সুখ মানব জীবনের সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত ছোট অক্ষরের একটি শব্দ হলেও এর বিশেষত্ব অনেক। আবাল, বৃদ্ধ, বালক, বনিতা সবাই এর সান্নিধ্য পেতে চায়।
সুখের ধারণা
সুখ’কে ঘিরেই আবর্তিত মানবজীবনের সব কার্যক্রম। দুঃখের বিপরীত সবটাই সুখ। কাউকে হাঁসতে দেখলে, দামী কাপড় পড়তে দেখলে, দামী বাজার কিংবা বাহারি অলংকার পড়তে দেখলে মানুষ থাকে সুখী ভাবে। সুন্দর বাড়ী ওয়ালাকেও অনেকে সুখী মানুষ মনে করে।
শাব্দিক প্রয়োগে সুখী মানুষের ধরনও কিন্তু বের করা যায়। দেখুন না সুখানান্দ, সুখের দিন, সুখের সময়, সুখবার্তা, সুখকর, সুখজনক, সুখশয্যা, সুখ-শান্তি, সুখস্পর্শ, সুখস্মৃতি, সুখস্বপ্ন, সুখালাপ আরো কত কি লিখেই শেষ করা যাবেনা, সব কি সুখের প্রতিশব্দ হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে না?
তবে যে সুখকে নিয়ে এত মাতামাতি তার দেখা কি এ পর্যন্ত কেউ পেয়েছে? সুখ দেখতে কেমন? দৃশ্যমান নাকি অদৃশ্যমান একথা বলা মুশকিল। তবে সুখের অনেক রকমফের রয়েছে।
সুখের প্রকারভেদ
সুখ একেক জনের কাছে একেক রকম। অনেকের নিকট তা গানের ভাষায় ধরা দেয় যেমন “তারে আমি চোখে দেখিনি, তার অনেক গল্প শুনেছি। তার গল্প শুনে তাকে আমি অল্প অল্প ভালবেসেছি”। বিভিন্ন চিন্তা ও রুচির মানুষ অনেক কিছুর ভিতরে সুখের সন্ধান করে।
ঘুষ দাতা ঘুষ দিয়ে ও গ্রহীতা ঘুষ নিয়ে, সুদ দাতা সুদ দিয়ে ও গ্রহীতা সুদ নিয়ে, বিয়েতে যৌতুক কেউ নিয়ে, কেউ দিয়ে সুখী হতে চায়। বিলাস বহুল ভবন তৈরিতে প্রচুর শ্রমিক হাড় খাটুনি শ্রম দেয় একটু সুখের আশায়, আবার বিত্তশালীরা সুখনিদ্রা পাবার উদ্দেশ্যে প্রচুর টাকা তাতে খরচও করেন।
আরো সুখের তাগিদে আমেরিকার টুইন টাওয়ারের মত কখনও আবার তা ধ্বংস করাও হয়! পৃথিবীর মানুষকে আরো সুখী ও নিরাপদ করার নিমিত্তে বিশ্বশক্তি ইরাক ও আফগানে কি জঘন্য ও বীভৎস হত্যাকাণ্ডেই না মেতে উঠল! শুধুমাত্র সুখের আশায়!
বস্তুত সুখ বলতে মানুষের নিকট যা বুঝায় তা হল, যার নিকট যে জিনিসের অভাব, তার জন্য সে অভাব পূরণ হওয়া মানেই সুখ, এতে অন্যের কি হল না হল তা না ভাবাটাই এখানে মুখ্য।
আদিকাল থেকে মানুষ সুখের পিছনে অবিরত ঘুরে ফিরছে। গ্রীক বীর আলেকজান্ডার পুরো ইউরোপ বিজয় করে পূর্বের দিকে নজর দেন এবং দেশের পর দেশ জয় করতে করতে কারাকোরাম পর্বতমালার সামনে এসে থমকে দাঁড়ান।
মেঘেরও উপরে উঁকি দেওয়া পর্বতমালার সারি দেখে মনে করেন এটা হয়ত পৃথিবীর দেওয়াল হবে। ওদিকে সম্ভবত আর কোন দেশের অস্তিত্ব নেই। তাই বিধাতালার নিকট প্রার্থনা করেন, তুমি আমার ইজ্জতকে খর্ব করলে?
পৃথিবীতে আর একটি দেশ তুমি কেন অক্ষত রাখলে না যা আমি জয় করতে পারতাম? এই দুঃখ ও হতাশায় তিনি মুষড়ে পড়েছিলেন।
অল্প বয়সে মারা যাওয়া এই বীর জানতে পারলেন না যে, তিনি পৃথিবীর একটি সামান্য অংশ দখল করেছেন মাত্র? দৃশ্যত এত অর্জনেও তিনি সুখী হতে পারেন নি!
ইতিহাসে এই কথার কোন প্রমান না থাকলেও, লোকমুখে এটি একটি প্রবাদ বাক্যের মত ঘটনা।
সুখের অন্বেষণে সামাজিক সমস্যা
সুখের অন্বেষণে মানুষ হন্যে হয়ে ঘুরেও দুঃখে মারা পড়েছে অনেক মানুষ। কেউ অর্থনৈতিক অনটনের জন্য, কেউ বখাটে সন্তানের জন্য, কেউ খারাপ প্রতিবেশীর জন্য, কেউ সম্মানহানি ভয়ে, কেউবা অপরের সুখ সহ্য করতে না পেরে নিজেই নিজের জন্য দুঃখ বেয়ে বেড়াচ্ছেন।
অভাব বাড়ার সাথে সাথে সুখের অভাব তীব্রতর হচ্ছে, সব যেন এক সুতায় গাঁথা। কেউ সুখে আছেন কিন্তু পারিপার্শ্বিক কারণে সুখ ধরে রাখাটা দুষ্কর হয়ে উঠেছে।
দুপুরে খেয়ে দেয়ে শরীরটা একটু এলিয়ে দিলেন, পাশের বাসার ছেলেটি হাই ভলূমে প্লেয়ার বাজিয়ে দিল, এতে আপনার বিশ্রামের বারটা বাজল, প্রতিবেশী সম্পর্কে খারাপ ধারনার অবতারণা হল।
জানালার পাশে আসন্ন পরীক্ষার্থী সন্তান মনোযোগ সহকারে পড়তে বসেছে, এমন সময় পাশের বাসার ধাঙড়ী মেয়েটা দৃষ্টিকটু, আপত্তিকর পোশাকে কড়িডোরে হাঁটাহাঁটি শুরু করল।
এই অবস্থায় কারো কিছু করার নেই, হয়ত ছেলের জন্য চুঙ্গা চশমা সংগ্রহ করতে হবে নয়ত রান্না ঘরে বসিয়ে পড়াতে হবে!
তবে চশমা কোম্পানি গুলো চুঙ্গা চশমা বানিয়ে ইতিপূর্বে ব্যবসায় লোকসান দিলেও এখন তাদের আবার সে সময় ফিরে এসেছে আধুনিকতার কল্যাণে। দাবী চশমা কোম্পানির, এ চশমায় শুধু চুঙ্গা বরাবর সামনে যা আছে তাই দেখবে সুতরাং পড়ার বইতে দৃষ্টি দেওয়ার জন্য এটা একটা ভাল মাধ্যম বটে।
এখানে শেষ নয়, এমতাবস্থায় যদি রাস্তা থেকে বিশ্রী সুরে আপত্তিকর উক্তিতে গান কিংবা টিজ আপনার আদরের মেয়েটির উদ্দেশ্যে ভেসে আসে? আর জায়গাটি যদি হয় বাজারের পার্শ্বে?
এক্ষেত্রে শব্দ নিয়ন্ত্রণের কোন যন্ত্র আবিষ্কার না হওয়াতে, কানে এম, প্রি, থ্রি প্লেয়ার লাগিয়ে নিজের পছন্দসই গান শুনে এ পরিবেশে থাকতে হবে নতুবা এই রোডে, ওই গলিতে বাসা বদলাতে বদলাতে জীবন শেষ করতে হবে। এক্ষেত্রে সব কিছু থাকার পরও সুখী হওয়াটা কঠিন হয়।
অনেক দিন-মজুর কিংবা রিক্সা ওয়ালা সারাদিন হাড় ভাঙ্গা পরিশ্রম করে যেভাবে সুখের ঘুম দিতে পারে, তা পারেনা একজন বিত্তশালী ব্যক্তি। তাদের প্রতিটি রাতের একটি মূল্যবান ঘুমের জন্য ডাক্তারের শরণাপন্ন হতে হয়।
দেখা যায় ঔষধ কোম্পানি গুলো ঘুমের বড়ি বানিয়ে শেষ করতে পারছেন না, সীমান্তে বিজিবি দিন-রাত চেষ্টা করেও ফেনসিডিল সরবরাহ বন্ধ রাখতে পারছেনা! এগুলো সরবরাহ হচ্ছে বিত্তশালী বলুন সন্ত্রাসী বলুন তাদের সকলের একটু সুখের ঘুমের জন্যই।
সুখী রোগীর প্রকারভেদ
বেশী সুখে অভ্যস্ত এমন সুখী রোগীও দুনিয়াতে কম নয়! বিশ্বাস হয়না? ডাক্তারেরা এই সব রোগীকে সহজে চিনে ফেলেন। একটু মাথা খাটালে সুখী রোগী কারা, তা যে কেউ বের করে ফেলতে পারে।
তারপরও খুলে বলি, যে সমস্ত রোগীর গ্যাষ্ঠিক, ডায়াবেটিস, ব্লাড প্রেশার জাতীয় রোগ আছে, তারা হল সুখী রোগী! ডাক্তারও বুঝে নেন পয়সা-কড়ি মোটামুটি আছে, ভালই মাছ-গোশত, ডিম-দুধ খেতে পারে।
এই ফাঁকে ডাক্তারও এই টেস্ট ওই টেস্ট চালাতে চালাতে পায়ের নলার পানি শুকানোর কাজটা সেরে নেন (সব ডাক্তার কিন্তু এমন নন)। দেখে থাকবেন হাসপাতালের নার্সেরা এই জাতীয় রোগীদের সেবার জন্য বেশী আগ্রহ দেখান।
অসুখী রোগী চিনার উপায়
ব্যক্তি জীবনে অসুখী রোগীও আছে? অনেকেই হয়ত চিনে ফেলেছেন। তারপরও বলা দরকার, যারা ম্যালেরিয়া, টাইফয়েড, কলেরা, কাশি জাতীয় রোগে ভুগছেন, তারা সবাই অসুখী রোগী!
এদের নিয়ে ডাক্তার-নার্সদের তেমন একটা আগ্রহ থাকেনা। রোগীর প্রতি ডাক্তারের ভাবখানা এমন থাকে, জলদি কাহিনী বলতে থাকেন, ঔষধের নামটা লিখে দিই।
এক্ষেত্রে ডাক্তার রোগের কথা বুঝলেও, রোগীর মনের কথা বুঝেন না! এক অসুখী রোগী ডাক্তারের শরণাপন্ন হলে ডাক্তার বললেন, ধরন দেখে মনে হচ্ছে টাইফয়েড হয়েছে, তো আপনার পায়খানাটা কেমন?
‘রোগী বললেন ডাক্তার সাহেব টাকা পয়সা কামাতে পারিনি, কি বলব লজ্জার কথা আমার পায়খানাটা বাঁশের’!
এই সুখকে নিয়ে সুখের কথাও আছে। মনোবিজ্ঞানীরা বলেন চাহিদা বাড়ার কারণে মানুষের অভাব বেড়েছে তাই সুখের ও অকাল পড়েছে। পাহাড়ি মানুষেরা বেশী সুখী কারণ তাদের জীবনযাত্রা একেবারেই সহজলভ্য।
পেট্রোলের দুনিয়ায় তাদের না আসলেও চলে, কোন ব্যাংক একাউন্ট লাগেনা, বাঁশের কঞ্চির ভেতর ছিদ্র করে পয়সা জমিয়ে ব্যাংকের কাজ তারা চালিয়ে যাচ্ছে সে আদিকাল থেকেই।
গ্রামের মানুষ তাদের চাইতে অপেক্ষাকৃত কম সুখী, উপজেলার মানুষ আরেকটু কম, জিলা শহরের মানুষ আরো কম আর রাজধানীর মানুষের সুখের হিসাব করতে চাইলে আড়ি পাতা ব্যতীত কোন উপায় থাকবে না।
দেশের সকল ছিঁচকে চোর, মুরগী চোর, সিঁদেল চোর, লাকড়ি চোর মিলে সিন্ডিকেটের মাধ্যমে একশত বৎসরে যা চুরি করতে পারেনা, রাজধানীতে বসবাস রত রাজনৈতিক এক নেতা এক মাসের কম সময়ে তার চাইতে অনেক গুণ বেশী চুরি করতে পারে। আর এত বড় চৌর্যবৃত্তি করে শুধু সন্তানকদের ভবিষ্যৎ জীবনের সুখের আশায়!
কেউ বলে থাকেন সংসার সুখের হয় রমণীর গুণে। এ কথাটা কিয়দংশ ঠিক তবে সম্পূর্ণ সুখ এর মাধ্যমে অর্জিত হয়না।
রমণীর সকল গুণ থাকা স্বত্বেও যদি স্বামী গুণ সম্পন্ন না হয়, বা রমণীর গুণের মূল্যায়ন করতে না জানে তাহলে সুখের সুবাতাস আর সে সংসারে, ইহ জনমেও আসবে না।
তারপরও সুখের সংসারের জন্য নারীর ভূমিকা সবচাইতে বেশী তা অস্বীকার করার সুযোগ নেই। শত শত বৎসর ধরে বাংলার প্রায় প্রতিটি ঘরে একটি কবিতা শোভা পেত তাহলো:
“পরিশ্রমে ধন আনে পুণ্যে আনে সুখ, আলস্যে দরিদ্রতা আনে পাপে আনে দুঃখ”
কবির নাম মশহুর না হলেও তাঁর এই ছোট্ট কবিতায় একটি মহাকাব্যের পরিমাণ জ্ঞান রয়েছে। ছোট্ট কবিতায় তিনি অঙ্কন করেছেন কিভাবে সুখ পাওয়া যাবে।
মানুষ সামান্য সুখের জন্য অন্যের অর্থ আত্মসাৎ করে, রাষ্ট্রের তথা জনগণের সম্পদ কুক্ষিগত করে, প্রয়োজনে মানুষ হত্যা করে। এভাবে কেউ কোন কালে সুখী হয়েছে কিনা শোনা যায়নি।
কারণ সুখ এবং সম্পদ দুটি সম্পূর্ণ আলাদা জিনিস, ঠিক রেল লাইনের দুটি স্লিপারের মত। সম্পদে কখনও সুখ আসেনা, সুখীদেরও সম্পদ হতে হবে এমন কোন কথা নাই। সম্পদ পেতে হলে পরিশ্রমী হতে হবে তবেই সম্পদ ধরা দেবে, সুখী হতে চাইলে অনবরত পুণ্য কর্ম করতে হবে, তবেই রাজ্যের সুখ ধরা দেবে।
আগেই লিখেছি শহুরে জীবন যাত্রা একটু কঠিন বলে তাদের সমস্যাও বেশী, তারপরও তাদের কল্যাণমূলক অবদানও কম নয় নয়। সমস্যা হল সুখের আশায় সম্পদ আহরণ কিংবা হননে মোটেই সুখ আনয়ন করেনা। তা ব্যাপক জনগোষ্ঠীর অসুখের ও দুর্ভোগের কারণ হয়।
তাই মহানবী (সাঃ) বলেছেন: “কাজ শুরু করার আগে ভেবে নাও, তাহলে লোকসান হবেনা, দায়িত্ব নেওয়ার আগে পরামর্শ কর, তাহলে লজ্জিত হবেনা, জীবন যাপনে মধ্যম পন্থা অবলম্বন করো, তাহলে ক্ষতিগ্রস্ত হবেনা ও বিপদে পড়বে না (আল-হাদীস)”
রাসূল (সাঃ) আরো বলেছেন: তোমরা তোমাদের ফেলে আসা দিনগুলো নিয়ে চিন্তা কর, কত অসুবিধায় তোমরা ছিলে, তোমার বন্ধু-বান্ধব যারা তোমাদের চাইতে খারাপ অবস্থায় দিন যাপন করেছে তাদের দিকে তাকাও, তাহলে বুঝতে পারবে তুমি কত ভাল আছ।
আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেছেন: তোমরা আমার নেয়ামতের কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন কর, তাহলে তোমাদের আরো বাড়িয়ে দেব। যদি না কর তাহলে কেড়ে নেয়া হবে” (আল-কোরআন)
সুখের তালাশে উপসংহার
একটু চিন্তা করে দেখলে বুঝা যায়, আমরা যদি বোবা হতাম, পৃথিবীর কোন কথা, আওয়াজ, পাখির ডাক, গানের সুর, মায়ের হাঁসির আওয়াজ, কিছুই শুনতাম না, তাই কোন কথা বলতেও পারতাম না, তখন কি অবস্থা দাঁড়াত?
যদি অন্ধ হতাম পৃথিবীর রং, ফুলের বর্ণ, মায়ের মুখ কিংবা নিজের মুখখানি কেমন জানতাম না! পৃথিবীর সব সৃষ্টিকে মাটির মত মনে হত। যদি বিকলাঙ্গ হতাম কত বিদ্রূপাত্মক কথাই না শুনতে হত।
সামান্য সাহায্যের আশায়, মানুষের দিকে অসহায় ভাবে তাকাতে হত। দেশ বিদেশ কি ঘুরা হত? বিয়ে করাতো দূরে থাক, একটি সুন্দর নিষ্পাপ বালকের মুখে আদরের হাত লাগানোর সাহসও হতনা।
একটু গভীর মনে চিন্তা করলে আর ভাবলে বুঝা যায় কত কিছু আমাদের কাছে আছে যা অনেকের নিকট নাই। মন তৃপ্তিতে ভরে উঠবে, অন্তরে আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা বোধ জন্ম নেবে।
তখনই প্রকৃত সুখের সন্ধান পাওয়া যাবে। মানুষের, সকল প্রাণীর, সকল সৃষ্টির, সমাজের ও রাষ্ট্রের কল্যাণ ব্যতীত অকল্যাণে সুখ নাই। সকল সময়ে ও কাজে আমরা যদি কৃতজ্ঞ হই তাহলেই আমাদের সুখ আসবে, আমরা সকলেই সুখী হব এবং দুঃখ বিতাড়িত হবে।
Discussion about this post