“বাবুই পাখিরে দেখে বলিছে চড়াই,
কুঁড়ে ঘরে থেকে কর শিল্পের বড়াই”। চড়ুই পাখি নিধন ও ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ
বাবুই পাখির শিল্প কর্মকে তাচ্ছিল্য করে চড়ুইয়ের উক্তি সমৃদ্ধ এই কবিতাটি আমরা সবাই পড়েছি। মূলত মানুষের আবাস যেখানে, চড়ুইয়ের অবস্থান সেখানে! বিনা অনুমতিতে মানুষের ঘরে চাল ছেঁদা করে সে বাসা বানায়! অগত্যা দালান কোটার অবহৃত কোটর দখল করে হলেও চড়ুই তার সংসার পাতে। এর আরেকটি অন্ত-নিহিত অর্থ হল, মানুষের জীবনের সাথে চড়ুইয়ের কোথাও এক অদৃশ্য লেনা-দেনা আছে। চড়ুই পাখি নিধন ও ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ
আমরা তো চড়ুই পাখি চিনি। যাকে ইংরেজিতে বলা হয় Sparrow. এই শব্দটি দিয়ে শুধুমাত্র আমাদের দেখা চড়ুই পাখিকে বুঝানো হয় না। চড়ুই চরিত্রের সকল ক্ষুদ্র পাখিদের বুঝানো হয়। আমাদের দেশের চড়ুইয়ের নাম House Sparrow তথা ঘরে থাকা চড়ুই। যাদের শব্দ চিড়িক, চিড়িক ধরনের।
চড়ুই খুবই চঞ্চল, বিরামহীন লাফালাফি করার যোগ্যতা সম্পন্ন। সদা চিল্লানো ও ঝগড়া ঝাটি নিয়ে ব্যস্ত সময় কাটায়। লাফিয়ে চলতে পছন্দ করে তাই উড়ার সময়ও লাফানো প্রবণতা দেখা যায়। এরা দীর্ঘ পথ উড়তে পারে না। তাই ডালে-চালে ঘুরে বেড়ায়। তাদের পেট ছোট অন্যূন দশ গ্রাম খেতে পারে। তবে তাদের ঠোঁট বিশেষ কায়দায় সৃষ্টি। খুব সহজেই ধান থেকে চাল ও গমের খোসা ফেঁড়ে গম বের করে ফেলতে পারে।
কমিউনিস্ট গণচীনের নেতা মাও সে তুং একদা চড়ুই পাখির উপর খুব চটেছিলেন। গবেষকদের তথ্য থেকে তিনি জেনেছিলেন যে, একটি চড়ুই পাখি সারা বছরে গড়ে সাড়ে চার কেজি ধান খায়! সে হিসেবে যদি দশ লাখ চড়ুই হত্যা করা যায়, তাহলে ষাট হাজার মানুষের খাদ্যের সংকুলান হবে! এটি সহজ কাজ ছিলনা, তবুও বুদ্ধি একটা বের করা হল।
চীনের প্রধান মাও সে তুং নির্দেশ জারি করলেন, চড়ুই পাখিরা তো মানুষের আশে পাশেই থাকে। তাই সম্মিলিত ভাবে সারা দেশে চড়ুই পাখি তাড়াতে হবে! ক্ষেত-খামার-বিলে কাকতাড়ুয়া বসিয়ে, সারাদিন ঢাকঢোল বাজিয়ে চড়ুইদের তটস্থ রাখতে হবে, মাটিতে নামতে দেওয়া যাবে না। এতে করে উড়ন্ত অবস্থায় তারা দুর্বল হয়ে মারা যাবে!
সারাদেশে নির্দেশ কার্যকরী হল। গৃহিণী থেকে শ্রমিক, শিশু থেকে বুড়ো, সবাই চড়ুই হত্যায় শামিল হল। এভাবে মিলিয়ন মিলিয়ন দুর্বল পাখিগুলোকে গুলতি মেরে, পিটিয়ে মানুষের জনপদ শূন্য করা হল।
চড়ুই পাখি নিধনের ফল হয়েছিল চরম উল্টো, যা চিনকে বিপর্যস্ত করে ফেলে। ১৯৫৮ সালের চিনে ভয়াবহ দুর্ভক্ষে অর্থনীতি মুখ থুবড়ে পড়ে। অগণিত মানুষ মারা যায় খাদ্যের অভাবে! চড়ুই পাখি তো শুধু কৃষকের শস্য খায়না। তারা কৃষকের ক্ষেতের ক্ষতিকর পোকা মাকড়ও খেয়ে থাকে। এভাবে তারা শস্যকে শত্রু মুক্ত রাখে।
চড়ুইয়ের অভাবে দেশে ব্যাপক হারে কিট-পতঙ্গ বেড়ে যায় এবং শস্য উৎপাদনে বিরাট ব্যাঘাত ঘটে। সারা দেশে কীট-পতঙ্গ বেড়ে শস্যর উপর হামলে পড়ে। যার কারণে সৃষ্টি হয়েছিল এই ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ। এই একটি কাজের প্রভাবেই সরকারী হিসেবেই দেড় কোটির উপর মানুষ মারা গিয়েছিল! বেসরকারি তথ্য মতে আরো বহুগুণ বেশী।
ভারতীয় মহারাষ্ট্রের একটি শহরের নাম ‘নাসিক’। সেই শহরের যুবক ‘দেলোয়ার’ নাসিকের House Sparrow তথা চড়ুই পাখিদের নিরাপত্তা, সংরক্ষণ নিয়ে কাজ শুরু করেছিলেন Nature Forever Society এর সাথে। যার কারণে তিনি ২০০৮ সালের ২০ শে মার্চ “Heroes of the Environment” পুরষ্কার পেয়েছিলেন। সে থেকেই এই দিনটিকে বিশ্ব চড়ুই দিবস হিসেবে চিত্রিত করা হয়।
চলুন প্রকৃতিকে রক্ষা করি এবং তাতে যেন ধ্বংস ও বিকৃত সাধন না করি। এর ফলে মানবজাতিই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কেননা যিনি পৃথিবীর জীবন, জলবায়ু ও পরিবেশ সৃষ্টি করেছেন। তিনি সেখানে সবার জন্য বাঁচার উপায়টাও রেখে দিয়েছেন। প্রকৃতির কোন কিছু হয়ত আমাদের ধ্যানে জ্ঞানে অপ্রয়োজনীয় মনে হতে পারে কিন্তু আমাদের অজান্তে তা আমাদের জন্য বড় উপকারী এবং আমাদের রক্ষায় তা কার্যকরী। পবিত্র কোরআনে সে কথাটিরই ইঙ্গিত দিয়েছে।
আল্লাহ বলেছেন,
“তারা কি লক্ষ করেনা, আমি ঊষর ভূমির ওপর পানি প্রবাহিত করে তার সাহায্যে উদগত করি শস্য, যা থেকে তাদের গবাদি পশু এবং তারা নিজেরা আহার গ্রহণ করে” সেজদা-২৭
Discussion about this post