সুদর্শন, স্মার্ট, উচ্চশিক্ষিত আমার বন্ধুটি কাফকোতে অফিস স্টাফ হিসেবে কাজ করে। শহরে একই কক্ষে থাকি। অনেক বেতন। আমার জীবনে দেখা যে কয়জন উচ্চশিক্ষিত স্মার্ট যুবককে দেখেছি, তার মধ্যে সে একজন। চাকুরী আছে আভিজাত্য নেই
সবমিলিয়ে ১২ হাজার টাকা বেতন! এটা বাজারের উচ্চ-বেতন স্কেল। রেস্টুরেন্টে ১০ টাকা দিয়ে মাছ-গোশত দিয়ে খাওয়া যায়। ৩৫ টাকা ঢাকা চট্টগ্রামের চেয়ার কোচের সিটের মূল্য। চাকুরী আছে আভিজাত্য নেই
চট্টগ্রামের কাফকো সার ফ্যাক্টরি প্রতিষ্ঠিত হয় এরশাদের আমলে। ১৯৯১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় আসলে, দুর্নীতির নানা গন্ধের কথা তুলে কাফকো বন্ধ করে দেয়। বন্ধুর চাকুরী যায়। তার পিতা-মাতা ইংল্যান্ডে থাকে, সচ্ছল জীবন। তারপরও সে একটি কাজের সন্ধানে থাকে। আমাকে একটি চাকুরীর জন্য অনুরোধ করে।
বিষয়টিকে আমি মশকরা হিসেবে মনে করি। তাই বললাম, তোমাকে ১২ শত টাকা স্কেলের একটি চাকুরী দিতে পারি। কোন বিবেচনা না করেই, সাথে সাথেই রাজি হয়ে যায়। তখনও আমি তার আগ্রহের ব্যাপারটিকে তামাশা মনে করতে থাকি। কেননা ১২ হাজার বেতনের মানুষ ১২ শত টাকার চাকুরী করার কথা নয় কিন্তু সে নাছোড়বান্দা, সে চাকুরী করবেই।
তার হেঁয়ালি-পনায় ভয় পাই। কেননা আমি কারো জন্য সুপারিশ করলেই ইপিজেড এ আমার কোম্পানিতে চাকুরী হবেই। কিন্তু সে যদি অল্পদিন পরেই চলে আসে তাহলে আমার ভাবমূর্তির জন্য খারাপ হবে। এটা জানার পরে, সে ওয়াদা করে যে, এমন কাজ সে করবে না।
শ্রমিক কর্মকর্তা হিসেবে তাকে গার্মেন্টস এর প্যাকিং ডিভিশনে ঢুকিয়ে দেই। অল্পদিনের মধ্যেই সে সবার নজরে আসে। তার ইংরেজি বলার দক্ষতা, ব্যক্তিত্ব, স্মার্টনেস ও কাজের প্রতি একাগ্রতা তাকে পরিচিত করে তুলে। তার নাদুস-নুদুস চেহারায় কপাল বেয়ে ঘাম পড়তে দেখলে আমার মায়া লাগত।
আমি আসতাম অফিস স্টাফদের মাইক্রোতে। সে যেত শ্রমিকদের সাথে বাসে করে। অল্পদিন পরেই তার পজিশন পরিবর্তিত হতে থাকে। সে অফিসার হয়ে যায়, প্রমোশন হয়।
ইতিমধ্যে বিএনপি সরকারের সাথে জাপান সরকারের দরকষাকষির ফলে কাফকো পুনরায় চালু হয়। তাদের কর্মকর্তারা বন্ধুকে হন্যে হয়ে খুঁজে বের করে নেয় এবং পুনরায় তাকে তার পূর্বের স্থলে স্থলাভিষিক্তের জন্য পত্র দেয়।
আমার মাথায় আসমান ভেঙ্গে পরে, এটারই ভয় করছিলাম। আমার উপর আমার কোম্পানির বিদেশী কর্মকর্তারা খুবই নাখোশ হয়। এমন এক লোভী অবিশ্বস্ত ব্যক্তিকে কাজে লাগিয়েছি। যাকে কাজ শিখানের অল্পদিন পরেই, আরো বেশী বেতনের লোভে চাকুরী বদলায়।
সুতরাং তার সেই কাজ দেখার দায়িত্বও আমার উপরেই। আমার যে কাজ আগে থেকেই ছিল, সেটার সাথে এই কাজটিও অতিরিক্ত যোগ হল! তবে বন্ধুর মত আরেকজন স্মার্ট কাউকে কাজ শিখিয়ে দিলে আমার মুক্তি মিলবে।
বিভিন্ন জনের কাছে চাকুরীর কথা তুললাম। সবাই দরখাস্ত নিয়ে দৌড়ে আসে কিন্তু কাজের বিবরণ শুনে দ্বিগুণ গতিতে দৌড়ে পালায়। অনেকের কথা এটা তাদের পারিবারিক ঐতিহ্যের সাথে বে-মানান, তাদের প্রাপ্ত শিক্ষার প্রতি অবিচার। লেখাপড়া করে এমন কাজ করবে না, প্রয়োজনে ভিক্ষা করে খাবে!
আমার জীবনে এটা একটা বিরাট আত্মগ্লানির সময় ছিল। ওরা সব না জেনেই কথা বলছে। অথচ তারা যদি আমার অফিস দেখত, তাহলে দেখতে পেত শুধু আমার সাথে কথা বলার জন্য কমপক্ষে দুইবার সিকিউরিটি গেট পাস হতে হত এবং আরো দেখতে পেত যারা স্বেচ্ছায় চাকুরীর জন্য এসেছে, তারা গেইটের বাহিরে ঘণ্টার পর ঘণ্টার অপেক্ষার প্রহর গুনছে।
সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম জীবনে আর কাউকে চাকুরী দিব না। বিশেষ করে আমার জন্মভূমি চট্টগ্রামের মানুষকে তো নয়ই। চাকুরী নিয়ে তাদের ঠাট বেশী। আগেই বুঝে ফেলেছিলাম তারা চাকুরীর উপযোগী নয়। তারপরেও একজন কোত্থেকে উড়ে এসে আমাকে প্রায় হাতে-পায়ে চেপে ধরেই বলল, একটি চাকুরী চাই।
ডিগ্রী পাশ করেছে অনেক আগেই কিন্তু কোথাও চাকুরী পাচ্ছে না। দিন দিন তার ঘরের চাহিদা বাড়ছে কিন্তু নিজের জন্যই প্রয়োজনীয় টাকাটা সংগ্রহ করতে পারছেন না। উপোষ থাকতে বাধ্য হচ্ছে। কোন এক মেয়েকে টিউশনি পড়াত, সেটাও গ্যাছে।
তাকে বললাম, “একটি চাকুরী আছে, তবে চাকুরী মানে কারো চাকর হওয়া”। চাকর হয়ে চাকুরী করতে তুমি কি রাজি আছ? তড়াৎ করে লাফিয়ে উঠে। যে ধরনের চাকুরী হবে, তাই সে করবে! চাকুরীটা যে ধরনের তার চেয়েও কঠিন-ভাবে উপস্থাপন করলাম। সে রাজি তাকে কাজে ঢুকিয়ে দিলাম।
দুই মাসের মধ্যেই সে চাকুরীটা ছেড়ে দিল! কেননা সামান্য বেতনের এই চাকুরী দিয়ে তার চলবে না! তাছাড়া সে অংকের ছাত্র, রাস্তায় হেঁটে হেঁটে অংক পড়ালেও এর চেয়ে বেশী কামাতে পারবে। মাথার উপরে দ্বিতীয়বার আসমান ভেঙ্গে পড়ে।
স্বামী পরিত্যক্তা এক বিতর্কিত মহিলার মেয়েকে বিয়ে করে, ঘর জামাই হিসেবে সে নতুন জীবন শুরু করে। মহিলার বাপের বাড়ির সামনে পান-গ্রোসারীর দোকান চালায়, মানুষকে উপদেশ দেয়, বিশ্ব-রাজনীতি নিয়ে কথা বলে, কার দোষে তার তার উন্নতি হয়নি সেটা বলে বেড়ায় এবং মানুষকে সুদের টাকা ধার দিয়ে জনকল্যাণে কাজ করে।
নিজেদের দৃষ্টিভঙ্গির জন্যই মানুষ বেশী বিপদগ্রস্ত। চাকুরীও এখন সহজে জুটেনা যদিও চাকুরী (চাকর) শব্দের মধ্যেই গোলামীর উপাদান লুকিয়ে। অথচ সেটাকে সম্মানী মনে করি কিন্তু কাজ করাকে লজ্জাজনক ভাবি! মূলত
“যে দাঁড়াতে শিখে, সে দৌঁড়াতে পারে”
যে মাঠে স্থান পায়, সেই প্রতিযোগী হয়। সুতরাং কাজ কেমন সেটা বড় কথা নয়। কোথাও দাঁড়ানোর মত জায়গা পেলেই দাড়িয়ে যাওয়া উচিত, দাঁড়ানো ব্যক্তিরাই দৌড়ের সুযোগ বানাতে পারে। বসা ব্যক্তিরা আজীবন বসেই থাকবে।
Discussion about this post