স্বপ্নের ফ্লাট বাড়ি
নজরুল ইসলাম টিপু
নাচেগো সুন্দরী কমলা,
প্রেমিক পুরুষ রহিম মিঞা,
রূপবানে নাচে কোমর দুলাইয়া…।
গানের ধুম-ধারাক্ষা শব্দ আর গায়িকার তীক্ষ্ণ কণ্ঠের কড়া সুরে, মোতালেব সাহেবের মায়ের অস্থিরতাটা আবারো বেড়ে গেল! বৃদ্ধা মা ছেলেকে লক্ষ্য করে বললেন, বাবারে! মনে হচ্ছে এখনই দম বন্ধ হয়ে মারা যাব। হৃৎপিণ্ডটি বুঝি এখনি ফেটে পড়বে, জলদি ফ্যান চালু কর।
মোতালেব সাহেব দৌড়ে গিয়ে ফ্যানের সুইচ চাপলেন, ধ্যাত! এখনও বিদ্যুৎ আসেনি! অগত্যা হাতপাখা দিয়েই বৃদ্ধা মায়ের মাথায় বাতাস দিতে শুরু করলেন।
বাবারে, হাত পাখার গরম বাতাসে মুখখানা যেন পুড়ে যাচ্ছে, সহ্য হচ্ছেনা, মাথায় পানি ঢাল। মোতালেব সাহেবের স্ত্রী দৌড়ে গেলেন বাথরুমে, পোড়া কপাল! লাইনে এখনও পানি আসেনি। মায়ের এমন ধর পরানি অবস্থা দেখে মোতালেব সাহেব তাড়াতাড়ি বিদ্যুৎহীন ফ্রিজ খুলে, দুটি মিনারেল ওয়াটারের বোতল বের করলেন!
দুঃখের যেন শেষ নাই এই ধরনের ঠান্ডা পানি মায়ের মাথায় ঢাললে পুরানা হাঁপানিটা আবারো মাথাচাড়া দেবে। একটু সাধারণ পানি জোগাড় করে ফ্রিজের ঠাণ্ডা পানির সাথে মিশিয়ে স্বাভাবিক তাপমাত্রায় এনে মায়ের মাথায় ঢালবেন, সে যোগাড় নেই। অগত্যা উপায়হীন মতলব সাহেব, আজকের এই ছুটির দিনে, পাশের প্রতিবেশীকে বাদ্যের শব্দ, আরেকটু ছোট করার জন্য, আরেক বার অনুনয়-বিনয় করার সিদ্ধান্ত নিলেন!
মোতালেব সাহেব নিজের ঘরের দরজা খুলে বের হতেই দেখেন, কড়িডোরে আরের ফ্লাট প্রতিবেশীর স্কুল পড়ুয়া কিশোর ছাত্র রূপবান গানের, কোমর দোলানোর গানের তালে তালে নিজেরাও কোমর দুলিয়ে নেচে চলছে! দেখেই মেজাজটা আরো খারাপ হয়ে গেল।
স্বগোতক্তি করে বলল, কোন জাহান্নামে উঠেছি নিজেই জানিনা। কোন পাপের কারণে আমার উপর এত জ্বালা বুঝলাম না! অন্তরে গোস্বা নিয়ে, জোড় করে মুখে একটু হাঁসি ফুটিয়ে পাশের বাসার কলিং বেলে টিপ মারেন। একবার, দুবার, কয়েকবার! অবশেষে ঘরের ভিতর থেকে বোধোদয় হল কেউ দরজায় বেল টিপেছেন।
হাতে লোহার চুড়ি, এককানে দুল পরিহিত কলেজ পড়ুয়া ছেলেটি দরজা খুললেন! দরজা খোলা মাত্র মনে হল, পুরো ফ্লাটটি যেন শব্দ বোমায় ভাসছে! তিনি ভাবলেন, বিকটা আওয়াজের রাজত্বে এরা বেঁচে থাকে কিভাবে! বোঝা গেল, মোতালেব সাহেবকে সামনে দেখে ছেলেটি খুবই পেরেশান হল। তারপরও চেহারায় কৃত্রিম শ্রদ্ধা ফুটিয়ে প্রশ্ন করল, বলুন আঙ্কল, কেন আসলেন?
মোতালেব সাহেব বললেন, বাবারে এতদিন গেল ‘নান্টু ঘটকের কথা শুইনা, অল্প বয়সে করলাম বিয়া’। আর আজকে নতুন করে শুরু হল ‘রূপবানে নাচে কোমর দুলাইয়া’! বাবারে তোমাদের দুই’পা ধরা বাকি রাখছি, আমার বৃদ্ধা মায়ের হার্টের অপারেশন হয়েছে, তিনি উচ্চস্বরের আওয়াজ শুনলে হার্ট বিট বেড়ে যায়, ব্লাড-প্রেসারে কষ্ট পায়। ডাক্তার বলেছেন, এভাবে চললে তিনি নির্ঘাত মারা পড়বেন। তোমার হাই ভল্যূমের ড্রাম সেটের আওয়াজে আমাদের অস্তিত্ব আজ বিপন্ন হওয়ার জোগাড়! যদি শব্দটা একটু ছোট কর তাহলে এই যাত্রায় বাঁচি!
আঙ্কল! আপনার প্রতিদিনকার ঘ্যানর ঘ্যানর আর ভাল লাগেনা। আমরা আমাদের ঘরে গান শুনছি, আপনার ঘরে ঢুকে তো ড্রাম সেট বাজাচ্ছিনা! তাছাড়া এটা আমরা কখন বাজাব? সকালে বাজালে আপনার সমস্যা! দুপুরে বাজালে আপনার মায়ের সমস্যা! সন্ধ্যায় বাজালে ওদের ছেলে মেয়ের লেখা-পড়ার সমস্যা! রাত্রে বাজালে আমার মায়ের সমস্যা! আপনি কি এই পরামর্শ দিতে এসেছেন যে, গান শুনতে হলে যাতে করে রমনার বটমূলে চলে যাই?
আমাদের মত যুবকদের কি কোন চাওয়া পাওয়ার কিছু নেই? একটু গান বাজালেই আপনি আপত্তি দেন! আমি আস্তে বাজাই, আর জোড়ে বাজাই সর্বদা আপনি বাধা দিচ্ছেন! আপনি যেভাবে ৪২ লাখ টাকায় আপনার ফ্লাট কিনেছেন, আমার পিতাও বিদেশে চাকুরী করে ৪২ লাখ টাকায় এই ফ্লাট কিনেছেন। আমরা আমাদের ফ্লাটে নাচব, গাইব, মারামারি করব, সেটা নিয়ে আপনার আপত্তি করার কথা তো নয়! আপনি দয়া করে এক্ষুনি যান, আর যা পারেন তা করেন। আমি আপনার কথা শুনতে বাধ্য নই, আর কখনও আমাকে বিরক্ত করবেন না, প্লিজ!
চাকুরীজীবী মোতালেব সাহেব ছোটকাল থেকেই বাবার সাথে ঢাকা শহরে বড় হয়েছেন। চাকুরীর নির্দিষ্ট টাকার আয়ে তার পিতা যেভাবে একখণ্ড জায়গার মালিক হতে পারেননি। মোতালেব সাহেবেরও ইচ্ছা থাকা স্বত্বেও ঢাকায় একটি প্লট কিনে বাড়ী করতে পারেননি। পুরো জীবন মানুষের কথা শুনে শুনে, অসহায়ের মত ভাড়া বাসায় থেকেছেন। তাই বন্ধুর পরামর্শে মোতালেব সাহেব যেন স্বপ্ন হাতে পান, বাবার অবসরকালীন টাকা, গ্রামের জায়গা বিক্রির টাকা ও ব্যাংক থেকে নিজের নামে কর্জ নিয়ে বহুদিনের স্বপ্ন, নিজের জন্য একখানা বাড়ী হিসেবে এই ফ্লাট খানা কিনে নেন।
মনে বড় আশা নিয়ে ভাড়াটিয়ার জীবন ছেড়ে নিজেদের কেনা এই বাড়ীতে উঠেছিলেন! ভেবেছিলেন এখন থেকে আর বাড়ী ভাড়া নিয়ে চিন্তা করতে হবেনা, বাড়ী ওয়ালার বাঁকা মন্তব্য সইতে হবেনা, বেতন থেকে খাওয়া ও বাচ্চাদের লেখাপড়া বাবদ যা যায়, বাকী টাকার পুরোটাই জমানো যাবে। মা, এই ফ্লাট বাড়ী নিয়ে তেমন উৎসাহী ছিলেন না, তিনি বাবার মৃত্যুর পর গ্রামের বাড়িতেই থাকতে ছেয়েছিলেন। কিন্তু গ্রামের অব্যবহৃত বাড়ি বিক্রি না করলে, শহরের ফ্লাট বাড়ীর টাকা হচ্ছিলনা, তাই ছেলের পিড়াপীড়িতে মা বাধ্য হয়েই শহরে ছেলের সাথে থাকছেন বিগত ৫ বছর ধরে। মায়ের ভাষায় এটাতো থাকা নয়, যেন জাহান্নামের অভ্যন্তরে বসে ইটের রসগোল্লা খাওয়া!
মোতালেব সাহেবের মাথায় কাজ করছিল না, তার কি করা উচিত? কার সাহায্য চাওয়া উচিত? ভেবে পাচ্ছিলেন না, কি করবেন সামনের দিনগুলোতে? এ সমস্ত চিন্তায় ঘুম হারিয়েছেন দেড় বছর হল, চোখের নীচে কালি জমেছে বহু আগেই! ব্যাংকের কর্জ, মায়ের চিকিৎসা বাবদ মোটা অংকের ধার-দেনা যোগ হয়েছে, আগেই। মেয়ে দুটি যেন প্রতিমাসেই এক ইঞ্চি করে বাড়ছে!
আরো দুঃখ হল, সামনের বাসাটি একজন অবসর প্রাপ্ত বিচারকের। তিনি বহু আগের কেনা প্লট বিক্রি করে, তার অর্ধেক টাকা দিয়ে এই ফ্লাট নিয়েছেন, বাকী টাকাটা ব্যাংকে রেখে, সুদ তুলে খাচ্ছেন। মাসের শেষে অবসরকালীন ভাতাটা যোগ করে কোনমতে দিন চালাচ্ছেন। পক্ষাঘাতে আক্রান্ত সাবেক বিচারক সর্বদা ঘরে শুয়েই থাকেন। বড় ছেলেটি মাস্তান ধরনের। সর্বদা দরজা খুলে বন্ধু-বান্ধব নিয়ে নিজেদের দরজায় বসে থাকেন। ফলে প্রাপ্ত বয়সী মেয়েদের নিয়ে হয়েছে জ্বালা। দু’একবার ঝগড়া হয়েছে, এতে সম্পর্ক নষ্ট হওয়া ছাড়া কোন উপকার হয়নি।
বিচারক একদা অন্যের সন্তানের বিচার করলেও আজ তিনি অসহায়, নিজের সন্তানের এই বেহায়াপনা দেখে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকানো ছাড়া কোন উপায় নাই। ছয়তলা ভবনের প্রতি ফ্লোরে ৪টি করে পরিবার আছে। দেশের ৬৪টি জেলা থেকে আগত ২৪ টি পরিবারের বাস। সবাই সচ্ছল ও শিক্ষিত পরিবারের বাসিন্দা। কারো দরজায় টোকা দিয়ে অভিযোগ জানানো কদাচিৎ মুসিবতের কারণ হতে পারে। কেউ অবসর প্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তা, কেউ এমপি’র আত্মীয়, কেউ সংস্কৃতি ব্যক্তিত্ব। তার পরও এই ভবনের বাসিন্দারা যেন পুরো শহরের সবচেয়ে বেশী অসুখী মানুষ; যার ফলে এই ভবন থেকে বেরুবার গলিতে ফার্মেসী সংখ্যা বাড়ছে বেশী!
সোজা ও ভদ্র প্রকৃতির মানুষ মতলব সাহেব। হিসেব করে কড়ি গুনে জীবন চালান। তিনি কারো ধারে-পাছে যেতে চাননা। ফ্লাট কিনে মানুষের সাথে যতবার হট্টগোল করতে হয়েছে, ভাড়া বাসায় থেকে ৩৫ বছরেও তার কিঞ্চিত পরিমাণ ঘটাতে হয়নি। সমস্যা হলে বাড়ী ওয়ালাকে জানিয়েছে। বাড়ীওয়ালার একক সিদ্ধান্ত সবাই মানতে বাধ্য ছিল। বনিবনা না হলে ফ্লাট ছেড়ে দিয়েছে, নতুন জায়গায় উঠেছে, ব্যস! সব মিটমাট। এখানেতো নতুন জায়গায় উঠার সুযোগ নাই, নিজের ঘর, নিজের বাসা, একক ক্ষমতাধর কেউ নাই, যাকে বলে সুরাহা করা যায়; কেননা এখানে সবাই বাড়িওয়ালা!
মতলবের ফ্লাটের উপরের তলার ঘরের ডিজাইনগুলো নিচের চাইতে একটু ভিন্ন ধরনের। ৪র্থ তলার মতলব সাহেবের রান্না ঘরের ঠিক উপরেই পড়েছে পাঁচ তলার বাথরুম। ২ বছর আগে ৪ মাত্রার ভূ-কম্পনে রান্নাঘরের ছাদে একটু ফাটল হয়েছিল। সে থেকে রান্না ঘরে উপরের বাথরুম থেকে টপা-টপ পানি পড়তেই থাকে। মিস্ত্রী দেখিয়েছেন। জানাল, এক সপ্তাহের কাজ আছে। উপর ফ্লোরের বাথরুমের মেঝ ভাঙ্গতে হবে, তবেই পানি পড়া সমস্যা ঠিক করা যাবে।
টয়লেট ভাঙ্গতে হবে! মতলবের এমন আবদার শুনে, উপর ওয়ালা তো অট্টহাসি দিলেন! তিনি বললেন, আমার বাথরুম ভাঙ্গা হবে আপনার সুবিধার জন্য! আর আমরা সবাই সিটি কর্পোরেশনের টয়লেটে গোসল করতে যাব? সে চিন্তা বাদ দেন বরং আপনার ঘরে পতিত, আমার বাথরুমের পানি তবররুক হিসেবে মাথায় মাখুন, আকল বাড়বে, বুদ্ধি বাড়বে, সম্মান পাবেন! মামা বাড়ীর আবদার পেয়েছেন!
অপমানিত হয়ে মতলব চলে আসতে বাধ্য হন। ফ্লাট বাড়ীতে অতীত কোন অভিজ্ঞতা ছিলনা। এখানে সমস্যাটা নিজের কিন্তু সমাধা করতে গেলে অন্যের অসুবিধা হয়, তাই কেউ সহযোগীতায় এগিয়ে আসেনা। বরং সমস্যা বলতে গেলে, কটু কথা শুনতে হয়, কটু বাক্য হলে একই কথা আর দ্বিতীয়বার উঠবে না। পুরানো সমস্যা তো সমাধান হয়না তার উপরে নতুন সমস্যা যোগ হয়। কিছুদিন আগে উপরের তলার ভদ্রলোকের মেয়ের বিয়ে উপলক্ষে, বাথরুমে গোশত কাটা হয়েছিল, ভারী মাস্তুলের আঘাতে ফ্লোরের পুরানা ফাটল আরো বেড়ে যায়। আগে পানি পড়ত ফোটায় আর এখন পানি অনবরত চিকন নালে। ফলে নিজের রান্নাঘর এখন অব্যবহৃত থাকছে। তাছাড়া উপরের ভদ্রলোকের বুড়ো মায়ের প্রতি ৩০ মিনিট পর পর পান খাওয়ার বাতিক আছে। হামান-দিস্তায় সুপারী গুড়ো করার সময়, যেভাবে গুঁতো মারে, তাতে মনে হয় সেখানে তো পান-সুপারি নয়, যেন পাথর চূর্ণ করে চলছে!
লোকমুখে শোনা যাচ্ছে, শুরুতে এই ভবনের মাটি পরীক্ষাই নাকি ঠিক হয়নি। আস্তে আস্তে ভবন নীচে দেবে যেতে থাকবে। অথচ মাটি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছে, কর্তৃপক্ষের এমন অনুমোদন আছে। ভবনের খিলানগুলো নাকি বেশী গভীরে ঢুকানো হয়নি, ফলে কাত হয়ে পড়ার সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেয়া যায় না। ভবন বানানোর সময় মতলব সাহেব তো এখানে ছিলেন না। খিলান মাটির কতটুকু গভীরে গেছে এটা তো নিজের চোখে দেখে রাখার বিষয় নয়! তাছাড়া তিনিতো প্রকৌশলী নন যে, দেখলেই ভুল ধরতে পারবেন!
শুনেছিলেন ভবনের চারিদিকে ৩ ফুট রাস্তা থাকবে। রাস্তা করার মত জায়গা খালিও ছিল। পাশের ভবন উঠার সময় দেখা গেল ওটা তাদেরই জায়গা! ভবন নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান বেশী দামে ফ্লাট বিক্রি করতে রাস্তার জন্য নির্ধারিত জায়গাও মূল ঘরের মধ্যে ঢুকিয়েছেন। শোনা যাচ্ছে সরকারী কর্তৃপক্ষের পরিকল্পনায় এই ভবন ভাঙ্গার মধ্যে পড়েছে। এই ভবনে ফ্লাটের মালিক হিসেবে দু’একজন বড় কর্মকর্তা আছেন বলে কর্তৃপক্ষ ভাঙ্গার কাজে এখনও এখানে হাত দেয়নি। সে জন্য ক্ষমতাশালী আরেক ফ্লাটওয়ালা যথাযথ ব্যক্তিকে প্রতি মাসে মাসে বকশিশ দেন, তাই ভাঙ্গা আপাতত রহিত হয়েছে। এই নতুন উৎপাতে বকশিশ বাবদ মাসের বেতন থেকে একটি নির্দিষ্ট টাকার অংক খরচ হয়।
দুঃখের যেন শেষ নাই মতলব সাহেবের ফ্লাট বাড়ীতে। ভবনের সিমেন্ট নাকি দুই নম্বরি ছিল! আরো বিপদের কথা হল, ভবনে যে বালি ব্যবহার করা হয়েছে, সেগুলো ছিল সামুদ্রিক বালি, যাতে ছিল অনেক লবণ! ফলে লবণাক্ত বালিতে, সিমেন্ট ও ইটের গাঁথুনিকে আস্তে আস্তে খেয়ে যেতে বসেছে! যার কারণে কিছু দিন পরে ভবন থেকে গোশত খসে গিয়ে, লোহার কঙ্কাল দেখা যাবে। জোড়ে নাড়া খেলে চামড়া ঝরে গিয়ে এই ভবন হিরোসীমার বিধ্বস্ত বাড়িটির মত স্থাপত্য নিদর্শন হবে। আস্তর ঝরে যাওয়ার কিছু নমুনা ইতিমধ্যেই প্রকাশ হচ্ছে। মতলব সাহেব বারবার জিভে কামড় দিয়ে আফসোস করছেন, ফ্লাট কিনার আগে কেন তিনি এই ভবনের চুন সুরকি একটু মুখে দিয়ে লবণ পরীক্ষা করে দেখেননি?
ফ্লাট নেওয়ার আগে মোতালেব সাহেবের ধারনা ছিল বেতন থেকে এখন শুধু জমানোর পালা। আজ তিনি আকল জ্ঞান হারিয়ে গাধাকে বাপ ডাকতে বাধ্য হচ্ছেন। আধুনিক সুবিধায় পরিপূর্ণ এই ভবন, ৩ বছরের সার্ভিস ওয়ারেন্টি সহ লিফটের ব্যবস্থা আছে। মতলব সাহেব সর্বসাকুল্যে ১০ বার লিফটে চড়তে পেরেছিলেন, একবার বিদ্যুৎ চলে যাওয়াতে লিফটের ভিতর মই ঢুকিয়ে উদ্ধার পেয়েছিলেন! বারবার বিদ্যুতের ভেল্কিবাজিতে লিফটের পুরো কন্ট্রোল প্যানেলই জ্বলে যায়। ফলে দীর্ঘদিন লিফট ব্যবহার বন্ধ। বর্তমানে সেটাকে ভবনের দাড়োয়ান, তার কাপড়-চোপড়, গামছা-জুতো ঢুকিয়ে রাখার স্থান বানিয়েছে। কন্ট্রোল প্যানেল নাকি সার্ভিস ওয়ারেন্টির মধ্যে পড়েনা, তাই এটা বাড়ীওয়ালাদের নতুন করে জাপান থেকে কিনতে হবে।
জিঞ্জিরাতে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে এগুলোর দুই নম্বরি এখনও দেশে চালু হয়নি। তেলের দাম বেড়ে যাওয়াতে জেনারেটর বন্ধ বহুদিন ধরে। আগে জেনারেটর চালাতে গিয়ে অতিরিক্ত অনেক টাকাখরচ হয়েছে। অনেক বাড়ী ওয়ালা এখনও অতিরিক্ত তেলের দামটা পরিশোধ করেনি! বন্ধ জেনারেটর চালু করতে গিয়ে দেখা যায় ইঞ্জিনের কার্বোরেটর খারাপ হয়েছে। অনেক টাকা খরচ করে কার্বোরেটর ঠিক করার পর জানা গেল, জেনারেটরের ভিতরের প্রায় যন্ত্রপাতি নাকি চুরি হয়েছে। উপরে দেখতে জেনারেটর, তবে ভিতরে হৃৎপিণ্ড, যকৃত, পাকস্থলী, মুত্রথলী সবই গায়েব! দাড়য়ান কে পিটিয়ে জেলে ঢুকানো হয়েছে; কাজের কাজ কিছুই হয়নি। অনেক টাকা খরচ কার্বোরেটর ঠিক করা হয়েছে, তাও জলে গেল। তাই লিফট-জেনারেটরে সমস্যার, স্থায়ী সমাধানের জন্য বাৎসরিক ইনস্যুরেন্স করার পরামর্শ এসেছে।
এ সকল সমস্যা সমাধানে ফ্লাট ওয়ালাদের ঐক্যমত্যে কমিটি গঠিত হল। কমিটি প্রধানের দায়িত্ব নিলেন এম, পি’র আত্মীয় পরিচয়ের আরেক দাপুটে বাড়িওয়ালা! সেক্রেটারি হলেন বিচারকের সন্তান! তারাই ভবনের প্রয়োজনীয় কাজ করিয়ে নিবেন, সে জন্যে নতুন কমিটি প্রতি ৩ মাস অন্তর টাকা তুলে নিবেন।
ভবনে রং করা হল, রঙ্গয়ের উজ্জ্বলতা ৪ মাসও স্থায়ি হলনা! কেউ বলেন, আস্তরের বালিতে লবণের পরিমান বেশী হবার কারণে এমনটি হয়েছে! কেউ বলেন, লাগানো ‘রং’ টাই দু’নম্বর! কেউ বলেন, রংয়ের মিস্ত্রি অভিজ্ঞতা শুন্য! কথা হল উপরোক্ত সমস্যার পরীক্ষা করবে কে? প্রত্যেকের পকেট থেকে তো মাসে মাসে টাকা যাচ্ছেই। কার কাছে কে বিচার জানাবে?
ভবনে চুরি-চামরী বেড়ে যায়, নিরাপত্তা বিঘ্নিত হয়, কারো কারো ছেলে নাকি সিঁড়ির রুমে মাদক পান করে, কেউ লবিতে বসে সিগারেট টানে, পরিবেশ বরবাদ করে, বাচ্চারা বের হতে পারে না। কারো ছেলে নাকি বখাটে হয়েছে, কারো মেয়ের নাকি ছেলে বন্ধু বেশী; চাই আরো নিরাপত্তা। সিকিউরিটি ও ভবন পরিষ্কার করার জন্য যে জনবল দরকার, ডিজাইনে তাদের জন্য এই ভবনে কোন কক্ষ’ই রাখা হয়নি। বলা হয়েছিল, নিচে সবার জন্য একটি টয়লেট রাখা হবে। কেননা, পেটে টয়লেট চেপে রেখে হন্তদন্ত হয়ে কারো পক্ষে ৩-৬ তলা বেয়ে উঠা সহজ নয়। কিন্তু হয়নি!
সবার মতামতের ভিত্তিতে ভবনের কোণায় একটি টয়লেট বানানো হল। টয়লেট বানাতে সরকারী কর্তৃপক্ষের অনুমোদন না নেয়ায়, সিটি কর্পোরেশনের পরিদর্শক মোটা অংকের জরিমানা করে দিলেন! অথচ পুরো ভবনটির বহু অবৈধ কাঠামো অন্যায় ও অনুমোদন হীন ভাবে গড়ে উঠেছিল, তখন দেখার কেউ ছিলনা! এ জাতীয় নানাবিধ খরচ যোগ হতে হতে মতলব সাহেবকে মাসে গড়ে ৭ হাজার টাকার ‘ইজা’ গুনতে হয়। অথচ তিনি যখন ভাড়ায় থাকতেন তখন ৭ হাজার টাকা দিয়ে ভাড়া বাসায়ও আলীশান ভাবে থাকতে পারতেন!
অফিস থেকে ফিরছিলেন মতলব সাহেব, মোবাইল সাইলেন্ট থাকায় ১০টি মিসকল ধরতে পারেননি, তিনি উল্টো ফোন করে মেয়েদের কান্নার আওয়াজ পান। মতলব সাহেবের মনে সন্দেহ হল, দৌড়ে বাসায় পৌঁছলেন। তিনি নির্বাক, নীরব, নিথর হয়ে যান; কিছুক্ষণ আগেই মা ইন্তেকাল করেছেন! পাশের বাসা থেকে ভেসে আসা গানের সুরে তাদের কান্নার আওয়াজ মিশে একাকার হয়ে গিয়েছে! বাহিরের মানুষ নতুন ধরনের আওয়াজ শুনে বলাবলি করছিল, বাজারে এখন বুঝি কণ্ঠ শিল্পীরা এখন কান্নার ও রি-মিক্স বের করেছেন!
মা তার পুত্রবধূকে বলে গেছেন, জীবিত কালে তো পারেননি, অন্তত মরার পরে যেন তার লাশটি যাতে, শহরের কোলাহল থেকে দুরে গ্রামের নির্জন কবরে সমাহিত করা হয়। আরো উপদেশ দিয়েছেন যে, সম্ভব হলে যাতে করে, এই ফ্লাট নাম মাত্র মূল্যে বিক্রি করে দেয়। এত পেরেশানি নিয়ে যেন, এই দামী ভবনে না থাকে! প্রয়োজনে কম ভাড়ায় শহরতলীর বাঁশের ঘরকে যেন গুরুত্ব দেওয়া হয়।
ঢাকা শহরে আবারো ৪.৬ মাত্রায় ভূ-কম্পন অনূভুত হয়, ভবনে দৃশ্যমান কিছু ফাটল তৈরি হয়, প্রকৌশলী বলেছেন ওটা এমন কিছু না, ভয়ের কারণ নাই। যারা ভবন তৈরি করেছিলেন তাদের দুর্বলতার কারণে এমনটি হয়েছে। তারা সর্বদা ব্যবসায়ীক মনোবৃত্তিকে কাজে লাগিয়েছেন, সেবাকে গুরুত্ব দেননি। নব্বই দশকে সামান্য ভূ-কম্পনে তুরস্কে এভাবে পুরো একটি শহর ধুলিতে পরিণত হয়েছিল! ভবনে লিফটের জন্য নতুন কন্ট্রোল প্যানেল বসানো হয়েছে, জেনারেটর ঠিক করা হয়েছে। এ সবের বিল ও আগের বকেয়া বিল মিলে, মোতালেব সাহেবকে ১লাখ ৪০হাজার টাকা দিতে হবে! আগে থেকে কর্জ ভারে কাহিল মোতালেব সাহেবের জন্য এই খবরটি ছিল আকাশ ভেঙ্গে পড়ার মত খবর!
মোতালেব এই টাকা পরিশোধে অপারগতা দেখালেন। ফ্লাট কমিটির সিদ্ধান্ত যেভাবেই হোক, টাকাটা তাকে দিতেই হবে। নতুবা তাঁকে তার ফ্লাট ছাড়তে হবে। ‘ফ্লাট কমিটি’ মোতালেবের ফ্লাট ভাড়া দিবে! ভাড়ার আয় থেকে মাসিক সার্ভিস চার্জ ও অনাদায়ী বকেয়া মেটানো হবে। এই পদ্ধতিতে সমস্যা সমাধান হতে থাকলে, মোতালেব সাহেব নিজের বাসায় উঠতে পারবেন ৫০ বছর পরে, যদি ভূমিকম্প কিংবা অন্য কোন দুর্ঘনটায় ভবন ধ্বসে না যায়!
মোতালেব ৪২ লাখ টাকা মূল্যের স্বপ্নের ফ্লাটে, বৃদ্ধা মাকে একটি দিনের জন্যও শান্তিতে রাখতে পারেননি! মানুষ অশান্তিতে থাকে সন্তানের অসদাচরণের কারণে। অথচ মোতালেব সাহেব ভাল মানুষ ছিলেন, মায়ের যত্নে কখনও সামান্যতম অবহেলা করতেন না, পুত্র বধূ আন্তরিক ছিলেন, নাতিনেরা খুবই ভদ্র ও দাদীর প্রতি আদরণীয় ছিলেন। এতকিছু নিজের পক্ষে থাকার পরও, শহুরে জীবনে মাকে সুখ দেখাতে সক্ষম হননি; পরের সৃষ্ট সমস্যার কারণে।
আলী (রা:) বলেছেন চার জন মানুষ বড় অসুখী, তারা হল ‘যার সন্তান বখাটে, যার স্ত্রী বাচাল ও সন্দেহপরায়ন, যার প্রতিবেশী অসৎ এবং যার বাড়ী বাজারের মধ্যে’। বাজারের হিসেবের কথা বাদ দিলেও স্বপ্নের ফ্লাট বাড়ীতে অসুখী হওয়ার জন্য বাকী উপকরণের সবগুলোই ছিল। রাসুল (সা:) প্রতিবেশীকে কষ্ট না দিতে বার বার তাগাদা দিয়েছেন। প্রতিবেশীর প্রতি গুরুত্ব বুঝানোর সময় সাহাবীরা ভাবতেন রাসুল (সা:) বুঝি এখুনি আমাদের সম্পদে প্রতিবেশীর হক আছে এমন কথা বলে দেবেন। মোতালেবের স্বপ্নের এই ফ্লাট বাড়ীতে প্রতিবেশীর সমস্যাতো ছিলই, তাছাড়া ছিল নানা উদ্ভট ঝামেলা, যা ভুক্তভোগীরাই মূল্যায়ন করতে পারেন। তিনি সমস্যার কোনটাই মোকাবেলা করতে পারেননি, আগামী মাসেই নিজের কেনা ফ্লাট ছেড়ে দিতে হবে। মনের দুঃখে, এক বুক হতাশায়, কম দামের একটি ভাড়া বাসার সন্ধানে তিনি শহরতলীর দিকে পা বাড়ালেন…..।
(উক্ত প্রবন্ধটি দেশ-বিদেশের বহু সাময়িকীতে প্রকাশিত হয়েছে)
Discussion about this post