ঈদের দিন সকালেই আমি জন্মগ্রহণ করি। পরবর্তী জীবনে প্রতিটি ঈদেই নানাবিধ ঘটনা অঘটনে জীবন কেটেছে। জীবনে যত ঈদ পেয়েছি প্রবাস জীবনেই বেশীর ভাগ সংখ্যক ঈদ কেটেছে। তবে এবারের ঈদ হতে যাচ্ছে বড় বেদনা-বিধুর ও কষ্টের মধ্য দিয়ে। ঈদের দিনে দু’দলের মানুষ মজা পায়। একদল হল শিশুরা আর অন্যদল হল রোজাদারেরা। প্রতিটি রোজাদার ঈদের দিন সকালেই ভুলে যায় যে, গত একমাস ধরে সারাদিন উপোষ ছিল। হ্যাঁ রোজার জন্য তাদের মন কাঁদে, মুত্তাকী মানুষ শান্তি পায় না, তার রূহের খোরাক বন্ধ হয়ে যাবার কারণে। কিন্তু এই ঈদের দিনে আমি এবং আমার পরিবারের সবাই ভিন্ন ধরনের এক আনন্দ মেতে উঠতাম। যা এবারের ঈদের তিলে তিলে অনুভব করছি।
প্রবাস জীবনে আত্মীয় স্বজন কেউ থাকেনা। প্রবাসে পরিবার নিয়ে ঈদ করতে পারে খুব কম সংখ্যক পরিবার। তাদের মাঝেও আসে অনেক সীমাবদ্ধতা। প্রবাসীদের বেশীর ভাগই একাকী জীবন কাটায় অন্য কথায় ‘ব্যাচেলর’। এসব ব্যাচেলরদের নিয়ে আমাদের ঈদ প্রীতির এক ভিন্ন প্রবাহ সৃষ্টি হত। প্রতি ঈদে আমার গৃহিণী বহু মেহমানের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করে থাকে। এটা আঞ্জাম দিতে গিয়ে শেষ রোজার কয়েকদিন থেকে নানা ধরনের প্রস্তুতি নিতে হত। প্রবাসে কোন চাকর-চাকরানীর সুযোগ নেই, কোন সাহায্যকারীও তেমন পাওয়া যায় না। সব কাজ একাকী নিজেকেই করতে হয়। যার জন্য গৃহিণীর কাজ বহুগুণে বেড়ে যেত। সে বরাবরই মেহমান দারী করতে খুবই আনন্দ পায়। সে মনোবলের কারণে হয়ত একাকী এত মানুষের জন্য প্রস্তুতি নিতে সে ক্লান্ত হয়ে পড়ত না! সে এই কাজে খুবই পটু, দুর্দান্ত তড়িৎকর্মা। যথাযোগ্য সাহায্যকারী পেলে সে দেড় থেকে দু’শো মানুষের খাওয়ার আঞ্জাম ঘর থেকেই করতে পারে। ঈদের আগের দিন পর্যন্ত যেহেতু আমার অফিস থাকত, সে হিসেবে আমার সহযোগিতাও তাকে তেমন একটা বেশী উপকৃত করত না।
উনত্রিশ রোজায় নিজের হাতে দই, মিষ্টি, পুডিং সহ নানাবিধ মিষ্টান্ন তৈরি করে ফেলে। চাঁদ দেখা যাবার ঘোষণা আসার সাথে সাথেই, আমাদের ঘরে বেজে উঠত কবি নজরুলের সেই ঐতিহাসিক গান, “রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশীর ঈদ”। আশে পাশের মুসলিম বিদেশী পরিবারগুলোকেও এই গান খুবই টানত। তারাও এই ভিন্ন ধরনের আনন্দে শরীক হত। আর গিন্নীর শুরু হয়ে যেত রান্নার কাজ। প্রবাসে পরিবার থাকলেও আমাদের দেশের মত অনেকগুলো কক্ষের সুবিধা এখানে সীমিত। ফলে সংকুচিত কক্ষের মধ্যে সর্বত্র রান্নার সরঞ্জামে ভড়ে উঠে। তার পরদিন সকাল পর্যন্ত এভাবে কাজের ধারাবাহিকতা চলে। এদেশে সূর্য উঠার এক ঘণ্টার মধ্যেই ঈদের জামাত হয়ে যায়। ফলে আমাদের ঘরে নতুন করে মেহমানের আনাগোনা শুরু হয়ে যেত।
একটি ছোট্ট ঘরে এতগুলো সবল শক্ত সামর্থ্য মানুষকে মেহমানদারি করাটা একটু বেকায়দা পূর্ণই বটে। আলহামদুলিল্লাহ এই প্রবাসেও আমি এমন কিছু সামাজিক বুদ্ধি সম্পন্ন মানুষদের বন্ধু হিসেবে পেয়েছিলাম, যারা এই কাজে সহযোগিতা করত। তারা আমার মেহমানের তালিকা জোগাড় করে, নিজেরা ছোট ছোট গ্রুপ বানিয়ে আমার ঘরে আসতে থাকত। এতে করে লিফটের সমস্যা, খাবার গেদা-রিং কোনটাই হত না। সবাই আনন্দ-চিত্তে খেয়ে আবার যথাসময়ে চলে যেতে পারত। খানা খাওয়ার পরে অনেকের সাথে এক সাথে দেখা, তাই ছোট খাট ফটো সেশনের কাজটাও সেরে নিত। এভাবে সারাদিন ঈদের আনন্দের আমার পরিবার মেতে থাকত। রাতের একটি নির্দিষ্ট সময়ে অমুসলিম পরিবারগুলো বেড়াতে আসত। অনেকেই এটাকে ভিন্ন চোখে দেখে থাকে কিন্তু আমি মনে করি, মুসলমানদের উদার সংস্কৃতির ধরন দেখানোর জন্য এটাই মোক্ষম সুযোগ।
বিকাল থেকে পরিবার গুলোর সাথে দেখা করার মহরত চলত। ঈদের দিনে আমার পরিবার কোথাও গিয়ে বেড়ানোর সুযোগ পেত না। কেননা দিন রাত আমার ঘরেই মেহমানের আসা যাওয়ায় থাকত। আমার সন্তান কিংবা স্ত্রী তারা কোন অবস্থাতেই এটা নিয়ে মনঃক্ষুণ্ণ হতো না। এভাবেই তারা ঈদ করতে এবং ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করতে অভ্যস্ত হয়ে উঠে। পরদিন বিকালে আমার যারা কাছের বন্ধু, তাদের পরিবারের সাথে ক্ষণিকের তরে দেখা করার জন্য বের হতাম। এতটুকুই হল প্রবাসের ঈদ। তার-পরদিন যথারীতি অফিস চালু হবে, নতুন করে পুরানো ব্যস্ততায় নিজেকে জড়িয়ে ফেলা হবে।
করোনার এই ঈদ সন্তানকেও দূরে রাখতে বাধ্য করেছে। এই ঈদে আমরা স্বামী-স্ত্রী দুজন সেই একই ঘরে আবদ্ধ। আমাদের মন এখনও আগের মত মেহমানের জন্য উদাস হয়ে আছে কিন্তু কাউকে দাওয়াত দিয়ে খাওয়ানোর সুযোগ থেকে বঞ্চিত থাকতে হচ্ছে। নেই আগের মত সেই কোলাহল, নেই সেই ধরণের ব্যস্ততা। এই রোজার মাসের প্রায় পুরোটাই অসুস্থতায় কেটেছে। না করোনার জন্য নয়। করোনা না আসার জন্য মুখে মাস্ক লাগাতে হয়, সে মাস্ক লাগালেই কাশি শুরু হয়ে যায়। প্রতিদিন অফিস করতে হয়েছে ওদিকে কাশি মানেই সন্দেহ! তাই অস্বস্তি ও অশান্তি নিয়ে দিনাতিপাত করতে হয়েছে।
আগামী কাল ঈদ কিন্তু ঈদের প্রভাব আমাদের ঘরে নেই। এভাবে হাজারো পরিবারেও নেই। সন্তান কাছে নেই, আধা কিলোমিটার পরেই আত্মীয়রা থাকে কিন্তু করোনা পরবর্তী এই পরিস্থিতিতে কেউ এভাবে কারো ঘরে যেতে পারে না। তাই আল্লাহর কাছে এটাই ফরিয়াদ যে, “আল্লাহ তুমি করোনার ভীতি দিয়ে আমাদের অনেকের অন্ত-চক্ষু খুলে দিয়েছ। অনেক মানুষের চেহারা পরিষ্কার করেছ। ধনীরাও অসহায় হয়ে উঠেছে। দাম্ভিক থমকে দাঁড়িয়েছে, সাহসী মানুষও মৃত্যুভয়ে অতিষ্ঠ হয়েছে। মানুষ একে অপর থেকে, ভাই-বন্ধু থেকে দূরে সরে গেছে। স্ত্রীরা স্বামীর বিপদ দেখে পালাচ্ছে। এই বিপদ তুমি আমাদের থেকে তুলে নাও। মানুষদের ক্ষমা করো, তাদের সবাইকে সঠিক জ্ঞান দাও।”
Discussion about this post