এটা আমার ব্যক্তিগত উপলব্ধি, জাতীয় কবির তালিকা সম্প্রসারিত হউক। জানি এ কথায় দ্বিমত থাকবে কিন্তু আশা করি আমার সাথে একমত হবার মানুষও কম হবেনা। সত্য বলতে লজ্জা নেই যে, আমাদের কি নিয়ে গর্ব করা উচিত তা আমরা যেমন জানিনা তেমনি জানলেও আবার অবজ্ঞা করি।
উইলিয়াম সেইক্স পিয়র (১৫৬৪-১৬১৬) ইংল্যান্ডের জাতীয় কবি। ইংরেজেরা তাকে নিয়ে আজো গর্ব করে। মূলত সেইক্স পিয়র কবি পরিচিতির চাইতেও নাট্যকার হিসেবে সারা দুনিয়ায় বেশী সমাদৃত। ইংরেজেরা তাকে জাতীয় কবি বলে সারা বিশ্বে ঢোল পিটানোর পিছনে ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক কারণ আছে। এই প্রচারণার মাধ্যমে তারা বুঝাতে চায় ইংরেজ জাতি ষোড়শ শতাব্দী থেকেই সভ্য ও শিক্ষিত। যার কারণে সে সমাজে উইলিয়াম সেইক্স পিয়রের মত বিদ্বান মানুষের জন্ম হয়েছে।
বাংলা ভাষা পৃথিবীর ইতিহাসে শ্রেষ্ঠ ভাষাগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি ভাষা। যে ভাষার প্রাচীন ইতিহাস আছে, পাণ্ডুলিপি আছে, আরো আছে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের স্বীকৃতি। ত্রয়োদশ শতকের বিখ্যাত বাংলা কবি শাহ মুহাম্মদ সগীর (১৩৮৯-১৪১১) তদানীন্তন দুনিয়ার অন্যতম সেরা শাসক গিয়াসউদ্দীন আজম শাহের রাজ দরবার কাপিয়ে তুলছিলেন বাংলা সাহিত্যের অনবদ্য কথনের মাধ্যমে। এর দ্বারা প্রমাণিত হয়, বাংলা ভাষা তখনও রাষ্ট্রীয় ভাষার মর্যাদায় অভিষিক্ত ছিল এবং আমাদের জনপদের মানুষ লিখা-পড়ায় শিক্ষিত ছিল। শাহ মোহাম্মদ সগিরের জন্ম উইলিয়াম সেইক্স পিয়রের বহু বছর আগে হলেও আমরা তাকে নিয়ে গৌরব করতে শিখি নি। আমরা দাবী করতেও শিখিনি যে, আবহমান বাংলার মানুষ সাত শত বছর আগে থেকেই শিক্ষিত ও পরিমার্জিত জাতি।
আরো পড়ুন…
- নববর্ষ উৎযাপনের রীতি-নীতি
- বাংলা নববর্ষে মুসলমানদের অবদান
- সন্তানকে জ্ঞানী ও সৃজনশীল বানানোর সেরা উপায়
কবি আবদুল হাকিমের (১৬২০) নাম আমরা অনেকেই ভুলে গিয়েছি। ভাষার মাসে অধুনা কবিদের গীতিকাব্য নিয়ে রেডিও-টিভি, সংবাদ পত্র সারাদিন ব্যস্ত থাকবে। চারশত বছরের আগের কবির লিখা গুলো পড়লে মনে হবে তিনি বুঝি আজকের জন্যই লিখে গেছেন। বহু ভাষায় পারদর্শী এই কবি বাঙ্গালী হিসেবে গর্ববোধ করতেন। তিনি লিখে গেছেন বিখ্যাত সব গীতিকাব্য। বিংশ শতাব্দীর শেষাবদি পর্যন্ত বাংলার জনপদে কবি আবদুল হাকিমের পুথি সাহিত্যের দখলে ছিল। তিনিও প্রায় ইংরেজ কবি সেইক্স পিয়রের সমসাময়িক কালের। কিন্তু ইংরেজেরা তাকে নিয়ে গর্ব করতে পারলেও আমরা আবদুল হাকিমকে নিয়ে পারিনা। এই পারার মাঝে গর্ব করার ছিল, অহংকার করার উপাদান ছিল কিন্তু আমরা জানিনা কিভাবে গৌরব করতে হয়।
মহাকবি আলাওল (১৫৫৭-১৬৭৩) মধ্যযুগের বাঙ্গালী কবি। তিনি জগতের শ্রেষ্ঠ কবিদের মধ্যে একজন। সমানুপাতিক শব্দ ও ছন্দ ব্যবহার করে তিনি সেই জমানায় বিশাল বিশাল গ্রন্থরাজির জন্ম দিয়েছিলেন। বাংলা ভাষার বর্তমান শব্দ সংখ্যা প্রায় ৭৫ হাজার ছাড়িয়েছে। এত শব্দ সংখ্যা দিয়েও আলাওলের মত বিশ্বসাহিত্যের কথা বাদ দিলাম, একটি ছোট্ট সাহিত্য বানানোও অনেক কঠিন। আলাওলের কাব্য অনুবাদ করে, বাংলা ভাষার প্রথম মুসলিম মহিলা কবি রহিমুন্নেছার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। মহাকবি আলাওল বাংলা ভাষার সম্পদ, বাংলাকে ইতিহাসের নতুন অধ্যায়ে অন্যতম স্থানে তুলে নেবার জন্য মহাকবি আলাওলের একক অবদানই যথেষ্ট। তাহলে তাকে নিয়ে আমরা গর্ব-অহংকার করতে পারছিনা কেন? নিজেদের কে শ্রেষ্ঠ হিসেবে উপস্থাপন করার জন্য, অতীত ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিদের কে সামনে উপস্থাপন করতে হয়। যেটা ইংরেজ জাতি করেছে। আমাদের জ্ঞান বুদ্ধিতে কিছু না কুলালেও অন্যদের বুদ্ধি দেখে হলেও তো শিখতে পারি।
বর্তমানে আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম। তিনি আমাদের প্রাণের কবি, হৃদয়ের কবি। তার সাথে তুলনা নয়। বাংলাভাষার নতুন-পুরাতন অনেক জগতসেরা কবি আছে, প্রত্যেকে নিজ জমানায় সেরা ছিলেন, স্বীকৃত ছিলেন। আমি তাদের কথাই বলব। বাংলা ভাষার ঐতিহ্য-ইতিহাস রক্ষার্থে ও গৌরব করার প্রত্যয়ে, ‘আমাদের জাতীয় কবির তালিকা আরো সম্প্রসারিত করা উচিত। এই নামের তালিকায় আরো কবিদের স্থান দেওয়া অতীব জরুরী। আমরা মহাকবি আলাওলের নাম এই তালিকাতে সংযুক্ত করার জন্য আওয়াজ তুলতে পারি। তাকেও জাতীয় কবি ঘোষণা করা হউক। ইরানে শেখ সাদী, হাফিজ, ফেরদৈসি, ওমর খৈয়াম, আল্লামা রুমি মত বহু বিশ্বসেরা কবিকে জাতীয় মর্যাদা দেওয়া হয়। এর দ্বারা দেশের শিক্ষা, সাংস্কৃতি, ঐতিহ্যের সম্মান বাড়ে।
বর্তমানে আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম। তিনি আমাদের প্রাণের কবি, হৃদয়ের কবি। তার সাথে তুলনা নয়। বাংলাভাষার নতুন-পুরাতন অনেক জগতসেরা কবি আছে, প্রত্যেকে নিজ জমানায় সেরা ছিলেন, স্বীকৃত ছিলেন। আমি তাদের কথাই বলব। বাংলা ভাষার ঐতিহ্য-ইতিহাস রক্ষার্থে ও গৌরব করার প্রত্যয়ে, ‘আমাদের জাতীয় কবির তালিকা আরো সম্প্রসারিত করা উচিত। এই নামের তালিকায় আরো কবিদের স্থান দেওয়া অতীব জরুরী। আমরা মহাকবি আলাওলের নাম এই তালিকাতে সংযুক্ত করার জন্য আওয়াজ তুলতে পারি। তাকেও জাতীয় কবি ঘোষণা করা হউক। ইরানে শেখ সাদী, হাফিজ, ফেরদৈসি, ওমর খৈয়াম, আল্লামা রুমি মত বহু বিশ্বসেরা কবিকে জাতীয় মর্যাদা দেওয়া হয়। এর দ্বারা দেশের শিক্ষা, সাংস্কৃতি, ঐতিহ্যের সম্মান বাড়ে।
এই স্বীকৃতির মাধ্যমে বিশ্ববাসী জানতে আগ্রহী হবে কে সেই আলাওল? যখন আলাওল কে জানতে যাবে তখনই দেখতে পাবে বাঙ্গালীরা এখন পশ্চাৎপদ হলেও চারশত বছর আগে থেকেই সভ্য ও শিক্ষিত ছিল। ইতিহাসের বিষয় নিয়ে দাবী করা এক জিনিষ কিন্তু প্রমাণ করে দাবী পেশ করা ভিন্ন জিনিষ। বাঙ্গালীরা শিক্ষিত, সভ্য, ভদ্র, মার্জিত এই কথা প্রমাণ করার জন্য ইতিহাসে শত শত উপাদানের টইটুম্বুর করছে। আমরা ব্যবহার করছি না। আমরা উর্দুর পিছনে লেগে আছি, কেউ হিন্দির পিছনে। এ দুটি ভাষা রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পেয়েছে মাত্র সত্তর বছর আগে। বিশ্ব সাহিত্য অনুবাদ করে উর্দু ভাষার পূঁজি অনেক বাড়িয়েছে। হিন্দিকে প্রতিষ্ঠিত করতে বর্তমান ভারতের নীতি নির্ধারকেরা মরিয়া। এই দুটি ভাষাই বাংলার কাছে শিশু তুল্য। ৭০ বছর আগে হিন্দিতে লিখিত একটি বিশ্বমানের সাহিত্য কেউ দেখাতে পারবে না। অথচ আমাদের ছেলেরা হিন্দি নিয়ে যথেষ্ট মরিয়া। যে বাংলা ভাষার এত সমৃদ্ধ ইতিহাস, এত উপাদানে ভরা, সেটা নিজেদের হওয়া স্বত্বেও আমরা অন্যের গোলামী করছি, নিজের গ্যাঁটের টাকা খরচ করে।
তাই আজকের দাবী হউক, বাংলা ভাষা উপমহাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ভাষা, এটা আমাদের অহংকার। বাংলাভাষা শ্রুতিমধুর ভাষা, এটা সহজে রপ্ত-যোগ্য ভাষা। এই ভাষা শুনে কেউ হাসেনা, কেউ বিরক্ত-বোধ করেনা। বাংলা ভাষার শব্দ মোলায়েম, মিহি এবং সুরের জন্য দারুণ কার্যকর। প্রতিটি শব্দকে আলাদা করে উচ্চারণ করা যায় এমন কি ব্যঞ্জনবর্ণের বহু শব্দের উৎসস্থল একই কিন্তু উচ্চারণে ভিন্নতা আছে, এর কারণে বাংলা ভাষার শব্দ উচ্চারণ আরো আকর্ষণীয় হয়ে উঠে। বাংলা ভাষার প্রথম শব্দটি ‘অ’ এই শব্দের ব্যবহার উপমহাদেশের অন্য কোন ভাষা রীতিতে নেই। সারা দুনিয়ার অল্প কয়েকটি ভাষা আছে যেখানে ‘অ’ এর মত উচ্চারণের সুযোগ আছে। চল, বল, গণ, রণ, ধর, কর, টলমল এ ধরনের শব্দ শুধুমাত্র বাংলায় উচ্চারণ করা যায়। উর্দু-হিন্দি সহ অগণিত ভাষায় এগুলোর সঠিক উচ্চারণ করা যায় না। এটা বাংলা ভাষারই চাতুর্য। এই তথ্যে অনেকে হয়ত আশ্চর্য হবে কিন্তু এটাই সত্য কথা। এই কথার গভীরতা বুঝার জন্য একটি সূত্র দিচ্ছি।
“জন-গণ-মন-অধিনায়ক জয় হে ভারত ভাগ্য বিধাতা” কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই কবিতা লিখেছিলেন, এটি বর্তমানে ভারতের জাতীয় সংগীত। বাংলা ও হিন্দিতে গানটি গাওয়া হয়। যেহেতু বাংলায় লিখিত গান তাই বাংলার রীতি অনুসরণ করা হয়। তদুপরি হিন্দি, তামিল, কেরালা ভাষাভাষীরা এই শব্দগুলো উচ্চারণ করতে বেগ পায়। শুনলে তফাৎ বুঝা যাবে। বাংলা এখানেও সেরা। তাই আসুন বাংলায় কথা বলতে শিখি। বিশুদ্ধ উচ্চারণ করতে চেষ্টা করি এবং নিজের মাতৃভাষা বাংলাকে নিয়ে গৌরব করতে শিখি।
Discussion about this post