কিছু শিশু খায় বেশি, কাউকে জোড় করে খাওয়াতে হয়; কেউ খাওয়ার বেলায় থাকে বেজায় উদাসীন! বেশীর ভাগ অভিভাবক মোটা, নাদুস-নুদুস বাচ্চাকে স্বাস্থ্যবান ভেবে ভুল করেন। যাদের সন্তান পাতলা চিমচিমে, তারা ভাবেন আহারে! ছেলেটি না খাইয়ে শুটকির মত হয়ে গেছে। জগত সংসারে অসুস্থ শিশুর অভিভাবকেরা বেজায় পেরেশানিতে থাকে, থাকবেই! কিন্তু তার চেয়েও বেশী পেরেশানিতে থাকে চিকন সন্তানের মা-বাবারা! তারাই সন্তানকে জোড় করে খাওয়ানোর জন্য নানা ধরনের ফন্দি-ফিকির বের করে। এসব পিতা-মাতার দুঃচিন্তাকে কেন্দ্র করেই বাহারি কোম্পানিগুলোর খাদ্য সামগ্রী ও খেলনা পাতির যত কাজ কারবার।
একটি শিশুর পাকস্থলী কেটে যদি বের করা হয়, তাহলে পুরো পাকস্থলী তরকারীর একটি ছোট বাটির মতই জায়গা নিবে। সেটার ভিতরে মালামাল দিয়ে ভরতে গেলে আধা গ্লাস খাদ্য অনেক বেশী হয়ে যায়। শিশুর হাঁটাহাঁটি, লাফালাফির সাথে খাদ্য হজমের একটি ব্যাপার থাকেই। কিছু শিশু খায় বেশী, চায় বেশী, তাই জলদি বাড়েও বেশী। অবিরত চঞ্চল এরা। উদাসীন শিশুরা হাঁটাহাঁটি, লাফালাফিতেও উদাসীন হয়। তাই তাদের খাদ্য হজম হয় দেরীতে, ক্ষিধে পায় দেরীতে, অধিকন্তু খাদ্য দেখলে আশাহত, আতঙ্কিত হয়। এদেরও চঞ্চলতা থাকে। তবে মায়ের অধিভুক্ত যায়গার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকতে চায়। যাতে করে মায়ের পক্ষ থেকে তড়িৎ নিরাপত্তা পায়। বেশী খায় এমন শিশুদের এরা এড়িয়ে চলতে চায়। ওদের বন্ধুত্বে এরা আনন্দ পায়না। এমনকি ওরা যদি সব খেলনা হাওলাত দেয়, তারপরও একটি নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে চলে। শিশুদের এই দুটি চরিত্র নিশ্চয়ই অনেকে খেয়াল করে থাকবেন।
মনোবিজ্ঞানী আর আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞান এই ব্যাপারে একমত, যে সমস্ত শিশুরা একটু ভাবুক প্রকৃতির তারা খাওয়ার দিকে মনোনিবেশ করে কম। দেরীতে ক্ষিধে পাবার কারণে মা-দাদী ভাবে কেন তার খুধা হয় না! ফলে ডাক্তারের কাছে দৌড়াদৌড়ি শুরু। ডাক্তার সকল চিকিৎসা শেষে মলিন বদনে বলতে বাধ্য হয়, শিশুর কোন রোগ নাই। খায়, দায় এমন শিশুরা বাস্তববাদী হয়। কোন কিছুর সাথে মোকাবেলা করার ব্যাপারে এরা হতাশ নয়। স্বার্থ, অধিকার আদায় কিংবা অন্যকে বিলিয়ে দেবার বেলায় এরা চতুর। দুনিয়াদারী বুঝার ক্ষেত্রে ওরা ভাবুকদের চেয়ে অগ্রগামী থাকে।
ভাবুকেরা বৈশিষ্ট্যগতভাবে কল্পনাপ্রবণ। কল্পনাপ্রিয় মানুষ দুনিয়াদারীতে পিছিয়ে থাকে। তারা পেটের চেয়ে চিন্তার খোরাক বেশী সংগ্রহ করে। কোন মতে রটি রুজির ব্যবস্থা হলে তারা চিন্তা করতেই বেশী স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। বেকুপ, নির্বোধ, নিজের স্বার্থ হাসিলে অকর্মা-উদাসীন; এসব শব্দের ব্যবহারে বকাবকি করেও, দাম্পত্য জীবনে এদের স্ত্রীরা মজা পায়না। তবে ইচ্ছার স্বাধীনতা পায় বেশ ভাল। জীবনের শুরুতেই যদি, শিশু চিন্তা করে, কল্পনা প্রবণ হয়, তাহলে তাকে কোন স্যালাইন দিয়েই ঠিক করা যাবেনা। সেক্ষেত্রে তার জন্য সহযোগী পরিবেশ দিলে বিশ্বখ্যাত একজন ব্যক্তি হয়ে উঠতে পারে। একটি শিশু যখন ক্রিকেট বলে ছক্কা পিটায়, তখন চিন্তাশীল শিশুটি ভাবতে থাকে, ইশ! যদি উড়ন্ত বলে চড়ে বসতে পারতাম, তাহলে আসমানের ওপারে কি আছে, তা দেখতে পেতাম।
এই পৃথিবীর যত অভিনব ও যুগান্ত সৃষ্টিকারী আবিষ্কার হয়েছে তার প্রায় সবগুলোই সৃষ্টি হয়েছে মানব শিশুর কল্পনা আর চিন্তার প্রভাবে। মনে যখন প্রশান্তি আসে কিংবা জগত সংসার নিয়ে যার মাথাব্যথা নাই, তিনি কল্পনা করতে ভালবাসেন। শিশুদের এই চিন্তার সুযোগ বেশী। সে জন্য শিশুরা কার্টুন ছবির অদ্ভুত চরিত্র বেশী পছন্দ করে। এখানে শিশুদের সকল প্রশ্নের উত্তর আছে, তাই তন্ময় হয়ে দেখে।
কল্পনা থেকেই চিন্তার সৃষ্টি। মানুষ যখন চিন্তা করা শুরু করে তখন মস্তিষ্কে ঝড় শুরু হয়ে যায়। মূলত মস্তিষ্ক এই কাজটির জন্যই অপেক্ষা করতে থাকে। তাকে চিন্তার খোরাক দিলেই সে সচল, সমৃদ্ধ ও তাজা হয়। পৃথিবীর অন্য সকল প্রাণী থেকে মানুষকে এখানেই আলাদা করা হয়েছে। মানুষের মগজ আর বাকী সৃষ্টির মগজ এই জায়গায় পৃথক। তাই যারা ঘন ঘন চিন্তার রাজ্যে ঢুব দেয়, তাদের ব্রেন সচল হয় বেশী। অংক, বিজ্ঞান, বিশ্লেষণের সমস্যাগুলো মাথায় ঢুকিয়ে সমাধান করতে না পেরে, হয়ত মানব শিশু ঘুমিয়ে পড়ে কিন্তু তার এই ঘুমানোর ফাঁকেও মগজ তার রেখে যাওয়া বিষয় নিয়ে কাজ করতে থাকে। পরদিন তার কাছে এমন একটি কাজকে সহজ বলে মনে হয়, যেটা কিছুদিন আগে তার কাছে ছিল দূরহ। অবসরে মগজ এই প্রশ্নের উত্তর তৈরি করে রেখেছিল। পরবর্তীতে একই জিনিষ দ্বিতীয়বার জানতে ‘ঢুঁ’ মারা হয়নি বলেই জানতে পারেনি, মগজ তার কাজটা সহজ করে রেখেছে। মগজের কোন ঘুম নাই, বিশ্রাম নাই! সারাদিন কাজ করে। মগজকে কাজ না দেওয়াই হল মানুষ হিসেবে তার প্রতি শ্রেষ্ঠ অবিচার।
তাই কোন শিশুর চিন্তা যদি একবার কোন কাজে ব্যস্ত হয়, তাকে অন্যদিকে ফিরানোটা কষ্টকর হয়। সেখানে খানা খাওয়ার ব্যাপার তো বাতুলতা মাত্র। আমাদের নবী মুহাম্মদ (সা) একান্তে গুহায় বসে পনের বছর ধরে চিন্তা করেছেন কিভাবে মানুষের কল্যাণ করা যাবে? তিনি উত্তর পেয়েছেন এবং আল্লাহর সান্নিধ্য দেখেছেন। সেভাবে অবিরত বিশ্ব স্রষ্টা সম্পর্কে চিন্তা করতে করতে শিশু ইব্রাহীম (আ) কিশোর বয়সেই সত্যের সন্ধান পেয়ে যান।
চিন্তা নিয়েই যে চিন্তা করতে হয় সেটা মানুষ আজ বেমালুম ভুলে গিয়েছে। ভিডিও গেমের মাধ্যমে চিন্তার কাজ যদি চোখের দায়িত্বে ছেড়ে দেওয়া হয়; তাহলে বিপদ সুনিশ্চিত! সন্তানেরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেই। বর্তমান দুনিয়ায় অনুভূতি ও উপলব্ধি-হীন সন্তান সৃষ্টি হচ্ছে এই কারণেই। কেননা তাদের সুকুমার বৃত্তিতে চিন্তার জায়গায় আঘাত হানা হয়নি কিংবা চিন্তার খোরাক জোটানো যায় নি।
সন্তানকে চিন্তাশীল করতে ও উপলব্ধি বোধ বাড়াতে অভিভাবকে অনেক সময় রূঢ় হবার প্রয়োজন পড়ে। সন্তানকে কদাচিৎ খিদের অনুভূতি তৈরি করে কান্না করানো উচিত। কখনও সন্তান ব্যথা পেলে, মাতা-পিতার কান্না দেখে অনেক বুঝতে ভুল করেন ব্যথা প্রকৃতই কে পেয়েছে! এটা ভুলেও করতে নেই। সন্তানকে ব্যথা অনুভূতির সুযোগ দিন। এই ব্যথা মামুলী বলে ধমক দিন! গরীবের শিশুরা এই ব্যথা নিয়ে খেলাধুলা করে বলে উপমা দিন! মৌমাছি, পিপড়ার কামড় না খেলে সে কিভাবে বুঝবে বিষের যন্ত্রণা কেমন? কামড় খাইয়ে অভ্যস্ত করান। নতুবা জীবনের প্রথম যন্ত্রণাতেই নেতিয়ে পড়বে। পিতা-মাতা যে সন্তানকে দশ কেজি ওজনের একটি বস্তা বহন করার প্রশিক্ষণ দেয় নাই। তারা কিভাবে আশা করতে পারে, কোন একদিন অসুস্থ হলে সেই সন্তান তাদেরকে কাঁধে বয়ে হাসপাতালে নিতে পারবে!
সন্তান হয়ত ঘাস ফড়িংয়ের লেজ ছিঁড়ে, নাড়ী-ভুরি বের করে আনন্দ নিচ্ছে! অভিভাবক হিসেবে তাৎক্ষনিক উচিত তাকে বলা, যদি তোমার পেট ছিঁড়ে নাড়ি-ভুরি এভাবে বের করি তাহলে তোমার কেমন লাগবে? ঘাস ফড়িংয়ের মা-বাবা নাই বলেই কি তুমি একাজ করছ? এই প্রশ্নে যে কোন শিশু থমকে দাঁড়াবে। তাদের মগজ বড়দের চেয়ে বেশী সচল, চিন্তায় গতিশীলতা বেশী। এভাবে প্রতিদিন প্রতিনিয়ত তাদের দিকে ঘন ঘন প্রশ্ন ছুড়ে দিন; তারা ভাবতে বাধ্য হবে। চিন্তাশীল সন্তান কখনও কোনদিন পিতা-মাতা, দাদা-দাদী, প্রতিবেশী-আত্মীয়কে অবহেলা করেনা। তারা দেশপ্রেমিক হয়। যদি তা না করা হয়; তাহলে একদিন দুরারোগ্য ব্যাধির ব্যথার যন্ত্রণায় বিছানায় গড়াগড়ি খাওয়া হবে; তখন উপকারের বদলে, এই ধরনের একটি দুর্লভ দৃশ্য ধারণ করতে সন্তান সেলফি তোলায় ব্যস্ত হবে।
Discussion about this post