পরিমাণে কম বেশী মিলিয়ে, বেশীর ভাগ শিশুরাই জীবনের শুরুতে দুষ্টামি করে। এটা তাদের বৈশিষ্ট্য গত খাসিয়ত; আবার কিছুটা পরিবেশ ও সমাজ থেকেও প্রাপ্ত। বৈশিষ্ট্য গত দুষ্টামি গুলো শিশু মনের কৌতূহল থেকেই সৃষ্টি হয়। কিছু শিশু ভাবুক প্রকৃতির, তারা শিশুকালে দুষ্টামি করে কম। দেখতে ভদ্র, চুপচাপ, শান্ত হয়ে থাকে। খাদ্য-বস্ত্র নিয়ে তেমন গোলমাল করেনা। সকল পিতা-মাতার কাছে এমন শিশুই কাম্য কিন্তু এদের পালন করা কিছুটা কঠিন। এসব বাচ্চা শিশুকালে পিতা-মাতাকে কম কষ্ট দিলেও, কৈশোরে এদের মতি-গতি বুঝা বড় দায় হয়ে পড়ে। পিতা-মাতা যদি তাদের সঠিক মনোবৃত্তি বুঝতে ভুল করে তাহলে এই শিশু পিতা-মাতার কল্যাণের চেয়ে অকল্যাণ বয়ে আনে। আবার যদি তাদের ভাবুক মনোবৃত্তি বুঝে সঠিক পথ ধরিয়ে দিতে পারে তাহলে এরা পিতামাতার গৌরবের কারণ হয়। যেহেতু এসব শিশু ভাবুক তাই তাদের খোরাক দিতে হয় মনে। অর্থাৎ এরা গল্প, কাহিনী শুনতে পছন্দ করে। বাবা-মা, দাদা-দাদী, নানা-নানীর সঙ্গ পছন্দ করে, কেননা এরা আন্তরিকতার সহিত কোন ঘটনাকে বুঝিয়ে বলে।
এরা গল্প-কাহিনী পছন্দ করলেও পিতা-মাতাকে অনুসরণের ক্ষেত্রে অগ্রগামী হয় না! ধরুন, ব্যবসায়ী পিতার ব্যবসায়ে তার মন নাও থাকতে পারে। তারা তাদের চিন্তার রাজ্যে কেন্দ্রীয় চরিত্রকেই প্রাধান্য দেয় বেশী। এদের মাথায় যে চরিত্র প্রভাব বিস্তার করে বেশী, সেটাকে তারা অক্টোপাসের মত আঁকড়ে ধরে এবং সফল হবার জন্য কঠোর চেষ্টা সাধনা করে। এসব শিশু ব্যবসায়ের চেয়ে চাকুরীর ক্ষেত্র বুৎপত্তি অর্জন করতে পারে বেশী। কেউ তাকে চিন্তার জন্য মাল মসল্লা যোগাড় করে দিলে, সে এটাকে যথাযথ কাজে লাগাতে পারে।
সন্তানের এই মৌল চরিত্র বুঝা ও সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে না পারাই হল পিতা-মাতার ব্যর্থতা। কেননা তাদের মন মগজ বুঝে ব্যবস্থা নিয়ে পারলে তাদের যেভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যায় সেভাবে তারা একবার অনিয়ন্ত্রিত হয়ে পড়লে, সারা জীবনেও তাদের আর ফেরানো যায় না। অনিয়ন্ত্রিত জীবন মানেই সন্তান গোঁয়ার হওয়া; আর গোয়ারের অন্যতম স্বভাব-চরিত্র হল, “সে সকল বস্তুর মাত্র একটি দিক দেখে, দুটো দিক দেখার যোগ্যতা হারায়”।
অন্য শিশুরা খাদ্যের প্রতি আগ্রহী হয়। পোশাক, বড়দের ব্যবহার্য জিনিষ পত্র ব্যবহারে অতি কৌতূহলী হতে দেয়া যায়। বড়দের প্রতি তাদের আগ্রহ প্রবল। দৌড়াদৌড়ি, খেলাধুলা, এটা ওঠা ধরা, বড়দের জোতা-চশমা পরিধান করা। এদের নিত্য খাসিয়তের অন্যতম। তারা এটা-ওটা ধরে, বড়দের কাজের বিঘ্ন ঘটায়! এটা দ্বারা বুঝাতে চায়, তারাও ওসব কাজ করতে পারে। সকল প্রকার কাজে কম-বেশী আগ্রহ থাকে। সকল কাজে অংশগ্রহণ করতে চায়। যখন কোন কিছু অঘটন ঘটে, তখন নিজের কারণে নয় বরং তার বন্ধুর কারণে এটা ঘটেছে বলে সামনা-সামনে বদনাম তুলে দেয়। তারা ভাবে সে তো কোন ভুল কাজে হাত লাগায়নি, যেহেতু ভুল একটা হয়েছেই, তাহলে সেটা অন্যের কারণেই হয়েছে। বড় হলেও এরা পরিণতি এড়াতে চাইবে।
এরা বৈষয়িক হয়। দুনিয়া দারী ভালই বুঝে। এরা বড় চতুর হয়, অর্থকড়ি কামানোর জন্য এরা সর্বদা ভাবতে থাকে। এদের জ্ঞান অর্জনের একটাই, দুনিয়ার খ্যাতি ও বৈষয়িক উন্নতি। এদের মধ্যে অনেক সন্তান এতটুক সুচতুর হয়ে গড়ে উঠতে পারে, যারা পিতার একটি কামার শালা পেলে সেটাকে শিল্পকারখানায় রূপ দিতে পারে। অর্থাৎ ওরা উপরে উঠার সিঁড়িটা দেখতে পেলেই, সেটা তরতর করে উঠার দায়িত্ব নিজেই নিয়ে নিবে। এরা কল্যাণকামী মনস্ক হলে, এদের হাতে অনেক বড় উপকার সাধিত হয়। হিংসুটে হলেও, দৃষ্টান্ত স্থাপন কারী হয়। এরা চাকুরীর চেয়ে ব্যবসায়ে অনেক ভাল করে। আবার চাকুরী থাকলেও সাথে সাথে ব্যবসা করার মত সময় বাঁচিয়ে নেয়।
ঘটনাচক্রে দুষ্ট বন্ধু সাথে জুটলে, উপরের দু;প্রকার শিশুদের মাঝে অনৈতিক পরিবর্তন দেখা দিতে পারে। তাদের কাছে বাছ-বিচারের বুদ্ধি কম, পরিণতি সম্পর্কে ধারণা থাকেনা। ফলে দুষ্ট বন্ধুদের নিত্য নতুন উপাদান গুলোকে অন্যরা সহজে গ্রহণ করে আনন্দ পায়। শিশুরা ঘটনা থেকে শিখে, সেটাকে মনে রাখে, ভিতরে ভিতরে উপভোগ করে। যার ঘরে কাছাকাছি বয়সের দু’টি কিংবা তিনটি শিশু আছে তিনি এই ব্যাপারটি হাঁড়ে হাঁড়ে উপলব্ধি করে। যেমন দ্বিতীয় শিশুর দুষ্টামি প্রথম শিশুরে চেয়ে বেশী হবে এবং তা ভিন্ন মাত্রিক। দ্বিতীয় শিশু তার নিজের দুষ্টামি ও বড়টা থেকে প্রাপ্ত দুষ্টামির সংমিশ্রণের নতুন আইটেম তৈরি করে। সেভাবে তৃতীয় শিশু, ছোট হওয়া সত্ত্বেও সে এমন কাজ করবে বড় দুটো সন্তান তো বটেই কখনও বাবা-মা ও চিন্তায় পড়ে যায়, এটা একেবারে পিচ্চি কিন্তু বুদ্ধি-ভিত্তিক দুষ্টামিতে মরিচের মত ঝাল হল কিভাবে! বুদ্ধি ভিত্তিক এ কারণেই বলা হয়, সে নিশ্চিত জানে উপরের কাউকে বল প্রয়োগে কাজ হবেনা, তাদের ঘায়েল করতে হবে বলের সাথে বুদ্ধির মিশ্রণ ঘটিয়ে। ঠিক এই ব্যাপারটি আরো বেশী প্রবল হয় যখন বাহিরে তার অনেক গুলো অসৎ বন্ধু জুটে।
সন্তানের চরিত্র বুঝে পিতা-মাতাকে উদারতা ও দানশীলতা শিক্ষা দিতে হয়। যদি এই কাজে পিতা-মাতা ব্যর্থ হয় তাহলে সে সন্তানের অনেক অর্থ সম্পদ হবার পরেও পিতা-মাতাকে নিয়ে ভোগ করার মানসিকতা সৃষ্টি হবে না। সে শুধু সম্পদ সঞ্চয় করতে চাইবে কিন্তু দান করতে শিখবে না। দান করার ব্যাপারটি ধর্মীয় মূল্যবোধের সাথে জড়িত। পিতা-মাতা ধার্মিক ও উদার না হলে তাদের সন্তানও এই কাজ করার প্রাকটিস পায়না। ফলে তারা সম্পদ ভোগ করার হকদার হতে, মাতা-পিতাকে আগে বঞ্চিত করে, নিজেরা জমায়। একই পরিণতিতে অতঃপর নিজেও বঞ্চিত হয়।
অনেক পিতা-মাতা এভাবে বলে থাকে যে, আমার বাচ্চাটি নষ্ট হয়ে গেল ঐ বাচ্চার কারণে। এটা হল পিতা-মাতার অসহায়ত্ব প্রকাশ কিংবা অযোগ্যতা স্বীকার করা। মূলত সন্তান নষ্ট হয় পিতা-মাতার কারণেই। অন্য কারো জন্য নয়। পিতা-মাতাই যদি সন্তানের বন্ধু হয়ে যায়, তাহলে কোন সন্তানই বাহিরের বন্ধুর দ্বারা প্রভাবিত হতে পারে না। এই অপরাধের কারণে, হাশরের ময়দানে প্রতিটি শিশুই তার পিতা-মাতাকে সমান তালে দোষী বানাতে থাকবে। তারা পিতা-মাতার প্রতি এতটাই আক্রোশে ফেটে পড়বে! জাহান্নামের ফেরেশতাদের হাত থেকে পিতা-মাতাকে কেড়ে নিয়ে জাহান্নামে নিক্ষেপ করতে চাইবে। শিশুদের জীবন হল নরম মোলায়েম কাদার মত। যেভাবে ইচ্ছা এসব কাদায় আকৃতি দেয়া যায়। যা দিয়ে হাড়ি, পাতিল, থালা, পাত্র যা ইচ্ছা বানানো যায় কিন্তু একবার পুড়িয়ে শক্ত করা হলে আর কোন আকার দেওয়া যায়না। আকার দিতে গিলে বরং সেটা ভেঙ্গে একাকার হয়ে যায়।
সচেতন পাঠক ওপরে যত কথাই বলা হয়, তার একটার সাথেও স্কুল, কলেজ, মক্তব, মাদ্রাসার কোন সম্পর্ক নাই। এটা গড়ে দেওয়া কোন প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব নয়। সবটাই পরিবার, সমাজ, পিতা-মাতার সাথেই সম্পর্কিত। এই কাজে ভূমিকা রাখতে পারে পিতা-মাতা, দাদা-দাদী, চাচা-চাচী অর্থাৎ যারা সার্বক্ষণিক সাথে থাকে, তারাই। আর এই কাজটা করার সময় খুব সীমাবদ্ধ। শূন্য থেকে সাত এবং সাত থেকে বার বছরের মধ্য। এর পরে সন্তানকে পৃথিবীর বৃহত্তম বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকিয়ে দিলেও, শতভাগ সুফল পাওয়া যেমন কঠিন, শতভাগ সফলতা পাওয়া ততোধিক দূরহ। আল্লাহ যদি নিতান্ত মেহেরবানী করে কাউকে দয়া করেন সেটা ভিন্ন কথা। তাই সকল অভিভাবকদের উচিত সাত বছর পর্যন্ত শিশুদের ভাল কথা বলানো ও সুন্দর কাজ শিখানো উচিত। সাত থেকে বার বছরের মধ্যে সুন্দর ও সৎ কাজের প্রশিক্ষণ দেওয়া এবং এসব আদায়ে বন্ধু-সুলভ শাসনের ব্যবস্থা করা।
Discussion about this post