সংসারে ছোট ভাই বোনেরা সর্বদা বড়দের আদর, স্নেহ ভালবাসা পায় কিন্তু সেটার যথাযথ সমন্বয় না থাকলে আদরের এই ছোটরাই একদা চরম স্বার্থ-বাদী ও হিংসুক হয়ে উঠতে পারে। বড়দের অবদানের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ তো দূরের কথা উল্টো এটা দেয় নাই, ওটা করা হয়নাই বলে লম্বা ফিরিস্তি প্রকাশ করে বড়দের নিন্দা প্রচার ও বদনামে মুখরিত করে ছাড়বে। পরিবারের এই চরম সমস্যা সৃষ্টি হয় কিন্তু বাবা-মায়ের কিছু অসতর্কতার জন্যই। পিতা-মাতা যদি শিশুকালের গাইডেন্সে ভুল করে তাহলে সারা জীবন তাদেরকেই এর চরম মাশুল দিতে হয়।
একসাথে খেতে বসলে বড় বোন আদর করে তার ভাগের ডিমের একটি বড় অংশ ছোট ভাইটির পাতে তুলে দেয়। কিংবা কিনে আনা তিনটি চকলেট বারের দুটো ছোট বোনকে দিয়ে বড় ভাই তার জন্য একটি রেখেছে। একটি ডিম কিংবা চকলেট বারের উদাহরণ এক দিনের জন্য নয় বরং দীর্ঘ বছর ধরেই আদরের ছোটদের প্রতি এই অনুকম্পা প্রতিটি ঘটনায়, প্রতিটি বস্তুতে তার সাক্ষর রেখে চলে।
অন্যদিকে ছোটরা যে অনুকম্পা পেয়ে আস্তে-ধীরে বড় হয়ে উঠেছে, এটা তাদের চাওয়া পাওয়া কিংবা আবদারের কারণে হয়নি। শিশুরা বুঝতে পারেনা কেন বড়রা এতটা বেকুবের মত তাকে সর্বত্র অগ্রাধিকার দিচ্ছে, বেশী দিচ্ছে এবং সর্বদা এভাবে করেই যাচ্ছে! এক পর্যায়ে সে ভাবতে থাকে, এভাবে পাওয়াটা তার অধিকারের অন্তর্ভুক্ত। কোন একদিন যদি সে দেখে বড়রা আজ তাকে বড় অংশ দেয়নি কিংবা গুরুত্ব দেয়নি; তখন সে মারাত্মক প্রতিবাদী হবে, ভয়ানক শব্দে কান্না জুড়ে দেবে, উত্তেজিত হয়ে কিছু ভাঙ্গতে উদ্যত হবে! এমনও হতে পারে, সেই বড় ভাই-বোনকে মারার জন্য হাতে লাটিও নিয়ে ফেলতে পারে! পরিণতিতে বড় ভাই-বোন চরম আশাহত হবে, বাবা-মাকে নালিশ করবে।বাবা-মা সন্তানের পরিবর্তিত এই আচরণের কোন কুল কিনারা পাবেনা। সবাই যেহেতু তারই সন্তান তাই বাইরে কাউকে বলাও যায় না আবার নিজের সন্তান হিসেবে না যথাযথ সমাধান করতে পারে না শাসন করতে পারে। পরিশেষে, পিতা-মাতা বড়দের উপর খড়গ হস্ত হয় এই বলে যে, তোমাদেরকে ছোটদের ওই আচরণ সহ্য করতেই হবে! কেননা তোমরা বড় আর ও ছোট, অবুঝ!
ছোটদের প্রতি এই আদর, সংসারে এক পর্যায়ে উৎপাত সৃষ্টি করে। আদর দেওয়া বড়রা এসব মন খুলে বলতে না পারলেও, ভাবতে থাকে এত আদর-সোহাগ দিয়ে কাকে এত বছর ধরে বড় করেছে! কীইবা তাদের লাভ হয়েছে? বরং আদরের মায়ায় একটা চরম হিংসুক ও আগ্রাসী সাপ হয়ে বেড়ে উঠেছে! এটা চিন্তা করে তারা একেবারে গা ছেড়ে দেয় ব্যাপার খানা এমন নয় বরং তারাও চেষ্টা করে বুঝাতে, শোধরাতে এবং নিবৃত করতে।
মা না খেয়েই সন্তানদের খাওয়ায় এটা সন্তানেরা দেখে থাকে কিন্তু বড় ভাই-বোন মায়ের মত না খেয়ে করেনা, তাদের জন্যও কিছুটা রাখে! এই হিসাবটাই তখন বড় হয়ে দেখা দেয়। বড়দের এসব গুমোট আপত্তির যথাযথ উত্তর দিতে না পেরে, তাদের মুখ বন্ধ করার জন্য সম্ভব হলে, মা-বাবা তাদের উপরেই বদনাম তুলে দিবে এই বলে যে, তোমরাও ছোট কালে এমন ছিলে, এমন আচরণ করেই বড় হয়েছে!
আল্লাহ এই পৃথিবীর প্রাণীকুল সহ সকল সৃষ্টিকুলকে রক্ষা করতে মানব জীবনে মায়ার চাদর দিয়ে আচ্ছাদন করেছেন। সৃষ্টিকুল রক্ষায় এটা তাঁর অভিনব পদ্ধতির অন্যতম একটি। অনেকে কুকুর-বিড়াল পছন্দ করে না কিন্তু তাদের ছানাগুলো যখন হাঁটতে শিখে তখন অতিষ্ঠ মানুষ তাদের প্রতি রহম দেখায়। হাঁস-মুরগীর উৎপাত সহ্য হয়না বলে অনেক গৃহিণী এসব পালনে বিরক্তি পায় কিন্তু তাদের কচি শিশুগুলোর মোলায়েম গায়ে হাত বুলাতে অনেকে আনন্দ পায়। সেভাবে, গরু, ছাগল, কাঠবিড়ালি সহ আমাদের চারিপাশে আল্লাহর যত সৃষ্টি শিশু আছে সবার প্রতিই মানুষের মমত্ব থাকে। এর পরবর্তী আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু হল সুন্দর আচরণ। গৃহপালিত ময়না, টিয়া, একুয়ারিয়ামের মাছ সহ যাবতীয় পালন কৃত প্রাণী সুন্দর আচরণের জন্যই পালা হয়। কাক যদি ময়নার মত মানুষের কথা বলত তাহলে তারও কদর কম হতনা। সাপ যদি ছোবল না মারত, তাহলে মানুষ হাতে পেঁচিয়ে চলাফেরা করত।
শিশুদের প্রতি মানুষের দরদ স্বভাবজাত। তাকে একটু আদর করা, যৎ-সামান্য উপহার দিয়ে খুশী করা, শিশুদের একটি অনাবিল হাসি আদায় করা, মানুষের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। অন্যের শিশুর প্রতি এতটুকু ভালবাসা সবাই দেখায় কিন্তু সেখানে কেউ স্বার্থ ত্যাগ করেনা! তবে, নিজের ভাই-বোনের জন্য সবাই স্বার্থ ত্যাগ করে, কেননা তার সাথে রয়েছে রক্তের বন্ধন, হৃদয়ের আকর্ষণ। স্বার্থত্যাগের অতি আন্তরিকতা, অতি ভালবাসা, অতি ভাবাবেগ মানুষের প্রতি আল্লাহর নেয়ামতের একটি নিদর্শন। মায়া-মমতা, ভালবাসার আবেগ মানুষের মনে উতলে দিয়ে আল্লাহ অসহায়, নিষ্পাপ শিশুকে পৃথিবীতে এভাবেই বড় করান। চরম স্বার্থপর পিতার রেখে যাওয়া সন্তানকে, আরেকটি সন্তান পালন করার বহু দৃষ্টান্ত দুনিয়াতে বর্তমান। রক্ত যতই স্বার্থপর হউক, আপনজনের প্রতি এই আদর, এই দায়িত্ব অকৃত্রিম ভালবাসার জন্যই সবাই করে। এটাকে বিনিময় দিয়ে বিবেচনা করা যায় না। বিষয়টা সরাসরি আল্লাহর পক্ষ হতেই নিয়ন্ত্রিত হয় তাই মানুষ মায়ার বন্ধনে থাকতেও বাধ্য হয়।
আল্লাহ কাউকে বড় করিয়ে নিবেন তাঁর সৃষ্ট সুন্দর পন্থায়। আর বড়রা যারা শিশুর প্রতি আদরের বন্যা বইয়ে, কষ্ট সহ্য করে, লালন-পালন করে বড় করেছে। তারা এই আশা করেনা যে, শিশু বড় হয়ে তার প্রতিদান দিবে। কিন্তু তারা এটাও আশা করে না যে, আদরের এই শিশু বড় হয়ে অকৃতজ্ঞের মত আচরণ করবে। কিন্তু বহু শিশু অকৃতজ্ঞ হয়েই বড় হয়। ছোটকালে অকৃতজ্ঞতার পরিমাণ কম হলেও বাড়তে বাড়তে পরিণত বয়সে সেটাকে চুলোয় ঢুকিয়ে ন্যুনতম বদান্যতা পর্যন্ত স্বীকার করেনা। এই অশুভ পরিণতি প্রথমে নিজেদের থেকে শুরু হয়, তারপর ঘরের বাইরে ছড়িয়ে পড়ে। ঘরের ঝগড়া বাহিরের কোন্দলে পরিণত হয়। অব্যাহত থাকে একে অপরকে উৎখাতের মহড়া। শুনতে দৃষ্টিকটু ও উদ্ভট লাগলেও শিশুর এই চরিত্রের জন্য পিতা-মাতা ও সমাজ কম দায়ী নয়! এই দায় ইচ্ছাকৃত নয় বরং ঘটে নিতান্ত অনিচ্ছায়, অজ্ঞতা আর অসাবধানতার ফলে।
মাহতাব সাহেবেরা পাঁচ ভাই তিন বোন। একটি মুদি দোকানের উপর নির্ভর করে পিতার পরিবার চলেনা। ভাইয়েরা সবাই মেধাবী; আত্মীয়-অনাত্মীয় সকলের সাহায্যে ও টিউশনি করে টাকা রোজগার করে কোনমতে ইন্টার পাশ করে বিদেশ চলে আসেন মাহতাব। এখানে শুরু হয় কঠিন এক জীবন। বড় পদে যেতে না পারলেও কোম্পানির খুবই বিশ্বস্ত মানুষ মাহতাব। তিনি সিদ্ধান্ত নেন অর্থের অভাবে তিনি যেহেতু পড়তে পারেননি তাহলে মেধাবী ভাইদেরকে যে কোনভাবেই পড়াবেন। বিয়ে-শাদী না করে পনের বছর ধরে তিনি সবাইকে পড়িয়েছেন, উচ্চ শিক্ষা পাইয়ে দিয়েছেন। বোনদের বিয়ে দিয়েছেন, পিতা-মাতাকে হজ্ব করিয়েছেন। এক ভাইকে বিদেশে এনেছেন বাকিরা দেশেই প্রতিষ্ঠিত। মাহতাব যখন বিয়ের সিদ্ধান্ত নেন, তখন জানতে পারেন তার এক ভাই গোপনে বিয়ের কাজ আগেই সেরে ফেলেছেন! অন্যজন করার অপেক্ষায়! দুই জনে গোপনে শহরে ফ্লাট কেনার তালে আছে। ভাইদের সবার এক কথা তিনি এত বছর বিদেশ থেকে আমাদের জন্য কি করেছেন? মাসে মাসে স্কুল-কলেজের টাকা দিলেই কি বড়ভাইয়ের কর্তব্য শেষ! অথচ মাহতাবের কাছে জমা কোন অর্থকড়ি নেই।
তার ভাইয়েরা সবাই বিয়ে করেছে। তাদের ছেলেরাও বড় হয়েছে। মাহতাব দেরীতে বিয়ে করার জন্য বয়স হারিয়েছে এবং তার সন্তানেরাও অন্য ভাইদের সন্তানের বয়সী। অন্যদের পরিবার শহরে থাকলেও মাহতাবের পরিবার গ্রামে থাকতে বাধ্য হয়। যখন ভাইয়ের সন্তানদের সরকারী ও ইংরেজি স্কুলে ভর্তি করানোর জন্য ঘরে কয়েকজন করে টিউটর তখন মাহতাব তার সন্তানকে নূরানি মাদ্রাসায় ভর্তি করিয়ে দেন। বয়স বাড়লে আয় কমে, দুঃচিন্তা বাড়ে। মাহতাব বড় আশায় থাকে ইশ! আমার ছেলেরা সবার চেয়ে মেধাবী, যদি ভাইদের কেউ একজন আমার একটা ছেলেকে আশ্রয় দিত, তাহলে কতই না কল্যাণ হত। ভাইয়ের বউদের সোজা সাফটা কথা, তোমার ভাই তোমাদের জন্য কি করেছে সেটা তুমি দেখ। গ্রামের ‘ক্ষ্যাত‘ ছেলে বাসায় ঢুকিয়ে আমার গুলো নষ্ট করতে চাই না। পাঠক, এ ধরনের দৃশ্য আমার-আপনার এবং সারা বাংলাদেশের সর্বত্র কম-বেশী আছে।
উপরের দৃশ্যটি পড়ে সবাই বলবেন যে, ছোট ভাই গুলো চরম অকৃতজ্ঞ। মূলত কৃতজ্ঞতা প্রকাশের জন্য উপলব্ধি এবং অভ্যাস দুটোকেই সমান তালে গড়ে তুলতে হয়। বড় বোন নিজের প্রাপ্য ডিমটি যখন ছোট ভাইকে খাওয়ার জন্য উপহার দেয়, তখন মায়ের দায়িত্ব হল ছোট ভাইকে এই শিক্ষা দেওয়া যে, তুমি বড় বোনের কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন কর। শিশু শোকরিয়া, ধন্যবাদ, থ্যাংকস কিংবা একটি চুমোর মাধ্যমে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে পারে। এভাবে অবিরত, প্রতিনিয়ত ছোট-বড় সকল কাজে শিশুকে অভ্যস্ত করিয়ে তুলতে হবে সামান্য কাজের জন্যও যেন কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে। কখনও শিশুর প্রাপ্য অংশ বড়দের দেওয়ার অভ্যাস করাতে হবে। শিশু হলে কি হবে, স্বার্থ বুঝার ক্ষেত্রে বেশীর ভাগই চতুর হয়; তাই শুরুতে শিশু এটা পছন্দ করবে না। তখন তাকে বুঝাতে হবে, দেখ তুমি কিছু দিতে তোমার গায়ে লাগে কিন্তু তোমাকে এভাবে দিনের পর দিচ্ছে ওরা। তাহলে তারা কত মহৎ! এই বুঝানোর নামই উপলব্ধিতে ঘা দেওয়া। যদি শিশু দিতে আগ্রহী হয় তাহলে প্রতিদান হিসেবে শিশুকে আরো বেশী দিন কিংবা অতিরিক্ত অন্য কিছু দিন।
তুচ্ছ এবং বড় সকল অবদানেই আলহামদুলিল্লাহ পড়া ইসলামের নির্দেশ। সর্বত্র আমরা আলহামদুলিল্লাহ বলি কেন? এটা না বললেও আল্লাহর কোন ক্ষতি নেই, জোড় গলায় বললেও আল্লাহর কোন উপকার নেই। উপকার হল নিজের। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ বলেছেন, “যে আমার বান্দার প্রতি কৃতজ্ঞ নয়, সে আমার প্রতিও কৃতজ্ঞ হয় না”। ঘন ঘন আলহামদুলিল্লাহ বলতে হয়ত আমাদের কাছে অপ্রয়োজনীয় মনে হতে পারে। তাহলে একজন শ্বাস কষ্টের রোগীকে প্রশ্ন করুন, একটি পরিপূর্ণ শ্বাস গ্রহণ করতে তাকে কত ধকল সহ্য করতে হয়। একটি পরিপূর্ণ সুমিষ্ট শ্বাসের জন্য সে কতবার বুক ফোলায়, বুকের পিঞ্জর মেলে ধরে, চোখ কোঠর থেকে বেড় করে এবং বড় হা করে বুকে বাতাস ঢুকায়। তারপরও সে বারে বারে ব্যর্থ হয়। এভাবে হাজারো নিঃশ্বাস মিলেও তার একটি পূর্ণ শ্বাস হয়না। তাকে প্রশ্ন করুন, আলহামদুলিল্লাহ বলার কারণে যদি তার সমস্যা দূর হয়, তাহলে দিনে কতবার এই বাক্যটি পড়বে? শতভাগ সুনিশ্চিত থাকুন, সে বলবে প্রতি নিঃশ্বাসেই সে আলহামদুলিল্লাহ বলবে। আমরা ভুক্তভোগী নই বলেই সেই উপলব্ধি-বোধ নাই। বারে বারে কৃতজ্ঞতা প্রকাশে আল্লাহ খুশী হয়, তাকে ক্ষমা করে এবং উত্তম মানুষের কাতারে তার নাম লিপিবদ্ধ করে। উপলব্ধি-বোধ নাই বলেই তো কোটি পতিরা লুণ্ঠন করে। তারা কোনদিন জানবে না কৃতজ্ঞতার উপলব্ধি-বোধ কেমন।
মা-বাবা বড়দের ত্যাগী হতে শিক্ষা দিবেন কিন্তু ছোটদের কৃতজ্ঞ হতে শেখাবেন না এর চেয়ে বড় জুলুম জন্য দ্বিতীয়টি নেই। চাকুরীজীবী বড়বোন বাবা-মায়ের সাথে থাকেন। মেঝ বোন একপাটি পুরানো স্যান্ডেল পড়ে বাপের বাড়ীতে বেড়াতে এসেছে। এটা দেখে বড়বোন তাকে টাকা দিয়ে বলল আগে একজোড়া স্যান্ডেল কিনে নাও তারপর বসো। সর্বদা বড়বোনের পিটে-কোলে বড় হওয়া ছোট বোনের কাছে এ দৃশ্য অসহ্য হল। সে কোন কারণ ছাড়াই বড় বোনের সাথে কথা বলা বন্ধ করে দিল! উপরন্তু প্রতি কথায় ঝাঁজালো আচরণ করে। কয়েক দিনের ঝাঁঝালো সম্পর্ক একদিন পচে-ফেঁপে উঠে এবং ছোট বোন ক্ষিপ্ত হয়ে বলে, তুমি কেমন বড় বোন! তুমি অবিবেচক! তাই তুমি আমার কাছে ঘৃণিত। ওকে স্যান্ডেল কেনার টাকা দিতে পারলে আমি কি দোষ করেছি! তার তো বিয়ে হয়েছে জামাই আছে। তাকে দেবার বহু মানুষ তুমি আমাকে বঞ্চিত করে ওর থলে ভারী করার কারণ কি? কি চক্রান্ত তোমার মাথায় খেলছে?
এই দৃশ্যে উদার বড় বোন হয়ত হাসবে অথবা ছোট বোনের অভিমান ভাঙ্গানোর চেষ্টা করবে। কিন্তু এই বোনটিকে যতই দেওয়া হউক সে আজীবনের জন্য অকৃতজ্ঞই থাকবে। সুযোগ পেলে অতীতের উপকারের কথাকে হেয় করবে, পিন ফুটিয়ে অবজ্ঞা করবে এবং সর্বোপরি সোজাসুজি বলে দিবে। আমার জন্য উপকার করতে তোমাকে কে বলেছে? আমি কি চেয়েছি? না তোমার পায়ে ধরে কান্না করেছি। এ ধরনের চিত্রও আমাদের সমাজে ভরপুর। উদাহরণের জন্য ছোট বোনের উপমা আনা হয়েছে, এক্ষেত্রে ভাই হলে তো কখনও মারতে উঠবে। এই চিত্র তৈরি হয় শুধুমাত্র কৃতজ্ঞতা বোধ শিক্ষা না দেবার কারণেই।
সংসারে বড় ভাই-বোন এমনিতেই ছোটদের প্রতি রহম-শীল হয়। বড়রা যখন বাইরে যাবে কিংবা বাহির থেকে আসবে, তখন শিশুকে পাঠাতে হবে তাদেরকে এগিয়ে গিয়ে আনার জন্য। শিশু হলেও তাদের দিয়ে জুতা, স্যান্ডেল, লুঙ্গি, গামছা আনা নেওয়ানো ও যথোচিত ইজ্জত পাইয়ে দেওয়া মায়েরই দায়িত্ব। ঘরে মা-বাবাকে এই শিক্ষাও দিতে হবে যে, আমরা ছাড়াও বড়দের ইজ্জত করা তোমাদের দায়িত্ব। অধিকার পাইয়ে দেবার ক্ষেত্রে মা যাতে কখনও একপক্ষীয় আচরণ না করে। সম্মান পাইয়ে দেবার ক্ষেত্রে কখনও যাতে অবহেলা না করে। আবার বড়দের প্রতিও নজর রাখতে হবে তারা সম্মান পাওয়া মাত্রই যাতে সেটার মূল্য দেয় এবং ছোটদের আদর দেয়, ধন্যবাদ জানায়। এই জিনিষটার নাম বদান্যতা। একই পিতা-মাতার সন্তান হলেও, সন্তানেরা সবাই একই নয়, সমানও নয়, ভূমিকা ও অবদান একই মাত্রার নয়। তাই পিতা-মাতার উচিত বড় সন্তানদের অবদানের প্রশংসা করা, স্বীকৃতি দেওয়া। ছোটদেরকে বুঝতে দেওয়া এই সংসার শুধু মাতা পিতার নয়, তোমরা যে খাচ্ছ সেখানে বড়দেরও অবদান আছে। তাই ভবিষ্যতে তোমাদেরকেও একই ভাবে অবদান রাখতে হবে। পিতা-মাতার এই চরম সত্য ঘোষণায়, ছোট সন্তানেরা কোনদিন উপেক্ষা করতে পারবেনা।
একদা রাসুল (সাঃ) এর কাছে এক ব্যক্তি এসে বলল ইয়া রাসুলুল্লাহ, কার সাথে আত্মার বন্ধন মজবুত করব। উত্তরে বললেন, তোমার পিতা-মাতার সাথে। তিনি বললেন তারা দুনিয়াতে কেউ বেঁচে নেই। উত্তরে রাসুল (সাঃ) বললেন, তাহলে তোমার সন্তানদের সাথে বন্ধন মজবুত কর। দায়িত্বশীল সুখী পরিবার গড়ে তুলতে এটা কত পরিষ্কার ও দ্যর্থহীন ঘোষণা। সকল ভাই-বোনদের মাঝে আন্তরিকতা, পরস্পর বিশ্বস্ততা, নির্ভরতা ও একাত্মতা সৃষ্টি করে দিতে পারে একমাত্র মা-বাবা। এটা একদিনে সম্ভব নয়, ধীরে ধীরে পদে পদে শিখাতে হয়, অনুশীলন করাতে হয়। সকল দোষ ছোটদের কারণে হয় এমন নয়, চরম স্বার্থপরতা বড়দের মধ্য আছে। ছোটদের অতি সম্মানকে পুঁজি করে বড়দের সুবিধা নিতেও দেখা যায়। তারাও অনেক ঠকায়, ক্ষতি করে। এসব বিষয়ও পিতা-মাতাকে খেয়াল রাখতে হয়। সব কিছুর মূলে হল ধর্মীয় শিক্ষা প্রদান এবং বাস্তবে নিজেরা অনুসরণ ও অন্যকে পালন করার জন্য উৎসাহ সৃষ্টি করা। ধর্মকে যখন পথপ্রদর্শক বানানো হবে তাহলে সেখানে অগণিত পথ নির্দেশ পাওয়া যাবে, য্দ্ধারা মানুষ সঠিক পথের দিশা পাবে।
Discussion about this post