অনেক গুণী বাবা-মা, যারা সর্বত্র ইজ্জত-সম্মান পাবার যোগ্য। তারা কদাচিৎ বন্ধু মহল ও আত্মীয়দের নিকট থেকে উপেক্ষিত হন, শুধুমাত্র নিজের সন্তানের কারণেই। অনেক সময় এ ধরনের অভিভাবকদের এড়িয়ে চলা হয়। কিন্তু তারা বুঝতে পারেন না, কেন তারা উপেক্ষিত হচ্ছেন! হয়ত কল্পনাতেও ভাবেন নি যে, তাদের সন্তানের আচরণই এর পিছনে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছে। মূল বিষয়ে যাবার আগে কয়েকটি অসঙ্গতি দেখে আসি।
১.
প্রতিষ্ঠানের সবচেয়ে বড় কর্তার গৃহিণী, ছুটির দিনে, স্বামীর অধীনস্থ ও শুভাকাঙ্ক্ষীদের দাওয়াত দেন, তারই মহলে। দাওয়াত পত্রে একটি নোট উল্লেখ থাকে যে, শুধুমাত্র স্বামী-স্ত্রীর দাওয়াত। কোন সন্তান সাথে আনা যাবেনা! এ ধরনের কিম্ভুতকিমাকার দাওয়াতেও অংশ গ্রহণ করার জন্য কর্তা-ব্যক্তিদের আগ্রহের ঘাটতি দেখা গেলনা। তাদের মধ্যে ছোটাছুটি শুরু হল। সর্বোচ্চ কর্তার ঘরে দাওয়াতের ব্যাপার বলে কথা! তাদের মধ্যে আগ্রহী এক পরিবারের সাথে বেজায় ঘনিষ্ঠতা আছে আমারই পাশের ঘরের বাসিন্দার সাথে। ওদের দু’টো সন্তানকে রেখে যাওয়া হবে তাদেরই ঘরে। অনুরোধে ঢেঁকি গেলার পালা! দাওয়াতের দিন, এই দুই সন্তানের কাজকর্মে প্রতিবেশীর তো বেহুশ হবার দশা! উল্টো পাশের প্রতিবেশীদেরও জান যাবার দশা। ঘর সাজানো জিনিষ পত্র যাই ভাঙ্গলো, তাতেও তাদের আক্ষেপ থাকত না, যদি এসব দুষ্ট সন্তানের পিতা-মাতারা ব্যাপারটি উপলব্ধি করত। ঘটনা শুনে মাতা এতটুকুই শাসন করল, “তোমাদের আর কোথাও রেখে যাব না যদি ভবিষ্যতে যদি এ কাজ আবার করো”। তার মানে, এ ধরনের কাজ ভবিষ্যতে কোথাও আরো একবার ঘটলে তাহলে শাস্তির সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে এবং ফল স্বরূপ আর বাহিরে নেওয়া হবেনা! পরে বুঝলাম, বসের স্ত্রীর হয়ত এ ব্যাপারে তিক্ত অভিজ্ঞতা আছে, তাই বাচ্চা বিহীন দাওয়াতের আয়োজন।
২.
ছিল খানার দাওয়াত। পৌঁছে দেখা গেল, খানার সাথে ওয়াজ নসিহতের ব্যবস্থাও আছে। অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা দাওয়াতে এসেছে। মজলিসে টুকুটুকে আদুরে একটি ছোট্ট খুকিকে বসে থাকতে দেখা গেল। কিছুক্ষণ পরেই শিশুটি মজলিসে উপস্থিত দুটো ছেলেকে লক্ষ্য করে এটা ওটা ছুড়তে থাকল। ছুড়তে গিয়ে, তার হাতে জিনিষের অভাব দেখা গেল। ফলে অন্দরে গিয়ে দাবা খেলার গুটি নিয়ে আসল। পুনরায় নিক্ষিপ্ত হতে থাকল ওসব। পরে জানা গেল ওরা সব ভাই-বোন। এই মজলিসে তার আরো বড় দুই ভাই চুপটি মেরে বসে আসে। মেয়েটি আদর পেতে পেতে এতটুকু বেয়াড়া হয়েছে যে। কথা মানবে না ভয়ে, ঐ ভাইয়েরা নিজেদের মুখ লুকিয়ে বসে আছে। কোন দায়-দায়িত্ব নিচ্ছে না। মানুষ হুজুরের ওয়াজ শুনবে কি! এই শিশুটির দৌড়া-দৌড়ী করতে দেবার জন্য রাস্তা বানাতেই ব্যস্ত। এই মাহফিলে একজন মানুষকে দেখা গেল খুব মনোযোগের সহিত হুজুরের তাজকেরাতুল আউলিয়া (বিভিন্ন ওলী-আউলিয়াদের ঘটনা মূলক বই) কিতাবের ঘটনা মিশানো নসিহত শুনছেন! অথচ তিনিও নাকি বাংলাদেশের একজন সেরা আলেম এবং সৌদি আরবের একটি বিখ্যাত ভার্সিটি থেকে সর্বোচ্চ ডিগ্রীধারী। বহু ভাষায় পাণ্ডিত্য আছে বলে সরকারী অনুবাদ কর্মকর্তা হিসেবে ভাল বেতনে যোগ দিয়েছেন। আর সেই তিনি একাগ্র চিন্তে মন দিয়ে শুনছেন তাজকেরাতুল আউলিয়ার ঘটনা। কৌতূহলে এই স্রোতার পরিচয় সম্পর্কে জানতে চেয়ে যা জানলাম তাতে মাথায় আসমান ভেঙ্গে পড়ল! তিনি হলেন, এই শিশুটির পিতা! তিনি বহু ভাষার মানুষের কথা অনুবাদ করায় পারদর্শী কিন্তু পাশের ত্যক্ত বিরক্ত মানুষের মনের ভাষা বুঝতে অক্ষম! উপস্থিত মানুষের অভিব্যক্তির কথা আর নাই বা বললাম। তবে যিনি দাওয়াত দিয়েছেন তিনি বললেন, “আমিতো জানিনা কার বাচ্চা কেমন? পিতার সুনাম সুখ্যাতি তো ভালই কিন্তু কার বাচ্চা কেমন সেটা কিভাবে বুঝব”। মূলত ভদ্রলোক তার শিশুর আচরণে ভিতরে ভিতরে কষ্ট পাচ্ছিলেন কিন্তু কি ব্যবস্থা নিবেন, সেটা না জানার কারণে, অতি বিদ্বান হয়েও আরেক অল্পশিক্ষিত ব্যক্তির ওয়াজ শোনার ভান করছিলেন মাত্র।
৩.
এটা সামগ্রিক ভাবে প্রায় সর্বত্রই দেখা যায় যে, বাবা মায়ের উপস্থিতিতে শিশুরা দুষ্টামি করছে। সকল শিশুই দুষ্টামি করলেও উপস্থিত বড় কিংবা বুদ্ধিমান শিশুর উপরে প্রায়শই দোষ এসে পড়ে। তারপরও তো তারা শিশু। পরিণতি, পরিণাম সম্পর্কে তাদের ধারণা তেমন একটা থাকেনা। কিছু শিশু বেড়াতে গেলে দুষ্টামির মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। কিছু শিশু স্বাধীনতা পেলেই বেয়াড়া আচরণ করে। কিছু শিশু সেখানে উপস্থিত তার পরিচিত কাউকে পেলে অবাধ্য হতে চায়। আবার কিছু শিশু পরিচিত কেউ না থাকলে বেজায় খুশী হয়ে ইচ্ছামত দুষ্টামি করে। যাদের ঘরে মেহমান হয়ে যায়, তাদের কষ্টই বেশী হয়। দাওয়াত দিয়ে তারাই বেশী পেরেশানিতে থাকে। বলতেও কষ্টকর আবার সইতেও যন্ত্রণাদায়ক। তবে কার শিশু কেমন, সেটা তাদের পিতা-মাতা তো ভালই জানে। তাই তাদেরকে আগে থেকেই এ ব্যাপারে সতর্ক থাকা উচিত।
অনেক পিতা-মাতাকে দেখা যায় তারা কোনটাই না বলে নীরব থাকে। তাদের ভাবখানা এমন যে, সকল শিশুদের সাথে আমারটাও যোগ দিয়েছে। দোষ কি শুধু আমার সন্তানের একার! মূলত এক্ষেত্রে কিছু মানুষ দ্বিমুখী সমস্যায় পড়ে। শিশুকে শাসন করলে সেটা আরো বেয়াড়া হয়ে উঠে। ভয়ানক কান্নাকে অস্ত্র বানিয়ে, বিশ্রী পরিবেশ সৃষ্টি করে। এটা পিতা-মাতার অতীত ভুল শাসনের কারণেই হয়। ফলে শিশু বাবা-মাকে ব্ল্যাক মেইলের সুযোগ নেয়। যেমনটি আমরা উপরে পিতার ক্ষেত্রে দেখেছি। আবার, কিছু মা আছে, যারা শিশুকে শাসন বরদাস্ত করেনা। এক্ষেত্রে পিতাও যদি একটি থাপ্পড় দেয়, তাহলেও মা অগ্নিশর্মা হয়ে উঠে, ঘরে জ্বলবে আগুন। এ ঝামেলা এড়াতে, ইচ্ছা ও সুযোগ থাকা স্বত্বেও বাবা নিজ শিশুকে শাসন করেনা। কেননা বাহিরের আগুনের চেয়ে ঘরের আগুন ক্ষতিকর। আবার এমন পিতাকেও দেখেছি, যিনি কোন অবস্থাতেই তার স্ত্রীকে শিশু সন্তান শাসন করার অধিকার দিতে চান না! এক পরিবারে হর হামেশা ঝগড়া লেগে থাকত এই কারণেই যে, মা শিশুকে থাপ্পড় মেরেছে।
পরিবেশ পরিস্থিতি যাই হোক, সন্তানের এমন আচরণে অন্যজনে বিরক্ত-বোধ করে। কেউ নিজেদের অনিরাপদ ভাবে। অন্যের সন্তান বলে হয়ত নিজ থেকে কিছু বলেনা কিন্তু অসহ্যকর উপদ্রবের কারণে সামনের দিন গুলোতে এই মানুষের সাহচর্য এড়িয়ে চলতে বাধ্য হয়। মূলত এটাই হয়ে থাকে। পরবর্তীতে তারা অবাধ্য সন্তানের মাতা-পিতা হিসেবে চিত্রিত হয়ে পড়ে। যা সন্তানের পরবর্তী সময়ের জন্য স্থায়ী বদনাম হিসেবে রয়ে যায়। এই পরিস্থিতি এড়াতে বাবা-মা যদি একটু সতর্ক হয় তাহলে তারা মানুষের আন্তরিকতা ধরে রাখতে পারে।
সবার শিশুই কম-বেশী দুষ্টামি করে। এটা সবাই জানে, সবাই মানে কিন্তু মানুষ অসন্তুষ্ট হয় শিশুদের কারণে নয়। বরং মানুষ অসন্তুষ্ট হয় তাদের পিতা-মাতার উপেক্ষা করার নীতি দেখে। না দেখার ভান করা কিংবা কোন ভূমিকা না রাখার কারণে মানুষ তাদের প্রতি অ-শ্রদ্ধাশীল হয়। তাই দুষ্ট বাচ্চাকে সংযত করতে না পারলেও পিতা-মাতা যাতে এমন ভূমিকা রাখে যে, তার সন্তানের এসব দুষ্টামি তাদের নজরের বাহিরে নয়। একটু বকা দেওয়া, ধমক দেখানো, কান মলা দেওয়া, নিজের পাশে বসিয়ে রাখার মত অনেক সহজ সাধ্য শাস্তির ব্যবস্থা নিতে পারে। এসব শাস্তিতে বেয়াড়া শিশুকে দমানো যায়না কিন্তু তৃতীয় পক্ষের যারা এসব অবলোকন করছে, তারা আশাবাদী হয়। তার বুঝতে পারে, স্বীয় বাচ্চার এসব অসংগতিকে পিতা-মাতা আমলে নিচ্ছে, এমন দেখতে পেলে তারা সম্মানিত হবেন।
এই অভ্যাস রোধে বাচ্চাদের কখনও পিতা-মাতার সাথে বড়দের অনুষ্ঠানে নিয়ে যেতে হবে। উদাহরণ হিসেবে মসজিদ, ওয়াজ মাহফিল কিংবা সভা-সেমিনারের কথা বলা যায়। এখানে শিশুরা বন্ধু-বিহীন অবস্থায় বড়দের সাথে দীর্ঘক্ষণ ধৈর্যের সাথে চুপচাপ বসে থাকার অনুশীলনের সুযোগ পায়। শিশুদের কাছে ধৈর্যের অভ্যাস গড়ে উঠলে, উপরের যে কোন পরিস্থিতিতে তাদেরকে সাথে রাখা সহজ হয়। একটি ধৈর্যশীল শিশু, হাজারো শিশুর চেয়ে উত্তম। এটার জন্য অনুশীলন করাতে হয় এবং এটা করানো মা-বাবা, দাদা-দাদীর দায়িত্ব। আর মানব জীবনে ধৈর্যের উপরে কোন সম্পদ নাই। যে ধৈর্যশীল সে সর্বত্র বিজয়ী।
Discussion about this post