব্যবস্থা করে বিদেশে পাড়ি দিলেন। জ্যোৎস্না বেগম বাবার কাছে থাকবে বলে ঠিক হয়। যাবার কালে এছাক আলী বড় ভাই, ভাবী কারো সাথেই দেখা করল না। কেননা দীর্ঘ ১৪ বছর তারা তাকে শুধু বকা–ঝাকই করেছেন, মানুষ করেনি। বিদেশ গিয়ে এছাক ধনী হোক, সেটাও তারা চায়না, তাই বিদেশ যেতে অর্থকড়ি দিয়ে সাহায্য করেনি। বড়ভাই চোখের পানি ফেলে আফসোস করল, ছোট ভাই শুধু বকাঝকার কথাই মনে রাখল; এতিম কালে কিভাবে বড় হয়েছে সেটা মনে রাখেনি!
পরিশ্রমী এছাক আলী, মধ্য-পাচ্যে গিয়ে ভালই করলেন। ইলেকট্রিক্যাল, পাইপ ফিটিং সহ যাবতীয় কাজে সে ভাল দক্ষতা দেখাতে পারল। তার কোম্পানির মালিকের কয়েকটি ভবন ও একটি বড় কন্ট্রাকটিং ফার্ম আছে। এ জাতীয় কাজে মোটামুটি সবকাজে পারদর্শী মানুষের গুরুত্ব বেশী। এখানেই এছাক আলীর গুরুত্ব বেড়ে যায়, তিনি হয়ে উঠলেন ‘একের ভিতর দশ’। কোম্পানি মালিকের ভবনে ম্যানটেনেন্স কাজ, ভিলাতে পানির সমস্যা, বাজারে ইলেকট্রিক্যাল সমস্যা সব কাজে এছাক আলীর দরকার। তার উপর যোগ হয়েছে এছাক আলীর বিশ্বস্ততা।
মালিক তাকে ড্রাইভিং শিখিয়ে গাড়ী কিনে দিলেন, এছাক মিঞা মালিকের হয়ে সব কাজ দেখাশোনা করতে থাকলেন। কোন সমস্যা হলে ঘটনাস্থলে সমাধান করে আসা, বিশ্বস্ততার সহিত সকল কাজ আঞ্জাম দেওয়ায়, মালিক তার উপর এক প্রকার নির্ভর হয়ে গেলেন। বিয়ের পরে এছাক আলী বহু কষ্টে তিন বার দেশে যাওয়ার ছুটি পেয়েছিলেন। এছাক আলীর এই খন্ডকালীন ছুটিতে থাকার কারণে মধ্যপ্রাচ্যের স্থানীয় মালিকের যথেষ্ট ভোগান্তি হয়। এবারে মালিক বলে দিলেন আর কোনদিন বাড়ী যেতে পারবেনা। প্রয়োজনে সে যাতে তার পরিবার পরিজন বিদেশেই নিয়ে আসে।
এছাক আলীর স্ত্রী সন্তান নিয়ে বাপের কাছেই থাকত। এছাক বাড়ীতে গেলে বড় ভাই হাশমত সাথে দেখাশোনা হতো। ভাই হিসেবে বাড়ীতে গিয়েছে, উপহারও দিয়েছে, তবে এছাক আলী অতীত জীবনের ভাইয়ের বকা–ঝকার কথা বলে খোঁচা মারতে সুযোগ হারাতেন না। পরবর্তী দীর্ঘ ১০ বছর এছাক আলী আর দেশে যেতে পারেননি। ফলে বাধ্য হয়েই সে তার পরিবার বিদেশে নিয়ে আসে।
আরবি মালিক তার ভবন থেকে এছাক আলীর জন্য একটি ফ্লাট বরাদ্দ করে দেন। বিদেশে একজন ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার দেরও এই ধরনের ফ্লাটে থাকার ভাগ্যে জুঠে না। আরবি মালিকের কথা ছিল, ‘দুধ দেওয়া গরু লাথি মারলেও ভাল’। এছাক আলী নিজেও লেখা পড়া করতে পারেনি, বিদেশের জীবনে তার ছেলেদেরও লিখা পড়া করিয়ে মানুষ করতে পারেনি। পরিবার বিদেশে আনার পর খরচ বেড়ে গেল। আরবি মালিকের কাছে নতুন সমস্যার কথা বলাতে, তিনি তার ভবনের নীচ তলায় একটি দোকান বিনা ভাড়ায় তাকে দিয়ে দিলেন। নতুন দোকানে তার বড় ছেলেকে এনে জমজমাট ব্যবসা বানিয়ে ফেললেন। দোকানটি তার স্ত্রীর নামে লাইসেন্স করা এবং অবসর সময়ে এছাক আলী ব্যবসার পিছনে যথেষ্ট সময় ব্যয় করতে লাগলেন।
এছাক আলীর দিন এখন অন্য ধরনের। তার একমাত্র মেয়ের বিয়ে হল, মেয়ের জামাই ও দুই পুত্রকে আলাদা লাইসেন্স করে নতুন দোকান চালু করে দিলেন। নতুন দোকান নিতে তার কোন বেগ পেতে হয়নি। আরবি মালিকের দোকান ভাড়া দেওয়া ও নানাবিধ নজরদারী এছাক আলীর হাতেই। এছাকের বংশের সবাই এখন নগদ টাকা কামানোতে ব্যস্ত। স্ত্রীর নামের দোকানটিতে অনেক আয়, তাছাড়া এছাক আলীরর চাকুরী এখনও বহাল আছে। চাকুরী এবং ব্যবসায়ের পিছনে সার্বক্ষণিক সময় দিতে পারে। তার স্ত্রীও মানুষ দিয়ে অনেক কাজ করিয়ে নিতে দক্ষ হয়েছে। এছাক আলীদের আর পিছনে তাকাবার সময় নাই।
এবার এছাক আলী দেশে গিয়েছিল, শহরের প্রাণকেন্দ্র থেকে ১০ কাটার বিরাট জায়গা নগদ অর্থে কিনে নিয়েছেন। এছাক আলীর নাম এখন মানুষের মুখে মুখে। ১০ গ্রামের মানুষকে দাওয়াত দিয়েছেন। আগে এছাক আলী একজন সাধারণ গ্যারেজের শ্রমিক হলেও এলাকায় এখন তার সম্মান হাজার মানুষের চেয়েও বেশী। এলাকার মেম্বার চেয়ারম্যান নিজেরাই তার সাথে দেখা করতে এসেছে। স্থানীয় এম,পি তাকে শহরের নামকরা হোটেলে দাওয়াত দিয়েছে। শোনা গেছে এম,পি’কে তিনি নাকি একখানি সোনার তরী উপহার দেবেন। এছাক আলী প্রত্যেক মসজিদ-মাদ্রাসায় টাকা দিয়েছেন। মাইকে সেটা প্রচারিত হয়েছে। এছাক আলী জানালেন লেখা পড়া করে কি লাভ? সে লেখাপড়া না করেও কোটি টাকার মালিক হয়েছে। আর লেখাপড়া জানা মানুষগুলো, উল্টো তাকেই স্যার স্যার বলে চাকুরীর জন্য কান জ্বালিয়ে ফেলে। স্ত্রী’র অনুরোধে বড়ভাই হাশমত আলী অনেক মানুষের ভিড় ঠেলে ছোট ভাইকে দেখতে এসেছিল। ভেবেছিল বড় ভাইকে সামনে দেখলে, হয়ত রাগ-অভিমান ভুলে যাবে। দেশে এছাক আলীর অনেক ব্যস্ততা ছিল, এত লোকজন দ্বারা পরিবেষ্টিত ছিল যে, হাশমত আলী নামে তার একজন বড় ভাই ছিল সেটাই মনে করতে পারেনি।
বিদেশে এছাক আলীর এখন জমজমাট ব্যবসা, অনেক মানুষ তার দোকানে চাকুরী করে। তারা এখন দেশী করলা, দেশী বরবটি, আলু, মূলা খাওয়া ছেড়ে দিয়েছে; সব সময় ফাস্ট-ফুড খায়। এছাক আলী এখন হোটেলে যাওয়া শিখেছে। হোটেলেই ধনী মানুষেরা যায়, তাদের সাথে দেখা হবার সেটাই একমাত্র জায়গা। মধ্যপ্রাচ্যের এই দেশে যেখানে সেখানে ‘হার্ড-ড্রিংক’ পান করতে না পারলেও হোটেলে নিজের ইচ্ছেমত পান করা যায়। এছাক নিজেও পান করতে শিখেছে অন্যদেরও পান করায়। সামাজিক উঁচু স্ট্যাটাস পেতে হলে নাকি এটা পান করতে হয়!
টাকার গরমে এছাক আলী এখন পয়সা ওয়ালাদের সাথে চলতে শিখেছে। সেদিন এছাক হোটেলের ফ্লোরে মাথা ঘুরে পরে গেল। সেন্ট্রাল হাসপাতাল থেকে খবর আসে, তিনি স্ট্রোক করেছেন। ভাগ্য ভাল বলতেই হবে, এই স্ট্রোকে মরার কথা কিন্তু তিনি বেঁচে গেছেন! এছাক আলীর স্ত্রী অনেক টাকা খরচ করার পর জানতে পারলেন, যত টাকাই ব্যয় করুক না কেন, কোন ফায়দা নাই। কারণ তার শরীর ইতিমধ্যে প্যারালাইসিসে আক্রান্ত হয়েছে। তিনি বেঁচে থাকবেন বটে, তবে বাকী জীবন অন্যের বোঝা হয়ে থাকতে হবে।
প্রচুর টাকা খরচ হলো, একাউন্ট খালি হলো, ছেলেরাও পিতাকে দেখতে বাসায় আসা-যাওয়া কমিয়ে দিয়েছে। তাদের মা শহরের জায়গা বিক্রি করার ইচ্ছা প্রকাশ করতেই, ছেলেরা ক্ষেপে গেল। কিছুই বিক্রি করা যাবেনা, বিক্রি করলে তারা কোথায় উঠবে? ছেলে-মেয়েরা তাদের ব্যবসা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। স্ত্রী মানুষ দিয়ে, তার দোকান চালিয়ে যেতে লাগল এবং স্বামীকে যথাসম্ভব সেবা করতে থাকল!
এভাবে অনিশ্চিত দিন অতিবাহিত করা যায় না, তারপরও কোনভাবে দিন চলছিল, সমস্যা হল অন্যত্র। একজন প্যারালাইসিস রোগীর জন্য এদেশের ইনস্যুরেন্স কর্তৃপক্ষ ইনস্যুরেন্স সুবিধা দিতে রাজি নয়। ইনস্যুরেন্স না হলে ভিসাও নবায়ন হবেনা। ফলে এছাক আলীকে দেশেই চলে যেতে হবে! কিন্তু এছাকের আয়ের উৎস তো সব বিদেশে!
ছেলে-মেয়েদের কাছে এখন আগের মত তাদের পিতা এছাক আলীর জন্য তেমন মায়া নাই। এছাক আলী শুধু তাদের জন্ম দিয়েছে, পিতার কোন আদর-আহ্লাদ ছাড়াই তারা বাল্যকালে দেশে বড় হয়েছে। তাদের সুখে-দুঃখে, আনন্দ-বেদনায় পিতাকে উপস্থিত পায়নি। ঈদে-কোরবানের ছুটিতে মায়ের দেওয়া টাকা খরচ করেছে, পিতার হাতের টাকায় নয়!
ছেলেরা বড় হয়ে মায়ের দেখানো এক ব্যক্তিকে বাবা বলে ডাকতে শিখেছে। এখানে আন্তরিকতা, ভালবাসা, ভালোলাগা, ব্যথা-বেদনা কোনটার উপস্থিতি ছিলনা। সন্তানেরা শুধু বুঝেছে বেঁচে থাকতে হলে টাকা চাই, টাকাই সবকিছু। সেক্ষেত্রে অর্থ-সম্পদ পেতে মায়ের দেখানো এক ব্যক্তিকে পিতা বলতে তাতে কোন সমস্যা ছিলনা তাই এছাক আলীকে বাবা ডেকেছে!
এছাকের ভিসা নবায়ন হয়নি, তাকে দেশে চলে যেতে হয়েছে। ব্যবসা চালানোর জন্য স্ত্রী বিদেশে থাকবে, ছেলে মেয়েরা ব্যবসা ফেলে কোন দুঃখে দেশে যাবে? তাছাড়া পিতার অসুস্থতার পর থেকে তারা পিতার রেখে যাওয়া সম্পদের হিসেব নিকেশ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল! এছাকের শ্বশুর-শাশুড়ি আগেই মারা গিয়েছে; অবশেষে বড় ভাই হাশমত আলীই তার জন্য শেষ ভরসা হল।
প্যারালাইসিসে আক্রান্ত এছাক আলী এখন গ্রামে তার বড় অবহেলিত বড় ভাই হাশমত আলীর কাছেই থাকে। তারা তাকে খানা ও ঔষধ খাইয়ে দেয়, গোসল করিয়ে দেয়, পায়খানা-পস্রাব সহ যাবতীয় কাজে সহযোগিতা করে। এছাক আলীকে তার ভাবী এখনও আগের মত লালন-পালন করে যাচ্ছে; যেভাবে ছোটকালে করেছিল! প্রতি মাসে ১০ হাজার টাকা বিদেশ থেকে আসে, সেখান থেকে এছাক আলীর জন্য ৫ হাজার, ভাবীর দেখাশুনা ভাতা বাবদ ৫ হাজার টাকা। প্যারালাইসিস রোগী এর চেয়ে আর বেশী কি খাবে? তাছাড়া অতিরিক্ত অর্থ দিলে তো অভাবী হাশমত আলী আত্মসাৎ করতে পারে, যার হিসাব পাওয়া যাবেনা।
এছাক আলী চোখের সামনেই প্রতিদিন তার ভাগ্যের ফায়সালা দেখে! কথা বলতে না পারলেও, সব শুনতে পারে, কামনা, বাসনা, কাকুতি, মিনতি, অভিমান করার কোন সুযোগ তার কাছে নাই। ভাবী যা ভাল মনে করেন তাই তিনি খেয়ে থাকেন। একটি তেলাপোকা কিংবা একটি অভদ্র মাছির নিকট তিনি আজ বড় অসহায়! উত্তর পাশ থেকে বেড়ার ফাঁক গলে মাঘ মাসের ঠাণ্ডা হাওয়া হু-হু করে ঘরে ঢুকছে, এছাক আলীর পাথর হবার জোগাড়। একদা মামুন চৌধুরীর কাছে ভিটে বিক্রি করায়, তিনি ঘরের উত্তরাংশ ভেঙ্গে নিয়ে যান, হাশমত আলী সেখানে আজো দেওয়াল দিতে পারেনি। হাড় কাঁপানো শীতের তোড়ে, বেড়ার একটি ছিদ্রও আজ ভয়ঙ্কর শানিত হয়ে উঠেছে কোটি পতি এছাক আলীর জীবনে!
Discussion about this post